রোহিঙ্গা সংকট : বিশ্বরাজনীতির প্যাঁচ ও বাস্তবতা

দীপংকর গৌতম : মাত্র ক’দিন আগের কথা। সিকিম ও ভুটানের সীমান্ত ডোকলাম এলাকা থেকে বেসামরিক নাগরিকদের সরিয়ে নেয়া হলো। চীন-ভারত মুখোমুখি অবস্থানে দাঁড়াল। সেনাসমাবেশ বাড়ানো হলো। যুদ্ধংদেহি দুটো দেশ অনেক দেশের বহু মানুষের শঙ্কার কারণ হলো। অথচ বাংলাদেশে রোহিঙ্গা সমস্যা প্রশ্নে এখন তারা মাসতুতো ভাই। পুঁজি বাজার স্বার্থ সব মিলে তাদের অবস্থান প্রায় অভিন্ন।

রোহিঙ্গা ইস্যুতে জাতিসংঘ নিরাপত্তা পরিষদের জরুরি বৈঠকের ঠিক আগের দিন চীনা পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় খুব পরিষ্কার ভাষায় মিয়ানমারের প্রতি সমর্থন ঘোষণা করেছে। রাখাইন রাজ্যে সেনাবাহিনী শান্তি প্রতিষ্ঠায় কাজ করছে দাবি করে বিশ্ব সম্প্রদায়কে মিয়ানমারের পাশে দাঁড়ানোর আহ্বান জানিয়েছে চীন। এর আগে ভারতও একই ভাষায় কথা বলেছে। চীনকে বলা হয় এশিয়ার ‘ঘুমন্ত বাঘ’। তারা কখন যে কী করবে বোঝা ভার। চীনের বিশ্বখ্যাত সমাজতান্ত্রিক আন্দোলনের পুরোধা মাও সে তুংয়ের জীবদ্দশায় বাঙালির মুক্তি সংগ্রামকে স্তব্ধ করে দিতে বর্বর পাকিস্তানিরা যে অস্ত্র ব্যবহার করেছে, গণহত্যা চালিয়েছে পাহাড়-নগর-টিলায়, সেগুলোতে যে সব দেশের সীল মারা ছিল চীন তাদের মধ্যে প্রধান। এশিয়ার এই নামসর্বস্ব সমাজতান্ত্রিক দেশটি বাণিজ্যিক স্বার্থে এমন কোনো অপকর্ম নেই যা করতে পারে না।

চীনের মিয়ানমার সমর্থনের কারণ অবশ্য ভিন্ন। যেখানে আমেরিকার কণ্ঠেও কোনো জোর নেই, ভারতও চীনের সঙ্গে। কারণ এ অঞ্চল সমৃদ্ধ। আরাকান উপসাগরীয় অঞ্চলে যে প্রচুর তেল-গ্যাস আবিষ্কৃত হয়েছে চীন তাতে বিনিয়োগ করেছে। ২০০৪ সালে আরাকানের গভীর সমুদ্রে আবিষ্কৃত গ্যাসক্ষেত্রে পাইপ লাইন বসিয়ে ইউনাইন রাজ্যের কুনমিংয়ে গ্যাস নিচ্ছে চীন। আরাকানে একটি গভীর সমুদ্র বন্দরও নির্মাণ করেছে তারা। যা সড়কপথে কুনমিংয়ের সঙ্গে সংযুক্ত হবে। এতে পণ্য আমদানি-রফতানিতে তাদের অর্ধেক সময় লাগবে। স্বাভাবিকভাবেই পণ্যের মূল্যও কম হবে। এসব তাদের ‘ওয়ান বেল্ট ওয়ান’ এবং ‘স্প্রিং অব পার্ল’ প্রকল্পের সঙ্গে সম্পর্কিত। বিশ্বজোড়া সাম্রাজ্য বিস্তারের স্বপ্নে বিভোর চীন এত স্বার্থ জলাঞ্জলি দিয়ে মিয়ানমারের বিপক্ষে অবস্থান নেবে এমন ভাবা সম্ভবত দুরাশা। অন্যদিকে আফ্রিকার হাইতিতে সামরিক ঘাঁটি করার পর মিয়ানমারের সামরিক ঘাঁটি যখন হচ্ছে তখন মার্কিন সাম্রাজ্যবাদের শেষ ঘাঁটি ফিলিপাইনের দিয়াগো গার্সিয়া মার্কিনের কাছে ইতিহাস। এশিয়ার ঘুমন্ত বাঘ আর যুদ্ধবাজ মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র রোহিঙ্গা প্রশ্নে যেসব বিবৃতি দিয়েছে তা কেবলই বাকসর্বস্ব। গলায় তেমন জোর নেই। কারণ এ অঞ্চলের দিকে লোভাতুর দৃষ্টি রয়েছে ঘুমন্ত বাঘ কিংবা সজাগ সিংহ সবার।

