লিজে আনা বোয়িং ফেরতের উপায় খুঁজছে বিমান

মিসরের ইজিপ্ট এয়ার থেকে ড্রাই লিজে আনা দুটি বোয়িং ৭৭৭-২০০ ইআর উড়োজাহাজ ফেরত দেয়ার উদ্যোগ নিয়েছে বিমান বাংলাদেশ এয়ারলাইনস। ইঞ্জিন নষ্টের কারণে দীর্ঘদিন গ্রাউন্ডেড থাকায় চুক্তির মেয়াদ শেষ হওয়ার আগেই উড়োজাহাজ দুটির ফেরত প্রক্রিয়ায় সহায়তা করতে পরামর্শক খুঁজছে রাষ্ট্রায়ত্ত সংস্থাটি।

অনেক আগে থেকেই বিমানের জন্য গলার কাঁটা হয়ে দাঁড়িয়েছে উড়োজাহজ দুটি। প্রায় দুই বছর ইঞ্জিন নষ্টের কারণে গ্রাউন্ডেড থাকে একটি উড়োজাহাজ। দীর্ঘদিন পর সানফ্রানসিসকো থেকে দুটি ইঞ্জিন এনে বিমানটি চালু রাখা হয়। সবার প্রত্যাশা ছিল, দীর্ঘদিন গ্রাউন্ডেড থাকার ক্ষতি পুষিয়ে নিতে তৎপর হবে বিমান কর্তৃপক্ষ। কিন্তু সেটি না করে উল্টো চুক্তির মেয়াদ শেষ হওয়ার আগেই উড়োজাহাজ দুটি ফেরতের সহায়তা করতে পরামর্শক খুঁজছে বিমান বাংলাদেশ এয়ারলাইন্স।

বিমান সূত্রে জানা যায়, ইঞ্জিন ইন্সটল করে উড়োজাহাজ দুটি ফেরত দেয়ার তোড়জোড় শুরু হয়েছে। ফেরত দিতে পরামর্শক নিয়োগের জন্য গত ২৯ আগস্ট বিমান বাংলাদেশ এয়ারলাইন্স আন্তর্জাতিক দরপত্র আহ্বান করেছে। সর্বনিম্ন খরচে লিজের চুক্তি পর্যবেক্ষণ করে উড়োজাহাজ দুটি ফেরত দেবে পরামর্শক প্রতিষ্ঠান। এজন্য প্রতিষ্ঠানটির উড়োজাহাজ ফেরত দেয়া কাজের চার বছরের অভিজ্ঞতা চেয়েছে বিমান।

এছাড়া বিমানের সঙ্গে চুক্তি সম্পাদনের পর পরামর্শক প্রতিষ্ঠান পাঁচ মাস সময় পাবে লিজের শর্ত পর্যবেক্ষণ ও কাগজপত্র বিশ্লেষণের জন্য। তিন মাস সময় পাবে উড়োজাহাজ ফেরত দেয়ার কাগজপত্র তৈরি ও উড়োজাহাজ নিরীক্ষণের। ৪৫ দিন সময় পাবে রিডেলিভারি সি চেক করার।

সংশ্লিষ্টরা বলছেন, এ প্রক্রিয়া চালাতে যে সময় লাগবে ততদিন অপারেশনে থাকলে এই উড়োজাহাজ থেকে কিছুটা হলেও ক্ষতি পুষিয়ে নেয়া যেত।

বিমান সূত্র জানায়, মিসরের ইজিপ্ট এয়ার থেকে ড্রাই লিজে আনা দুটি বোয়িং ৭৭৭-২০০ ইআর উড়োজাহাজ বিমানবহরে যুক্ত হয় ২০১৪ সালের মার্চে। পাঁচ বছরের চুক্তিতে আনা উড়োজাহাজ দুটির চারবার ইঞ্জিন মেরামত করতে হয়েছে বিমানকে।

বর্তমানে উড়োজাহাজ দুটি সচল থাকলেও বিভিন্ন সময়ে যান্ত্রিক ত্রুটির কারণে উড়োজাহাজ দুটি দীর্ঘদিন ধরে গ্রাউন্ডেড ছিল। ফের যান্ত্রিক ত্রুটি দেখা দেয়ার আগেই উড়োজাহাজ দুটি ফেরত দেয়ার সিদ্ধান্ত নিয়েছে বিমান কর্তৃপক্ষ।

জানা গেছে, লিজে আনা উড়োজাহাজ দুটিতে বারবার যান্ত্রিক ত্রুটি দেখা দেয়ায় চলতি বছরের মার্চ পর্যন্ত বিমান বাংলাদেশ এয়ারলাইনসের ক্ষতি হয়েছে ৩০৫ কোটি ৩৩ লাখ টাকা।

