রোহিঙ্গা স্রোতে স্থানীয়রাই সংখ্যালঘু!

মিয়ানমারে বলপূর্বক বাস্তুচ্যুত হয়ে সীমান্ত পাড়ি দিয়ে উখিয়া-টেকনাফে আশ্রয় নিয়েছে প্রায় ১০ লাখের মতো রোহিঙ্গা। এদের এ উপস্থিতি সংখ্যা দু’উপজেলার স্থানীয় অধিবাসীদের দ্বিগুণ। ফলে নিজ দেশেই আশ্রিতদের কাছে সংখ্যালঘু হয়ে দুর্ভোগময় জীবন কাটাচ্ছেন দু’উপজেলার সাড়ে ৫ লাখ মানুষ।

এ দুর্গতির মধ্যে রয়েছে নিত্যপণ্যের বাজার দামে ঊর্ধ্বগতি, যানবাহনের ভাড়া বৃদ্ধি, পড়ালেখায় বিঘ্ন, পরিবেশ বিপর্যয়সহ নানা রোগবালাইয়ের প্রাদুর্ভাব। এরসঙ্গে যোগ হয়েছে রোহিঙ্গাদের একটি অংশের ভিক্ষাবৃত্তি। ফলে সীমান্ত উপজেলা দুটির স্থানীয় জনজীবন বিপর্যস্ত হয়ে পড়েছে। ছন্দপতন ঘটেছে স্বাভাবিক জীবন যাত্রায়।

গত আগস্টের ২৫ তারিখ থেকে বাংলাদেশে নতুন করে রোহিঙ্গা অনুপ্রবেশ হয়। কুরবানি ঈদের রাত থেকে বানের স্রোতে রূপ নেয় তা। এরপর রাস্তা, পাহাড়, বিল সবখানে একটি বিশৃংখল পরিস্থিতির সৃষ্টি করে কয়েক লাখ রোহিঙ্গার উপস্থিতি। বাংলাদেশে ত্রাণ সুবিধা পাওয়ার খবর ওপারে পৌঁছানোর কারণে সীমান্ত পেরিয়ে রোহিঙ্গা আসা কমছে না বলে স্থানীয়দের অভিমত।

এদিকে পথে প্রান্তরে অবস্থান নেয়া সব রোহিঙ্গাদের ক্যাম্পে অবস্থান নিশ্চিত করার পর ক্যাম্পগুলোতেই গড়ে উঠেছে অস্থায়ী বাজার। এখানে বিক্রেতা ও ক্রেতা সবাই রোহিঙ্গা।

শুক্রবার এমন দুটি বাজার ঘুরে দেখা যায়, স্বাভাবিকের চেয়ে প্রায় দেড়গুণ দামে জিনিসপত্র বিক্রি হচ্ছে। রোহিঙ্গা ক্যাম্পের বাইরে কুতুপালং, উখিয়া ও কোটবাজার এলাকায় পণ্যের ঊর্ধ্বমূখী প্রবণতা লক্ষ্য করা গেছে। স্থানীয়ভাবে উৎপাদিত এসব নিত্যপণ্যই চড়া দামে বিক্রি হচ্ছে।

স্থানীয় বাজারগুলো ঘুরে দেখা গেছে, প্রতি কেজি শসা ৫০টা, ঢেড়স ৭০ টাকা, কাচামরিচ ২০০ টাকা, আলু ৪০, করল্লা ৬০, বরবটি ৪৫, ঝিঙা ৪৫, মুলা ৬০, বেগুন ৬০, পিয়াজ ৫৫, রসুন ১০০, প্রতি আটি কলমি শাক ১৫ টাকা, পাটশাক ১০ টাকা দরে বিক্রি হচ্ছে।

স্থানীয়রা জানান, রোহিঙ্গা স্রোতের পর থেকে বাড়তে শুরু করে নিত্যপণ্যের দাম। মূলত এক শ্রেণির অসাধু ব্যবসায়ীরাই পণ্যের দাম বাড়াচ্ছেন বলে অভিযোগ তাদের।