অন্যদিকে জাতিসংঘ একটি সাইনবোর্ড সর্বস্ব প্রতিষ্ঠানে পরিণত হয়েছে। দুঃখজনক হলো, গুরুত্বপূর্ণ এই সংস্থাটি শুধু যে একটি কথা বলার ক্লাবে পরিণত হয়েছে তাই নয়, এটি বর্তমানে বিশ্বমোড়লদের আজ্ঞাবহ প্রতিষ্ঠানে পরিণত হয়েছে। বিভিন্ন দেশের জাতীয় সংকটে প্রতিষ্ঠানটি গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রেখেছে তেমন কোনো নজির নেই। রোহিঙ্গা নিপীড়নের বিষয়ে তাদের ভূমিকা সব সময়ই হাস্যকর মনে হয়েছে। যখন রোহিঙ্গা নিধন পর্ব নতুন করে শুরু হয় তখন তারা বাংলাদেশকে সীমান্ত খুলে দিতে বলে কিন্তু রোহিঙ্গাদের ফিরিয়ে নেয়ার ব্যাপারে তেমন কোনো কথাই বলে না। এখন এটা খুব স্পষ্ট, রোহিঙ্গা সংকটে বাংলাদেশ একা হয়ে পড়েছে। আমাদের শরণার্থী ইস্যুতে বিশ্ববাসীর ‘প্রশংসা’ মিলবে ঠিকই। তবে দিন শেষে রোহিঙ্গাদের সব দায় ও দায়িত্ব আমাদেরই নিতে হবে। এবারের ধাক্কা কিছুটা থিতিয়ে গেলে বছর দুই-তিন পর আবার শরণার্থীর ঢল পাঠাবে মিয়ানমার। দেশ-বিদেশের প্রশংসা-তিরস্কার-উপদেশে আবারও তারা ঢুকবে বাংলাদেশে, যেভাবে সেই ১৯৪৮ থেকে তারা শুধু ঢুকছেই। বিহারি থেকে রোহিঙ্গা শরণার্থী প্রতিপালনে বিদেশি সহায়তা পাওয়ার ক্ষেত্রেও মোটামুটি ব্যর্থ এই দেশ। দিন বদলের সঙ্গে সঙ্গে বরং শরণার্থীরাই এলাকাভিত্তিক সমাজ ও রাজনীতির নিয়ন্ত্রকে পরিণত হয়েছে। কক্সবাজারের পর্যটন এরপর আর আগের মতো থাকবে কিনা, পর্যটকদের নিরাপত্তা বিধান হবে কি না এগুলো ভাবার মতো প্রশ্ন বটে। পাশাপাশি কয়েক লক্ষ রোহিঙ্গার ভার দীর্ঘ সময় বহন করা বাংলাদেশের পক্ষে আদৌ সম্ভব হবে কি? এমন চলতে থাকলে এই অঞ্চলে নানা ধরনের সামাজিক সমস্যা সৃষ্টি তো হবেই এবং তা বাংলাদেশ, ভারত, মিয়ানমার, থাইল্যান্ডসহ পার্শ্ববর্তী দেশসমূহের জন্য এক সময় নিরাপত্তা ঝুঁকিও তৈরি করতে পারে।

