মিয়ানমার আর্মির পরিকল্পনা কী?

কয়েক বছরের পরিকল্পনা গ্রহণ সত্ত্বেও ইতিহাসের সবচেয়ে জঘন্য মানবতাবিরোধী অপরাধগুলো বর্তমান বিশ্বে কদাকার ও সচলরূপে দেখা যাচ্ছে। প্রথম বিশ্বযুদ্ধের সময় রাশিয়ার গোয়েন্দাদের ভয়ে আর্মেনীয় গণহত্যা সংঘটিত করেছে অটোমান সাম্রাজ্য। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সময় সোভিয়েত ইউনিয়ন ও পশ্চিমা মিত্ররা জার্মানির প্রতিরক্ষা ব্যবস্থা গুঁড়িয়ে দেয়ার পর নাৎসি জার্মানি তো চূড়ান্ত সমাধান- হলোকাস্টের রক্তাক্ত অধ্যায়ের বাস্তবায়নের জন্য রীতিমতো প্রতিযোগিতা করেছে।

গণহত্যা অধ্যয়নে নতুন যারা আসছে তারা এর ঐতিহাসিক পুনরাবৃত্তি দেখতে পারে মিয়ানমারে, যার সামরিক বাহিনী ‘দ্য ট্যাটমাডো’ ২০১৬ সালের অক্টোবর ও চলতি বছরের আগস্ট মাসে আরাকান রোহিঙ্গা স্যালভেশন আর্মি- আরসার ব্যানারে তাদের ওপর হামলার পর দাবি করেছে, তারা সবেমাত্র মুসলিম সংখ্যালঘু রোহিঙ্গাবিরোধী লড়াই শুরু করেছে। যাই হোক, দ্য ট্যাটমাডো রোহিঙ্গা গণহত্যার কারসাজির পেছনে কয়েক দশক ব্যয় করে ফেলেছে, যে ষড়যন্ত্র বতর্মানে সফলতার মুখ দেখছে এবং পশ্চিমা বিশ্বের ক্রমবর্ধমান আত্মতুষ্টি ও ইসলামভীতির মুখে দাঁড়িয়ে তা সম্ভবত সফলতা অর্জন করবে।

১৯৪৮ সালে ব্রিটিশ সাম্রাজ্য যখন সাবেক বার্মা ও বর্তমানের মিয়ানমারকে স্বাধীনতা দেয়, তখন কিছু রোহিঙ্গা বৌদ্ধপ্রধান একটি সার্বভৌম দেশে নিজেদের খুঁজে পাওয়ার পরিবর্তে পৃথক ও নিজস্ব ইসলামী রাষ্ট্রের জন্য চেষ্টা চালিয়েছেন। রোহিঙ্গাদের পাশাপাশি বাস করা বৌদ্ধ রাখাইনদের নামে এটির নাম রাখাইন রাজ্য হয়ে যেতে পারে, তাই তারা এর নাম আরাকান হিসেবে বেছে নিয়েছিলেন। দ্য ট্যাটমাডো বা বার্মিজ সামরিক বাহিনীরও ভিন্ন পরিকল্পনা ছিল, তারা ওইসব রোহিঙ্গাকে বিচ্ছিন্নতাবাদী হিসেবে চিহ্নিত এবং বহিষ্কার করে বাংলাদেশে পাঠিয়ে দেয়।

রোহিঙ্গা শরণার্থীরা কেবল তখনই বাংলাদেশ থেকে ফিরতে পেরেছে, যখন ট্যাটমাডো সিদ্ধান্ত নিয়েছে, ক্রমবর্ধমান রোহিঙ্গা জনসংখ্যা বৃদ্ধিরোধ বাস্তবায়নের জন্য যথেষ্ট ধ্বংসযজ্ঞ চালানো হয়ে গেছে। রাখাইনরা ভীত ছিল যে রোহিঙ্গারা দ্রুতই সংখ্যায় তাদের ছাড়িয়ে যেতে পারে। ফলে বার্মার তখনকার সামরিক সরকার একটি সমাধানের নিয়ম করেছে- ১৯৮২ সালের নাগরিকত্ব আইন, যেখানে বার্মিজদের জন্য ১৮২৩ সালের আগে বার্মায় তাদের পূর্বপুরুষ প্রমাণ বাধ্যতামূলক করে দেয়া হয়। উল্লেখ্য, ১৮২৩ সালে ব্রিটেন বার্মায় উপনিবেশ স্থাপনের সময় ব্রিটিশ সাম্রাজ্য থেকে মুসলিমদের সেখানে গিয়ে বসবাস করার অনুমতি দেয়। দ্য ট্যাটমাডো এজন্য রোহিঙ্গাদের রাষ্ট্রহীনভাবে উপস্থাপন করছে এবং তাদের অবৈধ ‘বাঙালি’ অভিবাসী হিসেবে শ্রেণীবদ্ধ করেছে।