অপরদিকে কক্সবাজার থেকে উখিয়া হয়ে টেকনাফ রোডের ভাড়া এখন প্রায় দ্বিগুন। কুতুপালং বাজার থেকে উখিয়া সদর পর্যন্ত আগে ব্যাটারিচালিত ইজিবাইকগুলোতে জনপ্রতি ১০ টাকা করে নেয়া হতো। এখন নেয়া হয় জনপ্রতি ২০ টাকা। কক্সবাজার থেকে উখিয়া পর্যন্ত সিএনজি রিজার্ভ ভাড়া ছিল ৪০০ টাকা। কিন্তু সেটি এখন ৫০০-৬০০ টাকায় গিয়ে ঠেকেছে।

স্থানীয় স্কুল কলেজের বেশ কয়েকটিতে সরকারি বিভিন্ন সংস্থা ও প্রতিষ্ঠান ত্রাণ কার্যক্রমের জন্য ব্যবহার করছে। বন্ধ ঘোষণা না করা হলেও উপস্থিতি অনেক কম। উখিয়া কলেজে সেনাবাহিনী ও বিজিবির কিছু কার্যক্রম চলছে। এর মধ্যে সেনাবাহিনী একটি পরিত্যক্ত ভবনে কাজ করছে আর বিজিবি কিছু ক্লাসরুম ব্যবহার করে ত্রাণসহ রোহিঙ্গাদের জন্য অন্যান্য মানবিক সহায়তা দিচ্ছে।

নতুন করে আসা রোহিঙ্গাদের জন্য সরকার যে তিন হাজার একর জমি নির্ধারণ করে দিয়েছে, তার মধ্যে মধুরছড়ার পাহাড়ও রয়েছে। অনেক আগে থেকেই স্থানীয় বাসিন্দারা (বাংলাদেশি) সরকারি বনভূমি দখল করে বসতি গড়ে তুলেছিল। কিন্তু রোহিঙ্গাদের বসতির জন্য এখন প্রায় হারিয়েই গেছে তারা। কিছু বুঝে ওঠার আগেই হঠাৎ লাখো মানুষের বসতি গড়ে ওঠায় স্থানীয়দের দুঃখ ও আফসোসের শেষ নেই। কারণ বন বিভাগের জমি হলেও যুগ যুগ ধরেই তাদের দখলে ছিল এই পাহাড়ি এলাকা।

মধুরছড়ায় প্রায় দুই যুগ ধরে আছেন জমির উদ্দিন। স্ত্রী, পাঁচ মেয়ে, দুই ছেলে নিয়ে তার সংসার। তিনি বলেন, এ মধুরছড়া আবাদ করে গোলা ভরে যেত ধানে। ছিল গরু ও মহিষ। রোহিঙ্গাদের বসতি সব কেড়ে নিয়েছে। আমার পাঁচ একর জমি ছিল। এখন সবখানে রোহিঙ্গাদের বসতি। এই বসতি গড়ার কারণে আমার ভবিষ্যত শেষ হয়ে গেছে।

সৈয়দ আকবর নামের স্থানীয় এক যুবক বলেন, রোহিঙ্গারা এসে শুধু বসতি নয়, গাছ গাছালি কেটে সাবাড় করে ফেলেছে। পাহাড়ের মাটি কাটার পাশাপাশি বিভিন্ন প্রজাতির গাছের মূল ও শেকড় তুলে ফেলেছে। একের পর এক পাহাড় কেটে ন্যাড়া করছে। তাদের কাছে বনবিভাগও যেন অসহায়।

