রোহিঙ্গা ইস্যু : কক্সবাজারে মানুষজনের মনে চাপা ক্ষোভ

কক্সবাজার থেকে গাড়িতে টেকনাফের মৌসুনীপাড়া যেতে দুই ঘণ্টা মতো লাগে।

সেখানে নাফ নদীর ধারে একটি বেসরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়। পাশেই বিশাল চরের মতো।

নাফ নদীর ওপারে দেখা যায় মিয়ানমারের পাহাড়। এই এলাকা দিয়ে রোহিঙ্গাদের একটি অংশ গত বছর ২৫ আগস্ট থেকে নৌকায় করে এসে বাংলাদেশে প্রবেশ করেছিলেন।

মৌসুনীর নয়াপাড়া আদর্শ বিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষক মোঃ: খলিলুর রহমান বলছেন তাদের এই স্কুলে বহু রোহিঙ্গাকে আশ্রয় দেয়া হয়েছিলো।

কিন্তু তার প্রভাব স্কুলের পড়াশোনায় এখনো রয়ে গেছে। তিনি বলছেন, “আমি স্কুলে দ্বিতীয় সাময়িকী পরীক্ষা নিতে পারিনি। স্কুলের শিক্ষকদের বাড়তি খাটিয়ে আমি পরে কভার করেছি”

তিনি বলছেন রোহিঙ্গারা এখন মোটামুটি প্রাথমিক ধাক্কা সামলে উঠেছে। কিন্তু তার স্কুলে তাদের উপস্থিতির একটি প্রভাব রয়েছে গেছে।

তিনি বলছেন,”আমাদের স্কুলে দুটো পানির মটর আছে। সেখান থেকে তারা পানি নিতে আসে। তাদের স্কুলে অবাধে বিচরণ। এতে পড়াশোনার পরিবেশ নষ্ট হচ্ছে।”

স্কুলের ঠিক পাশেই বাঁশ দিয়ে বানানো লম্বা ঘর। সেখানে রোহিঙ্গা পুরুষদের লাইন। ত্রাণের অপেক্ষায় তারা।

উল্টো পাশে মহিলাদের জন্য আলাদা ব্যবস্থা। আশপাশের জমিতে ধান চাষ হয়েছে।

তার মধ্যেই তাদের অসংখ্য খুপরি ঘর। এই এলাকায় বংশ পরম্পরায় জেলের কাজ করছেন মৌসুনীপাড়ার কামাল হোসেন।

বলছিলেন, “কোস্ট গার্ড মাছ ধরতে দেয়না। এখন দিন চলে দিন মজুরী করে। কোন দিন কাজ পাই কোনদিন পাইনা”

গত বছরের ২৫ আগস্ট থেকে নাফ নদী দিয়ে অনেক রোহিঙ্গা নৌকায় করে বাংলাদেশে প্রবেশ করেছেন।

জেলেদের মাছধরা নৌকায় করে রোহিঙ্গাদের পারাপার বন্ধে এখানে জেলেদের মাছ ধরাই বন্ধ অন্তত দশ মাস ধরে।

কক্সবাজারের উখিয়া ও টেকনাফ এলাকাতেই মূলত রোহিঙ্গাদের আশ্রয় মিলেছে। সরকারি হিসেবে এই এলাকায় ৩০ টি রেজিস্টার্ড ক্যাম্প রয়েছে।

কিন্তু উখিয়া ও টেকনাফের মুল সড়কগুলো ধরে গাড়ি চালিয়ে গেলে দেখা যাবে বন বিভাগের জমি, সরকারি খাস জমি ও সাধারণ মানুষজনের জায়গায় ও পাহাড়ের গায়ে রোহিঙ্গাদের আরও অসংখ্য খুপরি ঘর।

বহু পাহাড়ে কোন গাছ নেই। শুধু ছোট ছোট কুঁড়েঘরের চাল দেখা যায়। বিশাল অঞ্চল জুড়ে বনভূমি উজাড় হয়ে গেছে। নানা এলাকায় খাবার পানির উৎসে ব্যাপক চাপ।

আগে যারা এসেছেন তাদের অনেকেই কক্সবাজারে স্থানীয় জনগোষ্ঠীর সাথে মিলেমিশে গেছেন।

মৌসুনীপাড়া থেকে গাড়িতে করে আরও প্রায় ঘণ্টাখানেক গেলে বালুখালির তেলিপাড়া গ্রাম।

কাছেই একটি কাস্টমসের চেক পোষ্ট। গত বছর আগস্টে মিয়ানমারের সেনাবাহিনীর সহিংস অভিযানের পর এই এলাকা থেকে স্থল পথে প্রবেশ করেছেন অনেক রোহিঙ্গা।

তাদের অনেকেই এর কাছেই বালুখালি ক্যাম্পে আছেন। কিন্তু অনেকেই স্থানীয়দের উঠানে বা জমিতে ঘর করে এখনো রয়ে গেছেন।

তেলিপাড়া গ্রামের এক গৃহস্থ পরিবারের আমিনা বেগম বলছেন, “ঐখানে ঐ যে জমিতে একবছর হল চাষ করতে পারছি না। সেখানে রোহিঙ্গাদের বাস করছে তাই। এই এক বছরে দুইবার ধান লাগাতে পারতাম”