প্রসঙ্গত, ২০১৪ সালের মার্চে মিসরের ইজিপ্ট এয়ার থেকে লিজে আনা প্রথম উড়োজাহাজটি (রেজিস্ট্রেশন নম্বর এস২-এএইসএল, কনস্ট্রাকশন নং ৩২৬৩০) বিমানের বহরে যু্ক্ত হয়। অপরটি (রেজিস্ট্রেশন নম্বর এস২-এএইসকে, কনস্ট্রাকশন নং ৩২৬২৯) যুক্ত হয় একই বছর মে মাসে। চুক্তি অনুযায়ী, যাত্রী পরিবহন করুক আর না করুক মাসে উড়োজাহাজপ্রতি পাঁচ লাখ ৮৫ হাজার ডলার (চার কোটি ৭০ লাখ ১৬ হাজার টাকা) ভাড়া দিতে হবে। সব ধরনের রক্ষণাবেক্ষণ ব্যয় বহন করতে হবে। পাঁচ বছরের আগে চুক্তি বাতিল করতে পারবে না বিমান। লিজের মেয়াদ শেষে উড়োজাহাজ দুটি আগের অবস্থায় (ভাড়া নেয়ার সময় যে অবস্থায় ছিল) ফেরত দিতে হবে।

বিমান সূত্রে আরও জানা যায়, ২০১৪ সালে বিমান বহরে যু্ক্ত হওয়ার এক বছর পরই ড্রাই লিজে আনা বোয়িং ৭৭৭-২০০ উড়োজাহাজটির (রেজিস্ট্রেশন নং এস২-এএইসএল) একটি ইঞ্জিন বিকল হয়। পরবর্তীতে ইজিপ্ট এয়ার থেকে প্রতি মাসে প্রায় আট লাখ টাকায় (১০ হাজার ডলার) ভাড়ায় ইঞ্জিন এনে উড়োজাহাজটি সচল রাখা হয়। নষ্ট ইঞ্জিনটি মেরামতের জন্য পাঠানো হয় লন্ডন ভিত্তিক ইউনাইটেড এয়ারলাইন্সে। ইঞ্জিনটি মেরামত করে ফেরত আনার আগেই তিন বছরের মাথায় আবারও নষ্ট হয় ইঞ্জিন। তখন ইজিপ্ট এয়ার থেকে প্রতি মাসে প্রায় আট লাখ টাকায় (১০ হাজার ডলার) ভাড়ায় আনা হয় আরেকটি ইঞ্জিন। বিকল ইঞ্জিনটি মেরামতের জন্য পাঠানো হয় ইউনাইটেড এয়ারলাইনসের কাছে।

চলতি বছর আগস্টে উড়োজাহজটি বারবার গ্রাউন্ডেড হওয়ার কারণ খুঁজতে একটি কমিটি গঠন করে বেসামরিক বিমান পরিবহন ও পর্যটন মন্ত্রণালয়। সূত্র জানায়, লিজচুক্তির প্রায় সব শর্তই বিমানের স্বার্থপরিপন্থী ছিল। বিমানের একটি অংশ নতুন উড়োজাহাজ কেনার পরিবর্তে লিজে উড়োজাহাজ সংগ্রহে আগ্রহ দেখায়। মন্ত্রণালয় উড়োজাহাজ দুটি লিজদাতা প্রতিষ্ঠানকে ফেরত দেয়ারও সুপারিশ করে।

এ বিষয়ে জানতে চাইলে বিমানের ব্যবস্থাপনা পরিচালক ও সিইও এএম মোসাদ্দিক আহমেদবলেন, উড়োজাহাজ দুটি পাঁচ বছরের জন্যে লিজে আনা হলেও চার বছরের মাথায় ফেরত দেয়ার পরিকল্পনা নিয়েছে বোর্ড। এতে আর্থিক ক্ষতির পরিমাণ কিছুটা হলেও কমবে।

বিমানের প্রকৌশল বিভাগের এক কর্মকর্তা বলেন, বিমানের স্বার্থসংশ্লিষ্ট বিষয় বিবেচনা না করে চুক্তি করায় লিজে আনা উড়োজাহাজ দুটি বিমানের জন্য গলার কাঁটা হয়ে দাঁড়িয়েছে। ২০১৪ সালের মার্চে তৎকালীন পরিচালনা পর্ষদ চেয়ারম্যান এয়ার মার্শাল (অব.) জামাল উদ্দিনের ইচ্ছায় উড়োজাহাজ দুটি আনা হয়।

প্রকৌশল বিভাগের ওই কর্মকর্তা আরও বলেন, বিমানের স্বার্থ না দেখে চুক্তি করা হয়েছিল। ফলে বিমান এখন উভয় সঙ্কটের মধ্যে পড়েছে। উড়োজাহাজ না চললেও সচল করে ফেরত দিতে হবে। এতে বিরাট অংকের টাকা ব্যয় হবে। অন্যদিকে চুক্তির নির্ধারিত সময় শেষ হবার আগে সহজে ফেরতও দেয়া যাবে না। এ কারণে বিদেশি পরামর্শক প্রতিষ্ঠানের খোঁজ করা হচ্ছে, যারা চুক্তির শর্ত বিশ্লেষণ করে ফেরত দেয়ার উপায় বের করে বিমানকে সহায়তা করবে।