জমিরদের মতো জমি হারিয়েছেন মধুরছড়া গ্রামের প্রায় এক হাজার ২০০ পরিবার। এই জমিতেই ফসল ফলিয়ে দিন চলতো তাদের। এখন তারা অসহায়। রোহিঙ্গারা মানবিক সহায়তায় ত্রাণ পেলেও রোহিঙ্গাদের কারণে নিঃশ্ব হওয়া স্থানীয় লোকজন কোনো সহযোগিতার আওতায়ও আসছে না। ফলে আগামী দিনগুলো না খেয়ে মরতে হবে এই আশঙ্কায় আছেন তারা।

এদিকে গত ১৫ অক্টোবর কক্সবাজার জেলা উন্নয়ন সমন্বয় কমিটির সভায় প্রধান অতিথির বক্তব্যে এমপি আবদুর রহমান বদি সীমান্তের দু’উপজেলায় স্থানীয়রা এখন সংখ্যালঘু বলে উল্লেখ করেন। তিনি বলেন, ক্যাম্পে চাকরির ক্ষেত্রে ৮০ শতাংশ স্থানীয়দের অগ্রাধিকার দিতে হবে। কারণ এখানকার মানুষ নিজেদের অসুবিধায় ফেলেই নিপীড়িত রোহিঙ্গাদের আশ্রয় দিয়েছে। এতে স্বাভাবিক চলাফেরাসহ নিত্য প্রয়োজনীয় পণ্যের অধিক মূল্য গুনতে হচ্ছে এখানকার অধিবাসীদের। এ কারণে অনেক নিম্ন-মধ্যবিত্ত পরিবারে এখন আর্থিকসহ নানা সংকট দেখা দিয়েছে।

পালংখালী ইউনিয়নের চেয়ারম্যান এম গফুর উদ্দিন চৌধুরী বলেন, রোহিঙ্গা সমস্যা আন্তর্জাতিক। কিন্তু মানবিকতার কারণে অনেক ভোগান্তি সহ্য করছেন স্থানীয় বাসিন্দারা। আমার ইউনিয়নে স্থায়ী বাসিন্দার সংখ্যা যেখানে ৫০ হাজার সেখানে ৩-৪ লাখ রোহিঙ্গা অবস্থান নেয়ার পর কী ধরনের সমস্যাা হতে পারে তা আন্দাজ করতে পারেন।

তিনি বলেন, আমার ইউনিয়নের প্রতিটি শিক্ষা প্রতিষ্ঠান এখন বন্ধ। কিছুদিন পরই পিএসসি, জেএসসি, এসএসসি, এইচএসসি, দাখিলসহ নানা পাবলিক পরীক্ষা। শিক্ষা প্রতিষ্ঠান বন্ধ থাকা ও পড়াশোনার স্বাভাবিক পরিবেশ বিঘ্নিত হওয়ায় তাদের পরীক্ষায় অংশগ্রহণ নিয়ে আশংকা তৈরি হয়েছে। অন্যদিকে বিপুল সংখ্যক রোহিঙ্গা অনুপ্রবেশের কারণে নিত্যপণ্য ও গাড়ি ভাড়া দিন দিন বৃদ্ধি পাচ্ছে।

একই সমস্যার কথা জানালেন রাজাপালং ইউপি চেয়ারম্যান ও উপজেলা আওয়ামী লীগ সাধারণ সম্পাদক জাহাঙ্গীর কবির চৌধুরী। তিনি বলেন, আমার ইউনিয়নের কুতুপালং ওয়ার্ড়ে পূর্ব এবং নতুন মিলে ৩ থেকে ৫ লাখ রোহিঙ্গা অবস্থান করছে।

কক্সবাজারের জেলা প্রশাসক মো. আলী হোসেন বলেন, বাস্তুচ্যুত রোহিঙ্গাদের মানবিক কারণে আশ্রয় দিতে গিয়ে স্থানীয়রা নানা ভাবে দুর্ভোগে পড়েছে এটা ঠিক। ধীরে ধীরে সব সমস্যা সমাধান করতে কাজ করছে সরকার।