লেজেগোবরে জামায়াত : এবার দল ছাড়ছেন স্বয়ং আমীন!

সংস্কার ইস্যুতে জামায়াতের সহকারী সেক্রেটারি জেনারেল ব্যারিস্টার আবদুর রাজ্জাকের পর, এবার দল ছাড়ছেন স্বয়ং আমির মকবুল আহমদ। রোববার দুপুরে দলীয় সূত্রে এ তথ্য জানা যায়।

মূলত সংস্কার ইস্যুতে তালগোল পাকিয়ে ফেলেছে মুক্তিযুদ্ধের বিরোধিতা করা এ সংগঠনটি। বিভিন্ন পর্যায়ের একাধিক নেতার সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, একাত্তরের মুক্তিযুদ্ধে জামায়াতের ভূমিকা নিয়ে ক্ষমা চাওয়া ও না চাওয়ার ইস্যুতে দ্বিধাবিভক্ত দলটির কেন্দ্রীয় নেতৃত্ব। এ নিয়ে দলটিতে অস্থিরতা বিরাজ করছে। দীর্ঘদিন ধরেই বিরাজ করছে এ অস্থিরতা। শুক্রবার দলটির সহকারী সেক্রেটারি জেনারেল ব্যারিস্টার আবদুর রাজ্জাকের পদত্যাগ করার মধ্য দিয়ে তা প্রকাশ্য রূপ নেয়।

পরিস্থিতি এমন পর্যায়ে পৌঁছেছে খোদ আমিরে জামায়াত মকবুল আহমদ আর স্বপদে থাকতে চাইছেন না। একাত্তরের ভূমিকার জন্য ক্ষমা চাওয়া ও দল বিলুপ্তি ইস্যুতে সেক্রেটারি জেনারেল ডা. শফিকুর রহমানের সঙ্গে তারও মতবিরোধ চরমে। শনিবার দিনাজপুরের এক নেতার স্বেচ্ছা পদত্যাগ এবং জামায়াতের কেন্দ্রীয় মজলিশে শূরার সদস্য মজিবুর রহমান মঞ্জুকে বহিষ্কার করার ঘটনায় দলের অভ্যন্তরীণ তালগোলের চিত্র আরও ফুটে উঠেছে। সংস্কার ইস্যুতে শিগগিরই দলের অনেকেই পদত্যাগ করতে পারেন বলেও শোনা যাচ্ছে।

জামায়াত নেতারা বলছেন, এ রকম সংকট ও অগোছালো অবস্থায় জামায়াত আর কখনও পড়েনি। দলটিকে বহু চড়াই-উতরাই পেরোতে হয়েছে; কিন্তু এবারের মতো সংকটকাল আর আসেনি। দলের ভেতরে সংস্কারের দাবি বহুবার উঠলে এবারের মতো বিস্ফোরণ আগে কখনও ঘটেনি। এ জন্য জামায়াত ঘনিষ্ঠ অনেকে বর্তমান নেতৃত্বের অদূরদর্শিতাকে দায়ী করছেন।

গত কয়েক বছরে জামায়াতের প্রথম সারির প্রায় সব নেতাকে কারাবরণ করতে হয়েছে। মানবতাবিরোধী অপরাধে অনেকের প্রাণদণ্ড কার্যকর হয়েছে। কারও কারও যাবজ্জীবন হয়েছে। নাশকতার মামলায় কেন্দ্র থেকে তৃণমূল পর্যন্ত বহু নেতার বিরুদ্ধে মামলা ও কারাদণ্ড হয়েছে। সেই জটিল পরিস্থিতিতেও জামায়াত ঐক্যবদ্ধ থেকেছে। নেতৃত্বের প্রতি অনুগত থেকেছে জামায়াত।

মূলত জামায়াতের নেতৃ্ত্ব ও নানা ইস্যুতে সংকট শুরু হয় মূলত গত কাউন্সিলের পর থেকে। গোপনে করা ওই কাউন্সিলের আমির নির্বাচিত হন মকবুল আহমদ ও সেক্রেটারি জেনারেল শফিকুর রহমান। পরে তাদের নেতৃত্বের দূরদর্শিতা ও সিদ্ধান্ত গ্রহণে সমন্বয়হীনতা নিয়ে প্রশ্ন ওঠে তৃণমূলে।

একাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচন ও নির্বাচনের আগে সংগঠন হিসেবে জামায়াতের সক্রিয়তা নিয়েও প্রশ্ন ওঠে। সেই বিতর্ক শেষ না হতেই নতুন নামে জামায়াতের রাজনীতি শুরু করার বিতর্কটি চলে আসে। এরই মধ্যে পদত্যাগের সিদ্ধান্ত নেন প্রায় তিন দশক ধরে জামায়াতের গুরুত্বপূর্ণ পদে থাকা ব্যারিস্টার আবদুর রাজ্জাক। তার পদত্যাগকে জামায়াতের জন্য অনেক বড় ধাক্কা হিসেবে দেখছেন দলটির নেতাকর্মীরা। রাজ্জাকের পদত্যাগের পর দিনই শিবিরের সাবেক সভাপতি মুজিবর রহমান মঞ্জুর বহিষ্কারের সিদ্ধান্তে জামায়াতের টালমাটাল অবস্থা প্রকাশ পায়। সংস্কার দাবির ইস্যু চাপা দিতে জামায়াতের একটি অংশ যে তৎপর সেটি প্রকাশ পায় এসব সিদ্ধান্তে।

এসব বিষয়ে জানতে জামায়াতের আমির মকবুল আহমদ ও সেক্রেটারি জেনারেল ডা. শফিকুর রহমানের সঙ্গে নানাভাবে যোগাযোগের চেষ্টা করেও পাওয়া যায়নি। তবে দল থেকে বহিষ্কার হওয়ার পর জামায়াতে ইসলামীর কেন্দ্রীয় মজলিসে শূরার সদস্য মজিবুর রহমান মঞ্জু শনিবার তার ফেসবুক স্ট্যাটাসে বলেন, জামায়াতে রাজনৈতিক সংস্কারের যৌক্তিকতা, ১৯৭১ সালের মহান স্বাধীনতাযুদ্ধে ভূমিকা প্রসঙ্গে আমার সুস্পষ্ট মত ছিল যে, জামায়াতে প্রয়োজনীয় সংস্কার না হলে বাংলাদেশের রাজনীতিতে জামায়াতের ভবিষ্যৎ অন্ধকার। আমার এ রূপ খোলামেলা মত নিয়ে জামায়াতের সম্মানিত নেতাদের মধ্যে বিব্রতকর পরিস্থিতি তৈরি হয়।

সংস্কার ইস্যুতে দলে বিভক্তি প্রকাশ্য হওয়ায় বিব্রত জামায়াতে ইসলামীর আমির মকবুল আহমদ। তার একজন ঘনিষ্ঠজন (নাম প্রকাশে অনেচ্ছুক) জানান, বিব্রত হওয়ার বিষয়টি দলের আমির আমাদের কয়েকজনকে জানিয়ে বলেছেন, তার বয়স হয়েছে। এই বয়সে এসে দলের মধ্যে এমন পরিস্থিতির মোকাবেলা করতে হবে তা তিনি আসা করেননি। তাই আমির পদে তিনি আর থাকতে চাইছেন না। তিনি জামায়াতের সদস্য পদে থাকতেই স্বস্তিবোধ করছেন না।

মুক্তিযুদ্ধকালীন ভূমিকার জন্য ক্ষমা চাওয়া এবং নতুন নামে দল গঠন নিয়েই মূলত জামায়াতে মতভেদ দেখা দিয়েছে। ব্যারিস্টার আবদুর রাজ্জাক শুক্রবার পদত্যাগপত্রে দাবি করেছেন, স্বাধীনতাবিরোধী ভূমিকার জন্য ক্ষমা চাইতে তিনি জামায়াতকে একাধিকবার পরামর্শ দিয়েছিলেন।

যুদ্ধাপরাধে অভিযুক্ত দল জামায়াত নিষিদ্ধ করার বিষয়ে যখন জোর আলোচনা চলছে এবং পরিবর্তিত পরিস্থিতিতে জামায়াত যখন নাম পরিবর্তন করে নতুন নামে রাজনীতি শুরু করার চিন্তা করছে, তখন দলটির এই জ্যেষ্ঠ নেতার পদত্যাগের খবর এলো। ব্যারিস্টার রাজ্জাক মানবতাবিরোধী অপরাধের মামলায় জামায়াত নেতাদের প্রধান কৌঁসুলি ছিলেন।