মিয়ানমারে বর্তমানে আটটি সক্রিয় বিচ্ছিন্নতাবাদী সশস্ত্র দল আছে। এদের সঙ্গে ইসলামের নাম দিয়ে অন্য দু’একটি দল যুক্ত হলে তা কোনো দেশের জন্যই ভালো হবে না। স্মরণ করিয়ে দেই সেখানে ইসলাম অথবা মুসলিম নাম দিয়ে দু’একটি জঙ্গিগোষ্ঠী থাকলেও তারা তেমন সংগঠিত নয়। কিন্তু অন্য দেশের সহায়তা ও অর্থায়নে সংগঠিত হলে তা সকলের জন্য ভয়াবহ পরিস্থিতি সৃষ্টি করতে পারে। আরও বলি বর্তমান পরিস্থিতি যে কোনো সময় গুরুতর আকার ধারণ করতে পারে। যদি সকল সংশ্লিষ্ট মহল সরব না হয় এবং কার্যকর ভূমিকা না রাখে রোহিঙ্গাদের ওপর বর্তমান চলমান ভয়াবহ সহিংসতা অনেক ঘটনা-দুর্ঘটনার জন্ম দিতে পারে। তার জন্য দীর্ঘসময় অপেক্ষা নাও করতে হতে পারে। এখানে অং সান সু চির ওপর নির্ভর করা নিরর্থক। নোবেল শান্তি পুরস্কার যে সব সময় উপযুক্ত মানুষের হাতে যায় তা কিন্তু নয়। হিটলারও শান্তি পুরস্কারের জন্য মনোনীত হয়েছিলেন। মহাত্মা গান্ধি দু’বার মনোনীত হলেও নোবেল কমিটি তাঁকে যোগ্য মনে করেনি।

গত ২৫ আগস্ট মিয়ানমার নিরাপত্তা বাহিনীর সীমান্তচৌকিতে আরাকান রোহিঙ্গা স্যালভেশন আর্মির হামলাকে কেন্দ্র করে নতুন এ বর্বরতার শুরু। মিয়ানমারে নিরাপত্তা বহিনীর ওপর মাঝেমধ্যে বিচ্ছিন্ন যে হামলা হচ্ছে তাকে রোহিঙ্গারা বলছে স্বাধীনতার আন্দোলন, আর মিয়ানমার সরকার বলছে এটি জঙ্গি হামলা। মিয়ানমার সরকারের বক্তব্যই যদি সত্য ধরে নিই তাহলেও কিছু প্রশ্নের উত্তর পাওয়া যায় না। কিন্তু শুধুমাত্র যদি সেই ৩২ বছরের ছেলেটির কথা বলি যে মিয়ানমারের সামরিক বাহিনীর দ্বারা নির্যাতিত। যে নিজের চোখে দেখেছে তার ভাই গুলি খেয়ে গলাকাটা মুরগির মতো দাপিয়ে শীতল হয়ে গেছে। যে তার অন্ধ বৃদ্ধ বাবা-মাকে কাঁধে ঝুলিয়ে মংডু গ্রাম থেকে ১০ দিন হেঁটে নাফ নদীর পাড়ে এসে দাঁড়িয়েছে শেষ বারের মতো বাঁচার আশায়। রাফিজার পরিবারে কোনো পুরুষ মানুষ বেঁচে নেই। নাফ নদীতে ভাসছে রোহিঙ্গাদের লাশ। এপাড়ে লাশের মতো মানুষগুলো। একটি স্বাধীন আরাকান রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠার সংগ্রামে নিরাপত্তা বাহিনীর বিরুদ্ধে আক্রমণের জন্য নির্বিচারে হত্যা, ধর্ষণ, লুণ্ঠন, গ্রামের পর গ্রাম জ্বালিয়ে দেওয়া, পলায়নপর নারী-শিশুদের ওপর নির্বিচারে গুলি কোনো নিয়মের তোয়াক্কা করেনি। মিয়ানমারের নিরীহ মানুষের ওপর নৃশংসতা, বর্বরতা, গণহত্যা, মানবতাবিরোধী অপরাধের কোন মাত্রায় পড়ে? কেন দেশ ছেড়ে মানুষ পালিয়ে শরণার্থী শিবিরকে বেশি নিরাপদ মনে করে? কেন মানুষ তার ভিটে-মাটি ছাড়তে চায়? ১৯৪৭ সালে সাম্প্রদায়িকতার ভিত্তিতে দেশভাগ হলে হিন্দু সম্প্রদায় রাতের আঁধারে ত্যাগ করে সাত পুরুষের ভিটা, তুলশীতলা, বাড়ি ঘর, নিকানো উঠোন দীঘির জল। মুসলমানরা একইভাবে এসেছিল পাকিস্তানে (বর্তমান বাংলাদেশ)। হিন্দু- মুসলমানদের কান্না আজও থামেনি।