অটোমান বা নাৎসি, যারা সংখ্যালঘুদের মাত্র কয়েক বছরের মধ্যে ধূলিসাৎ করে দেয়ার চেষ্টা করেছে, তাদের মতো হয়ে ট্যাটমাডো কেবল বর্বরতার চর্চা করেছে তা-ই নয়, একইসঙ্গে তারা ধৈর্যও ধরেছে এবং দমন-পীড়ন করে গেছে। ১৯৯০-এর দশকের শুরুর দিকে যখন বার্মিজ সামরিক বাহিনী নিজের জাতীয়তাবাদী এজেন্ডা বাস্তবায়নের জন্য দেশটির নাম মিয়ানমারে পরিবর্তন করে, তখন খুব স্পল্প সময়ের মধ্যে তাদের ধর্ষণ, ধর্মের কারণে নিপীড়ন ও দাসত্বের হাত থেকে বাঁচার জন্য দুই লাখ ৫০ হাজার মানুষ বাংলাদেশে পালিয়ে যায়। তাদের বেশিরভাগকেই ট্যাটমাডো ফিরে যাওয়ার সুযোগ দেয়নি, সম্ভবত এটা মূল্যায়ন করার জন্য যে, একটি সংখ্যালঘু জাতিকে নিশ্চিহ্ন করা হলে আন্তর্জাতিক সম্প্রদায় বিষয়টিকে কীভাবে নেয়। বার্মিজ সামরিক বাহিনী বুঝতে পেরেছিল হুতু ও সার্বরা এক্ষেত্রে ব্যর্থ হয়েছে।

রোহিঙ্গাবিরোধী কৌশল বাস্তবায়নের জন্য সন্ত্রাসবিরোধী লড়াই মিয়ানমারের সামনে সুযোগ হিসেবে আভির্ভূত হয়েছে- ট্যাটম্যাডো ইসলামপন্থী সন্ত্রাসবাদের বিরুদ্ধে লড়াইয়ে লিপ্ত ছিল, ইসলামভীতিকে কেন্দ্র করে গণহত্যায় নিয়োজিত হয়নি! যখন ২০১২ সালের গ্রীষ্মে রাখাইনের রাজধানী সিত্তেতে জাতিগত দাঙ্গা বাধে, তখন ট্যাটমাডো হাজারও রোহিঙ্গাকে তাদেরই নিরাপত্তার জুজু তুলে নিপীড়ন ক্যাম্পে বন্দি করে। মিয়ানমার সরকারের মতে ক্যাম্পগুলো বৌদ্ধ রাখাইনদের হাত থেকে রোহিঙ্গাদের রক্ষা করেছে, যেখানে অকার্যকর প্রতিরোধ আন্দোলন রোহিঙ্গা সলিডারিটি অর্গানাইজেশনের (আরএসও) অভিযুক্ত সন্ত্রাসীদের তাড়া করছিল সামরিক বাহিনী।

হত্যার বিপরীতে রোহিঙ্গাদের বন্দি করে রাখার ফাঁদ বেছে নেয়ার মাধ্যমে ট্যাটমাডো গল্প বানানোর সুযোগ পেয়েছে। যদিও হিউম্যান রাইটস ওয়াচ ও জাতিসংঘ প্রতিবাদ করেছে, ২০১২ সালে যেটা ঘটেছে তাতে তদন্তের প্রমাণাদি যথেষ্ট সন্দেহজনক বা দ্ব্যর্থক হলেও বেশিরভাগ পর্যবেক্ষকই তাকে ডিটেনশন গণহত্যা বলে চিহ্নিত করা থেকে বিরত ছিলেন। সহিংসতার মাধ্যমে তাড়ানোর পরিবর্তে ট্যাটমাডো বরং দমন-পীড়নের মাধ্যমে রোহিঙ্গাদের দেশ ছাড়তে উৎসাহী করছে।