জামায়াতের রাজনীতি থেকে বিদায় নেয়ার পেছনে ব্যারিস্টার রাজ্জাক বেশ কয়েকটি কারণ উল্লেখ করেছেন। একাত্তরের ভূমিকার জন্য দলটির ক্ষমা না চাওয়া, দলটির নাম পরিবর্তন না করার বিষয়ে শীর্ষ নেতাদের অনড় অবস্থান, সময়ের সঙ্গে সঙ্গে নিজেদের সংস্কার করতে না পারাসহ বিভিন্ন কারণ উল্লেখ করেন তিনি।

দল বিলুপ্ত ও ১৯৭১ সালের মুক্তিযুদ্ধে ভূমিকার জন্য জাতির কাছে আন্তরিকভাবে ক্ষমা চাওয়ার পরামর্শ দিয়েছেন তিনি।

জামায়াতের রাজনীতি থেকে বিদায় নেয়ার পেছনে ব্যারিস্টার রাজ্জাক বেশ কয়েকটি কারণ উল্লেখ করেছেন। একাত্তরের ভূমিকার জন্য দলটির ক্ষমা না চাওয়া, দলটির নাম পরিবর্তন না করার বিষয়ে শীর্ষ নেতাদের অনড় অবস্থান, সময়ের সঙ্গে সঙ্গে নিজেদের সংস্কার করতে না পারাসহ বিভিন্ন কারণ উল্লেখ করেন তিনি।

পদত্যাগপত্রে ব্যারিস্টার রাজ্জাক বৈশ্বিক রাজনীতির বাস্তবতা ও একাত্তরে দলের ভূমিকা নিয়ে বর্তমানে যে প্রভাব, তা তুলে ধরেছেন দলের আমিরের কাছে। তিনি লিখেছেন- জামায়াতে যোগ দেয়ার পর থেকে তিনি দলের ভেতর থেকে সংস্কারের চেষ্টা করার সিদ্ধান্ত নিয়েছিলেন। তিন দশক ধরে তিনি সে চেষ্টাই করে গেছেন। কিন্তু জামায়াত তার কথা শোনেনি। তাই তিনি হতাশ। এমতাবস্থায় পদত্যাগের পথ বেছে নিয়েছেন।

একাত্তরের ভূমিকার জন্য ক্ষমা না চাওয়ার বিষয়টি উল্লেখ করে চিঠিতে ব্যারিস্টার রাজ্জাক লেখেন- স্বাধীনতার ৪৭ বছর পর আজও দলের নেতারা ‘৭১-এর ভূমিকার জন্য ক্ষমা চাইতে পারেনি। এমনকি মহান স্বাধীনতাযুদ্ধ প্রসঙ্গে দলের অবস্থানও জাতির সামনে ব্যাখ্যা করতে পারেনি।

পদত্যাগপত্রে বলেন, গত প্রায় তিন দশক তিনি জামায়াতকে বোঝানোর চেষ্টা করেছেন যে, ‘৭১-এ দলের ভূমিকা নিয়ে খোলামেলা আলোচনা হওয়া উচিত এবং ওই সময়ে জামায়াতের ভূমিকা ও পাকিস্তান সমর্থনের কারণ উল্লেখ করে জাতির কাছে ক্ষমা চাওয়া উচিত।

ব্যারিস্টার রাজ্জাক মনে করেন উপমহাদেশে জামায়াতের রাজনীতির ঐতিহ্য প্রশংসার দাবি রাখে। দলটি ‘৬০-এর দশকে সব সংগ্রামে যেমন অংশ নিয়েছে, তেমনি ‘৮০-র দশকে আট দল, সাত দল ও পাঁচ দলের সঙ্গে যুগপৎভাবে গণতান্ত্রিক সংগ্রামে অংশ নিয়েছে। কিন্তু জামায়াতের এসব অবদান একটি ভুলের জন্য গণমানুষের কাছে স্বীকৃতি পায়নি। ‘৭১-এ বাংলাদেশের স্বাধীনতা সংগ্রামে তখনকার নেতাদের ভুল রাজনৈতিক ভূমিকার কারণে জামায়াত অনেক ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। মুক্তিযুদ্ধের বিরোধিতা পরবর্তীকালে জামায়াতের সব সাফল্য ও অর্জন ম্লান করে দিয়েছে বলে মনে করেন রাজ্জাক।