রোহিঙ্গাদের কান্নার বয়স আরো পুরনো। দমন পীড়নের শিকার হয়ে মিয়ানমার থেকে রোহিঙ্গাদের বাংলাদেশে আগমন নতুন নয়। মিয়ানমারে তাদের নাগরিকত্ব নেই, সব ধরনের রাষ্ট্রীয় সুযোগ-সুবিধা থেকে তারা বঞ্চিত। স্বাধীন রাজ্য আরাকানে ২০০ বছরের মুসলিম শাসনের অবসান ঘটে ১৬৩৫ খ্রিস্টাব্দে। সেখান থেকেই শুরু আরাকানি মুসলমান তথা রোহিঙ্গাদের ভাগ্য বিপর্যয়ের। এরপর ১৭৮৪ সালে আরাকান স্বাধীনতা হারায়। বর্মি রাজা বোধাপোয়া আরাকান দখল করে নেন। ঘোর মুসলিমবিরোধী রাজা বোধাপোয়াও অসংখ্য মুসলমানকে হত্যা করেন। ১৮২৫ সালে ব্রিটিশরা বার্মা অধিকার করলে আরাকান বার্মার একটি প্রদেশ হিসেবে ব্রিটিশ শাসনের অধিকারভুক্ত হয়। বার্মায় ব্রিটিশ শাসনের অব্যবহিত পরেই ব্রিটিশবিরোধী মনোভাব অঙ্কুরিত হতে থাকে। ১৯০৬ সালে রেঙ্গুন কলেজের শিক্ষার্থীরা ব্রিটিশবিরোধী ইয়াং মেনস বুড্ডিস্ট অ্যাসোসিয়েশন প্রতিষ্ঠা করে। পরবর্তীকালে এটি জেনারেল কাউন্সিল অব বার্মিজ অ্যাসোসিয়েশন (জিসিবিএ) নাম ধারণ করে। জিসিবিএর পাশাপাশি বর্মি বিশুদ্ধবাদিতার স্লোগান তোলে ‘দো বা মা’ (আমাদের বর্মি সংগঠন) নামে আরো একটি জাতীয়তাবাদী রাজনৈতিক সংগঠন গড়ে ওঠে। এরা নিজেদের থাকিন (মাস্টার) বলে পরিচয় দিতে থাকে। থাকিনরা বিদেশি খেদাও আন্দোলনের নামে মিয়ানমারে বসবাসরত ভারতীয়দের বিরুদ্ধে প্রচারণার সূচনা করে সারা বার্মায় তা ছড়িয়ে দেয়। ভারতীয়বিরোধী মনোভাবের এই ঢেউ আরাকানেও এসে পৌঁছে। শত শত বছর ধরে বংশপরম্পরায় আরাকানে বসবাসকারী রোহিঙ্গাদেরও দুর্ভাগ্যবশত ভারতীয় হিসেবে পরিগণিত করা হয়। থাকিনদের নেতা অং সান সু চির বাবা অং সান বার্মার স্বাধীনতার লক্ষ্যে বর্মিদের সংগঠিত করতে থাকেন। দ্বিতীয় মহাযুদ্ধ শুরু হলে অং সান জাপান চলে যান এবং জাপানের সহায়তায় স্বাধীনতা লাভের উদ্দেশ্যে সেখানে বার্মিজ ইনডিপেনডেন্ট আর্মি (বিআইএ) গঠন করেন। ১৯৪২ সালে আকিয়াবে জাপানি আক্রমণ শুরু হলে ব্রিটিশরা আকিয়াব ত্যাগ করে, আর এ সুযোগে থাকিনরা আরাকানকে রোহিঙ্গামুক্ত করার পরিকল্পনা আঁটে। তারা নির্দেশ দেয়, যেসব মুসলমানের অবয়ব রাখাইনদের মতো নয়, বাঙালিদের মতো, তাদের অবিলম্বে আরাকান ত্যাগ করতে হবে।