এই অভিজ্ঞতা এখানে বহু মানুষের। বেশ কটি মৌসুম পার হয়ে গেছে। বহু কৃষকের চাষবাস বন্ধ।

টেকনাফ ও উখিয়ায় কথাবার্তা বলে বহু জনের কাছ থেকে প্রচুর গবাদি পশু চুরির অভিযোগ পাওয়া গেলো। যেমনটা বলছেন তেলিপাড়ার রোজিনা আক্তার।

তিনি বলছেন, “আমরা গরু-ছাগল, হাস-মুরগী কিছু পালতে পারছি না। এইযে বাড়িটা, এখান থেকে একটা গরু নিয়ে গেছে। আমার বাড়ি থেকে দুটো ছাগল আর ঐ যে বাড়িটা ওখান থেকে তিনটা ছাগল নিয়ে গেছে। মাঠে বাধা ছিল। দিনে দুপুরে নিয়ে গেছে”

আমিনা বেগম ও রোজিনা আক্তারের বাড়ির উঠানেই রোহিঙ্গাদের কয়েকটি ঘর। এই গ্রামটিতে এসে মনে হল স্থানীয়রা যেন কোণঠাসা হয়ে রয়েছেন।

এখানকার দিনমজুর নুরুল আলম আর সেভাবে কাজ পাচ্ছেন না।

তিনি বলছেন, “আমরা চার-পাঁচশো টাকায় কাজ করতাম। এখন বর্মাইয়ারা দুই-তিনশো টাকায় কাজ করে। তাই আমরা মাসে দশদিনের বেশি কাজ পাইনা”

রোহিঙ্গারা স্থানীয়দের তুলনায় কম পয়সায় কাজ করছেন পুরো কক্সবাজার জুড়ে। স্থানীয় শ্রমবাজারে এর বড় ধরনের প্রভাব পড়েছে।

অনেক এলাকায় রোহিঙ্গারা কক্সবাজারের জনপ্রিয় বাহন অটোরিকশা চালাচ্ছেন। এখানকার অনেক শিশুরাও এখন স্কুলে যেতে ভয় পায়।

কারণ সড়কে এত গাড়ি তারা আগে কখনো দেখেন নি। জরুরী সাহায্য সংস্থার গাড়িই বেশি।

এমন সব এলাকায় এখন ট্রাফিক জ্যাম হয়, যেখানে মানুষজনের ট্রাফিকজ্যাম সম্পর্কে কোন অভিজ্ঞতাই নেই।

কারণ সাহায্য সংস্থার কর্মীরা একসাথে সকালে কক্সবাজার থেকে ক্যাম্পের উদ্দেশ্যে যাত্রা করে। আবার বিকেলে একই সময় সবাই কক্সবাজার শহরের দিকে ফিরতে শুরু করে।

সব কিছু মিলিয়ে মানবিক কারণে এক সময় রোহিঙ্গাদের ঠাঁই দেয়া মানুষজন রোহিঙ্গাদের প্রতি যেন সহানুভূতি হারিয়ে ফেলছেন।

বলছিলেন টেকনাফের হ্নীলা এলাকার একজন ইউনিয়ন মেম্বার মোহাম্মদ আলী।

তিনি বলছেন, “আমি নিজেও আমার জায়গায় তাদের থাকতে দিয়েছিলাম। মানবিক কারণে তাদের সহযোগিতা করছি। কিন্তু বর্তমানে তাদের প্রতি সেই সহানুভূতি আর নেই।”

স্থানীয়দের মধ্যে রোহিঙ্গাদের সম্পর্কে রীতিমতো ক্ষোভের আভাস পাওয়া গেলো। কারণ তারা মনে করছেন তাদের জীবনের উপরে জেঁকে বসেছে রোহিঙ্গারা।

তাদের স্থানীয় সমাজের কাঠামোটাই বদলে দিচ্ছে তারা। আর স্থানীয়দের জন্য কোন সহায়তার ব্যবস্থা এখনো হয়নি।

অন্যতম ক্ষতিগ্রস্ত এলাকা পালংখালীর প্যানেল চেয়ারম্যান নুরুল আবছার চৌধুরী আক্ষেপ করে সে কথাই বলছেন।

তিনি বলছেন, “রোহিঙ্গাদের তো বিভিন্ন এনজিওরা সহায়তা দিচ্ছে। বাঁচতে হলে আমাদের যে অধিকার, রোহিঙ্গারা আসার কারণে তাতে ব্যাপক ব্যাঘাত ঘটেছে। কিন্তু আমাদের তো এরকম কোন সহায়তা দেয়া হচ্ছে না”

উখিয়া ও টেকনাফে স্থানীয় জনগোষ্ঠীর তুলনায় রোহিঙ্গাদের সংখ্যা এখন দ্বিগুণ হয়ে দাঁড়িয়েছে।

প্রাণভয়ে পালিয়ে আসা মানুষের জন্য যারা মানবিক সহায়তার হাত বাড়িয়েছিলেন, আজ দশ লাখের বেশি রোহিঙ্গাদের চাপে তাদের নিজেদের জীবন ও জীবিকাই হুমকির মুখে। কিন্তু তাদের কথা ভাবছে না কেউ।

-বিবিসি বাংলা