২০১৬ ও ২০১৭ সালে ট্যাটমাডো নিজেদের কাজ, যেটা তারা ১৯৪৮ সালে শুরু করেছিল, তা সমাপ্ত করার সুযোগ পায়। বহু দশকের স্বল্পমাত্রার গণহত্যার শিকার রোহিঙ্গাদের প্রতিক্রিয়া- আরসার অস্তিত্ব ট্যাটমাডোকে সক্রিয় গণহত্যায় রূপান্তরের অজুহাত হাতে এনে দেয়। কথিত জঙ্গি- যাদের তারা ‘সন্ত্রাসী’ বলে (যদিও তারা কোনো বেসামরিক মানুষকে হত্যা করেনি), তাদের বিরুদ্ধে সামরিক বাহিনী লড়াই চালাচ্ছে গ্রেফতার, জ্বালানো-পোড়ানো, বাস্তুচ্যুত, হত্যা, ধর্ষণ ও রোহিঙ্গা বেসামরিক নাগরিকদের নির্যাতনের মাধ্যমে। এসব মানবতাবিরোধী অপরাধ তারা করে যাচ্ছিল জঙ্গি ও সন্ত্রাসবাদ মোকাবেলার তকমা দিয়ে- যে দুটি বিষয় পশ্চিমা সামরিক বাহিনীগুলোর কাছে খুবই জনপ্রিয়।

১৯৪৮ সাল থেকে নিয়ে এখন পর্যন্ত কোনো কিছুই ইঙ্গিত দিচ্ছে না যে ট্যাটমাডো আন্তরিকতার সঙ্গে সন্ত্রাসবিরোধী লড়াইকে পুনরুজ্জীবিত করছে। বিপরীতে এখন পর্যন্ত সু চির ব্যক্তিত্বের আড়ালে মিয়ানমারকে শাসন করা সামরিক বাহিনী সন্ত্রাসবিরোধী লড়াইয়ের আবরণে ইসলামবিরোধী লড়াই চালিয়ে যাচ্ছে। ১৯৯০-এর দশকের সর্বশেষ দুটি মুসলিমবিরোধী গণহত্যার ঐতিহাসিক প্রচেষ্টায় বসনিয়া ও কসোভোতে আমেরিকার মানবিক হস্তক্ষেপ ছিল। বর্তমানে আমেরিকা আর এ সংক্রান্ত হস্তক্ষেপে উৎসাহী নয়, এমনকি আফগানিস্তান ও ইরাকের বেলায়ও তাদের অনীহা- যে দেশ দুটিতে ২০০০-এর দশকের সামরিক হস্তেক্ষেপের জন্য খুবই উৎসাহী প্রমাণিত হয়েছিল ওয়াশিংটন।

ট্যাটমাডো ফিলিপাইন ও থাইল্যান্ডে তাদের প্রতিপক্ষের তুলনায় অনেক বেশি এগিয়ে গেছে- দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ার এ দেশ দুটিও ইসলামী উগ্রপন্থীদের মোকাবেলা করছে। ফিলিপাইন ও থাইল্যান্ড তো অন্তত সংঘর্ষের সমাধান এবং শান্তি আনার কথা বলছে। অন্যদিকে দ্য ট্যাটমাডো মিন্দানাও’র মোরোস ও পাটানির মালয়স থেকে অনেক কম অস্ত্রসজ্জিত আরসার সঙ্গে যে কোনো ধরনের আলোচনাকেই প্রত্যাখ্যান করছে। ট্যাটমাডো বা মিয়ানমারের সামরিক বাহিনী উগ্রপন্থা দমন নয়, নৃতাত্ত্বিক গোষ্ঠী রোহিঙ্গাকেই নিশ্চিহ্ন করে দিতে চায়। আরসা ও আরএসও প্রতিরোধ আন্দোলনে প্রকৃতপক্ষে খুব কমই আসল প্রতিরোধ গড়ে তুলতে সক্ষম, এটাই মনে হয় জুতসই অজুহাত।