১৯৪২ সালের ২৮ মার্চ বিআইএর নেতৃত্বে আরাকানি থাকিনরা নিরস্ত্র রোহিঙ্গাদের ওপর ঝাঁপিয়ে পড়ে। রোহিঙ্গাদের ঘরবাড়িতে আক্রমণ চালিয়ে বহু রোহিঙ্গা মুসলিমকে হত্যা করা হয়, গ্রামের পর গ্রাম আগুন জ্বালিয়ে নিশ্চিহ্ন করে দেওয়া হয়, অসংখ্য নারী ধর্ষণের শিকার হয়। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের শুরুতে অং সান জাপানের সহায়তায় বার্মার স্বাধীনতার লক্ষ্যে যে বিআইএ গঠন করেছিলেন তাতে বার্মিজ ও অন্যান্য জাতিগোষ্ঠী ব্যাপক সাড়া দিলেও রোহিঙ্গারা ইংরেজদের সমর্থন ও সহায়তা দিয়েছিল। এ বিষয়টি বার্মিজ ও রাখাইনদের চরমভাবে ক্ষুব্ধ করে। কিন্তু মিত্রশক্তি যুদ্ধে জয়লাভ করতে যাচ্ছে অনুধাবন করে অং সান জাপানের পক্ষ বদল করে ব্রিটিশদের পক্ষ অবলম্বন করেন। এ সময় অ্যান্টি ফ্যাসিস্ট পিপলস ফ্রিডম লীগ নামে নতুন একটি রাজনৈতিক দল গঠন করে রোহিঙ্গাদের মতো তিনিও মিত্রশক্তি ইংরেজদের সমর্থন দেন। যুদ্ধ শেষে স্বাধীনতার প্রশ্নে অং সানের সঙ্গে ব্রিটিশদের আলোচনা শুরু হয়। বার্মায় বর্মি ছাড়াও শান, কাচিন, চীন, কারেন ইত্যাদি আরো বহু জাতিগোষ্ঠীর অস্তিত্ব রয়েছে। ফলে অং সানকে বর্মি বিশুদ্ধবাদিতার থাকিন আন্দোলনের সঙ্গে আপস করে অন্য জাতিগোষ্ঠীর সঙ্গেও সমঝোতায় আসতে হয়। কিন্তু আরাকানি রাখাইনদের প্রবল বিরোধিতার কারণে রোহিঙ্গা মুসলমানদের আলাদা জাতিসত্তা হিসেবে আলোচনায় অংশগ্রহণের সুযোগ দেওয়া হয়নি। স্বাধীন বার্মায় রোহিঙ্গাদের স্বতন্ত্র অস্তিত্ব নিশ্চিত চ্যালেঞ্জের মুখে পড়বে জেনে রোহিঙ্গাদের একটি দল মুসলিম লীগ নেতা জিন্নাহর সঙ্গে দেখা করে মুসলিম অধ্যুষিত উত্তর আরাকানকে পূর্ব পাকিস্তানে অন্তর্ভুক্ত করার অনুরোধ করে। কিন্তু অং সান জিন্নাহকে আশ্বস্ত করেন যে স্বাধীন বার্মা সব মুসলমানের প্রতি সাংবিধানিকভাবে সমতা ও মর্যাদাপূর্ণ আচরণ করবে। ফলে জিন্নাহ এ বিষয়ে আর কোনো আগ্রহ দেখাননি। অং সান মোটামুটি ন্যায্যতার ভিত্তিতেই রোহিঙ্গা ইস্যুটি সমাধানের পক্ষে অবস্থান গ্রহণ করেন। কিন্তু বার্মার স্বাধীনতা লাভের আগেই তাঁর মৃত্যু হলে বিষয়টি অনিশ্চিত হয়ে পড়ে। ১৯৪৮ সালে বার্মা স্বাধীনতা লাভ করে এবং অং সানের মৃত্যুজনিত কারণে উ নু বার্মার ক্ষমতা গ্রহণ করেন। যেমন অনুমান করা হয়েছিল, বার্মা স্বাধীনতা লাভের পরও রোহিঙ্গাদের ভাগ্যবিড়ম্বনার শেষ হয়নি। বার্মার স্বাধীনতা লাভের সময় শান, কারেন, মন, চীন, কাচিন ইত্যাদি জাতি অধ্যুষিত অঞ্চলের জনগণ স্ব স্ব জাতির জন্য আলাদ স্টেট বা রাজ্য লাভ করলেও আরাকান স্টেটের মর্যদা পায়নি, বরং এটিকে আরাকান ডিভিশন হিসেবে আখ্যায়িত করা হয়। সব কিছু ভেস্তে যায় ১৯৬২ সালে, যখন জেনারেল নে উইন ক্ষমতা দখল করেন এবং দেশে সামরিক আইন জারি করেন। জান্তা সরকার ১৯৮২ সালে নাগরিকত্ব আইন সংশোধন করে রোহিঙ্গাদের নাগরিকত্বও বাতিল করে দেয়। এই বিতর্কিত নাগরিকত্ব আইন অনুযায়ী বার্মায় তিন ধরনের নাগরিকত্ব স্বীকার করা হয় এক. যেসব জাতিসত্তা ১৮২৩ সালের আগে থেকে বার্মায় স্থায়ীভাবে বসবাস করছে, সেই জাতিসত্তার সব মানুষ বার্মার পূর্ণ নাগরিক। দুই. যারা ১৮২৩ সালের পর বার্মায় এসেছে, কিন্তু ১৯৪৮ সালের সিটিজেন অ্যাক্ট অনুযায়ী নাগরিকত্ব লাভ করেছে, তারা সহযোগী নাগরিক।১৯৮২ সালে দেশটির সামরিক জান্তা সংবিধান সংশোধন করে রোহিঙ্গাদের নাগরিকত্ব কেড়ে নেয়। নতুন আইনে তাদেরকে রাষ্ট্রহীন মানুষ হিসেবে উল্লেখ করা হয় এবং তাদের ভোটের অধিকার কেড়ে নেওয়া হয়। ১৯৪৮ সালে মিয়ানমার স্বাধীনতা লাভ করে এবং স্বাধীনতার পর সেখানে রোহিঙ্গাদের কোনো সমস্যা হয়নি। সব নাগরিক সুযোগ-সুবিধাই তারা পেয়েছে। ১৯৬২ সালে মিয়ানমারে সামরিক শাসন জারি হয়। এরপর থেকেই রোহিঙ্গাদের প্রতি শুরু হয় বিমাতাসুলভ আচরণ। নিজ ভু-খণ্ডে তারা পরবাসী হয়ে যায়। নিরাপত্তা বাহিনী এমনকি রাখাইন জাতিগোষ্ঠীর কট্টরপন্থীদের হাতে তারা প্রতিনিয়ত নিপীড়নের শিকার হতে থাকে। এক পর্যায়ে তারা আশ্রয়ের খোঁজে বাংলাদেশে পাড়ি জমাতে শুরু করে।

