রোহিঙ্গাদের ঘরে ঘরে বিধবা নারী ও এতিম শিশু

রোহিঙ্গাদের ঘরে ঘরে বিধবা নারী ও এতিম সন্তান। এসব নারীর স্বামী এবং সন্তানের পিতাকে হত্যা করা হয়েছে মিয়ানমারের মংডু, বুচিডং, রাসিডং ও আকিয়াবসহ বিভিন্ন এলাকায়। মিয়ানমারের সেনা বাহিনী এবং নাডালা বাহিনীর সদস্যরা এসব মানুষকে নির্বিচারে হত্যা করে। তাদের অত্যাচার ও নির্যাতন থেকে রেহাই পেতে যারা বাংলাদেশের বিভিন্ন এলাকায় এসে আশ্রয় নিয়েছেন তাদের কাছ থেকে এসব তথ্য জানা গেছে।

এমনও শিশুরা রয়েছে যাদের বাবা-মা দু’জনকেই হত্যা করা হয়েছে। আবার এমন পরিবার রয়েছে যেখানে কোনো পুরুষ সদস্য নেই। হয়তো তাদের হত্যা করা হয়েছে, না হলে ধরে নেয়া হয়েছে। এমনও সন্তান রয়েছে যারা বাবাকে দেখার আগেই এতিম হয়েছে।

টেকনাফের লম্বাবিলের প্রধান সড়ক থেকে মিয়ানমার সীমান্ত প্রায় দুই কিলোমিটার। মাছের ঘেরের বেরিবাধ দিয়ে পায়ে হেঁটে সীমান্তে পৌঁছতে হয়। গত ১৫ সেপ্টেম্বর ওই পথ দিয়ে সীমান্তে যাওয়ার সময় হাত ধরাধরি করে দু’টি শিশু এগিয়ে আসছিলো লম্বাবিল প্রধান সড়কের দিকে। কোথায় গিয়েছিলে জানতে চাইলে সীমান্তের দিকে আঙ্গুল উঁচিয়ে দেখায়। বাড়ির কথা জিজ্ঞেস করতেই বলে ‘বর্মা’। বর্মার কোন জায়গায় জানতে চাইলে শিশু দু’টির উত্তার ‘কোরহালি’।

শিশু দু’টির বাড়ি মিয়ানমারের মংডুর কুমারখালী এলাকায়। তাদের একটির নাম ফারুক (৮), অপরটি আব্দুল্লাহ (৫)।
তাদের বাবা নুরুল আলম কৃষি কাজ করতেন। আর মা ফরিদা বেগম ছিলেন গৃহিনী। মাঝে মধ্যে কৃষিকাজে সে তার স্বামীকে সহায়তা করতেন।

শিশু দু’টি জানায়, তাদের বাবা-মা দু’জনকেই কেটে ফেলেছে। তাদের চোখের সামনে বাবা-মাকে কেটে হত্যা করে দুর্বৃত্তরা তাদের লাশ পাশের একটি কুপে ফেলে দেয়। ওখানে আরো অন্তত ৩০টি লাশ তারা ফেলতে দেখেছে।

এ এলাকায় বর্মী বাহিনী ও নাডালা বাহিনী যখন হত্যাকাণ্ড চালায় তখন অনেকেই দৌঁড়ে পাশের ঝোপ জঙ্গলে গিয়ে আশ্রয় নেন। ফারুক এবং আব্দুল্লাহও তাদের সাথে গিয়ে ঝোপের ভেতরে পালায়। পরে বর্মী বাহিনী ও মগরা চলে গেলে তারা প্রতিবেশীদের সাথে চলে আসে বাংলাদেশে। লম্বাবিল হয়ে তারা ১১ সেপ্টেম্বর এপাড়ে আসে।

এরপর প্রতিদিনই তারা দুই ভাই সীমান্ত এলাকায় যায়। যেদিক থেকে তারা এসেছে সেই পথের দিকে তাকিয়ে থাকে। তাদের চোখের সামনেই বাবা-মাকে হত্যা করা হলেও তাদের বিশ্বাস তাদের বাবা-মা ওইপথ ধরেই চলে আসবে তাদের কাছে।

তারা জানায়, তাদের এক ভাই এবং ভাবীও রয়েছে। তারা কোথায় কী অবস্থায় আছে কেউ জানে না।

এসব কথা বলতে বলতে শিশু দু’টি এক পর্যায়ে কেঁদে ফেলে। অবুঝ এ দুই শিশুর কান্না দেখে সেখানে উপস্থিত অন্যরাও কেঁদে ফেলেন।

লম্বাবিলের পাশের রাস্তায় দুই শিশুকে নিয়ে ঘুরছিলেন বৃদ্ধা জোহরা বেগম। তার কোলের শিশুটির নাম তফসিরাতা (১), আর হাতে ধরে আছেন আয়াতুল্লাহকে (২)। জোহরা হলেন ওই শিশু দু’টির নানী। শিশু দু’টিকে কোলে নিয়ে রাস্তায় নেমেছেন তাদের খাবার যোগাড় করতে। নাতীদেরকে কি খাওয়াবেন তার জন্য মানুষের কাছে হাত পাতছিলেন জোহরা। শিশু দু’টির বাবা রহিমুল্লাহ কৃষি কাজ করতেন। তাদের মায়ের নাম হাজেরা। বর্মি বাহিনীর হাতে শিশু দু’টি তাদের বাবা-মা দু’জনকেই হারিয়েছে।

জোহরা বলেন, এ দুই শিশুকে নিয়ে তিনি এখন কি করবেন তা বুঝতে পারছেন না।

তিনি বলেন, ২৫ আগস্ট তাদের বাড়িতে হানা দেয় সেনাবাহিনী ও নাডালা বাহিনী। তারা কেটে হত্যা করে রহিমুল্লাহ ও তার স্ত্রী হাজেরাকে। তাদের বাড়ি মংডুর হাইছ সুরতা এলাকায়। মেয়ে-জামাইকে হত্যার পরে প্রতিবেশীদের সাথে সাগর পথে দুই নাতী-নাতনীকে নিয়ে বাংলাদেশের উদ্দেশ্যে পাড়ি জমান জোহরা। ১৩ মে তারা শাহপরীর দ্বীপ হয়ে টেকনাফ প্রবেশ করেন।

মংডুর পুরুংপাড়ার আনোয়ার সাদির বয়স দুই বছর। মা ফাতেমা বেগম আনোয়ার সাদীকে নিয়ে লম্বাবিল এলাকার রাস্তায় দাঁড়িয়েছেন সাহায্যের আশায়।

তিনি বলেন, তার স্বামী মোঃ হোসেনকে বর্মী বাহিনী হত্যা করেছে। সন্তানকে নিয়ে তিনি চলে এসেছেন এপাড়ে। তিনি এখন বিধবা। তার সন্তান আনোয়ার সাদী কিছু বুঝে ওঠার আগেই পিতাকে হারিয়েছে।

মংডুর কুমিরখালী থেকে মামার সাথে এপাড়ে এসেছে আরাফাত। তার পিতা কালু কৃষিকাজ করতেন।

আরাফাত জানায়, তাদের এলাকায় অনেককে মেরে ফেলা হয়েছে। তার বাবা-মা বেঁচে আছে কি না তা জানে না সে। মামার সাথে তিনি এপাড়ে চলে আসে।-নয়া দিগান্ত