পাঁচ লাখের বেশি বাংলাদেশে পালিয়ে যাওয়ার পরও রাখাইনে থেকে যাওয়া সামান্য কিছু রোহিঙ্গার একজন শ্যাম শু আনওয়ার দ্য ডিপ্লোমেটকে বলেছেন, ‘রোহিঙ্গা সংকট সমাধানের একমাত্র পথ হল আরাকানে জাতিসংঘ সেনা পাঠানো এবং আমাদের জাতির জন্য একটি নিরাপদ জায়গা তৈরি করা। এর বাইরে আমাদের জনগণকে রক্ষায় অন্য যে কোনো প্রচেষ্টাই ব্যর্থতায় পর্যবসিত হবে।’ ট্যাটমাডোর জাতি নিধন প্রচেষ্টাকে ‘অনমনীয় ও অমানবিক’ হিসেবে অভিহিত করেছেন আনওয়ার।

রোহিঙ্গারা এক সময় স্বপ্ন দেখেছিল যে মিয়ানমারের গণতন্ত্রায়ন ট্যাটমাডো কর্তৃক চুরি করে নেয়া তাদের অধিকার ফিরিয়ে দেবে। তারা মিয়ানমারে শান্তি আনার জন্য সম্ভাব্য হিসেবে সু চির রাজনৈতিক দল ন্যাশনাল লিগ ফর ডেমোক্রেসি- এনএলডির প্রশংসা করেছিল। এখন এনএলডি বা আন্তর্জাতিক সম্প্রদায় কেউই দোদুল্যমান হয়ে পড়া রোহিঙ্গাদের রক্ষা ও মুক্তির প্রত্যাশায় কিছুই করছে না। আনওয়ার বলেন, ‘আন্তর্জাতিক সম্প্রদায় আমাদের কেবল খাবার সরবরাহ করছে; কিন্তু আমাদের দরকার প্রতিরক্ষা ও খাবার- দুটোই’।

বিশ্বের সবচেয়ে নিপীড়িত জাতিগুলোর অন্যতম রোহিঙ্গারা নিজেদের যুদ্ধের প্রয়োজনীয়তার সামনে হাজির করেছে, সেটা মানবিক হস্তক্ষেপের মাধ্যমে হোক বা বিদ্রোহের মাধ্যমে। শ্যাম শু আনওয়ারের মতে ‘রোহিঙ্গাদের রক্ষার মাত্র দুটি পথ রয়েছে- একটি হচ্ছে জাতিসংঘ নিরাপত্তা পরিষদের হস্তক্ষেপ, অন্যটি রোহিঙ্গাদের অস্ত্র দেয়া।’ এর বাইরে তার স্বদেশিরা ট্যাটমাডোর বিরুদ্ধে কোনো বিকল্প দেখছে না। তিনি বলেন, ‘প্রতিটি মুহূর্তে আমরা বার্মিজদের ভয়ে আছি। এখানকার সবাই তাদের কারণে ভীত। গতকালও তারা আমাদের কাছের একটি গ্রাম জ্বালিয়ে দিয়েছে।’

ট্যাটমাডোর ওপর হামলার ক্ষেত্রে আরসা সম্ভবত ভুল হিসেব কষেছে, যেটা এখন আত্মরক্ষার কাজ বলে দাবি করা যায়। আরসা যত বেশি প্রতিরোধ করবে, তত বেশি মিয়ানমারের সেনারা সেদেশে থেকে যাওয়া রোহিঙ্গাদের গলা কেটে হত্যা করবে। আনওয়ার বলেন, তা সত্ত্বেও নিজের মাতৃভূমি ছেড়ে বাংলাদেশে পালিয়ে যাওয়াকে তিনি প্রত্যাখ্যান করেছেন। তার কথায় ‘আমরা শরণার্থী ক্যাম্পে বসবাসকে ভয় করি। যদি বার্মিজরা আমাদের হত্যা করে, আমরা সেখানেই মৃত্যুবরণ করব।’

দ্য ডিপ্লোমেট থেকে ভাষান্তর : সাইফুল ইসলাম
অস্টিন বোদেত্তি : মুসলিম বিশ্বের সংঘর্ষ নিয়ে কাজ করা ফ্রিল্যান্স সাংবাদিক