‘মগের মুল্লুক’ বলতে জোর যার মুল্লুক তার, অরাজকতা ও দস্যুপনার যে কথা বাংলায় প্রচলিত, মিয়ানমারের মগদের বর্বরতা ও দস্যুপনা থেকেই তার উৎপত্তি। মগ দস্যুরা এতটাই বর্বর ছিল যে হত্যা, লুণ্ঠন শেষে গ্রামের পর গ্রাম আগুনে পুড়িয়ে দিত, মানুষদের ধরে নিয়ে দাস হিসেবে বিক্রি করে দিত। বাঙালি দাস বিক্রির একাধিক বাজার ছিল বার্মায়।

বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধে বাঙালিরা শরণার্থী হয়ে ভারত গিয়েছিল । ইন্দিরা গান্ধী তাদের আশ্রয়ও দিয়েছিল। আবার দেশ স্বাধীন হলে সবাই যে যার মতো ফিরে এসেছে। ভারতের অর্থনীতি ও বাংলাদেশের অর্থনীতি এক নয়। বাঙালি-মুসলমান হিন্দুদের একটি অভিন্ন সম্পর্ক রয়েছে যেটা রোহিঙ্গাদের একদম নেই। ঘরহারা, স্বজনহার, দেশহারা, রোহিঙ্গাদের চোখের জলে বিশ্বের কোনো পরাশক্তির কারো মন না গললেও বাঙালিরা এগিয়ে গেছে। প্রধানমন্ত্রী নিজেও গেছেন শরণার্থী শিবিরে। কিন্তু আবেগ যুক্তিহীন বলেই বাস্তবতা চোখে আসে দ্রুত। বাংলাদেশে বিহারীরা এখনও রয়ে গেছে। বেশ আগে যেসব রোহিঙ্গারা এসেছে তাদের পাঠানো যায়নি। ৮ লাখ মানুষকে বাংলাদেশ পাঠাতে পারবে? এদের অতীতও যে ভালো তা নয়। বহু অনাচারে তারা লিপ্ত। সংখ্যায় বেড়ে এখন তারা আবেগকে কতোটা মূল্য দেবে সেটা দেখা সময়ের ব্যাপার।

লেখক : সাংবাদিক, প্রাবন্ধিক