একাত্তরের বিতর্কিত ভূমিকার জন্য ওই সময়কার নেতাদের পক্ষ থেকে জামায়াতকে ক্ষমা চাওয়ার পরামর্শ দিয়ে যুদ্ধাপরাধ ট্রাইব্যুনালে জামায়াত নেতাদের পক্ষের এ কৌঁসুলি চিঠিতে উল্লেখ করেন, ‘অতীতের যে কোনো সময়ের তুলনায় এখন ‘৭১-এ মুক্তিযুদ্ধ চলাকালে জামায়াতের ক্ষতিকর ভূমিকা সম্পর্কে ভুল স্বীকার করে জাতির সঙ্গে সেই সময়ের নেতাদের পক্ষ থেকে ক্ষমা চেয়ে পরিষ্কার অবস্থান নেয়া জরুরি হয়ে পড়েছে।’

ব্যারিস্টার রাজ্জাক যে বারবার মুক্তিযুদ্ধ ইস্যুতে সেই সময়কার দলীয় ভুল সিদ্ধান্তের জন্য দলের নেতাদের ক্ষমা চাইতে বলেছেন, সেটি পদত্যাগপত্রে উল্লেখ করেছেন। এ প্রসঙ্গে চিঠিতে তিনি লেখেন- ‘২০০১ সালে জামায়াতের সেই সময়ের আমির (মতিউর রহমান নিজামী) এবং সেক্রেটারি জেনারেল (আলী আহসান মোহাম্মদ মুজাহিদ) মন্ত্রী হওয়ার পর বিজয় দিবসের আগেই ১৯৭১ নিয়ে বক্তব্য দেয়ার জন্য তিনি পরামর্শ দিয়েছিলেন। তখন একটি কমিটি এবং বক্তব্যের খসড়াও তৈরি হয়েছিল। কিন্তু সেটি আর আলোর মুখ দেখেনি।’

দলীয় ফোরামে এ বিষয়ে নিজের অবস্থান বারবার পরিষ্কার করেছেন জানিয়ে ব্যারিস্টার রাজ্জাক বলেন, ‘২০০৫ সালে কেন্দ্রীয় কর্মপরিষদের বৈঠকেও তিনি প্রসঙ্গটি উত্থাপন করেন এবং ২০০৭-০৮ সালে জরুরি অবস্থার সময়েও তিনি জামায়াতকে বোঝানোর চেষ্টা করে ব্যর্থ হন।’

তিনি জানান, পরে ২০১১ সালে মজলিসে শূরার সবশেষ প্রকাশ্য অধিবেশনেও তিনি বিষয়টি তুলে ধরেন। কিন্তু দলের শীর্ষ নেতাদের একাংশের অবহেলায় তার প্রস্তাব নাকচ হয় বলে উল্লেখ করেন পদত্যাগপত্রে।

বর্তমান আমিরে জামায়াতকেও একই ইস্যুতে বক্তব্য দেয়ার অনুরোধ করেন রাজ্জাক। এমনকি মুক্তিযুদ্ধে বিতর্কিত ভূমিকা নিয়ে জাতির কাছে দলের পক্ষ থেকে ক্ষমা চেয়ে একটি খসড়া বক্তব্য লিখে আমিরে জামায়াতকে দেন তিনি। এমনটি জানিয়ে পদত্যাগপত্রে ব্যারিস্টার রাজ্জাক লেখেন- ২০১৬ সালের ১৯ মার্চ বর্তমান আমির মকবুল আহমদকেও চিঠি পাঠিয়ে ১৯৭১ প্রসঙ্গে বক্তব্য দেয়ার প্রস্তাব করি।২০১৬ সালের নভেম্বরে আমার মতামত চাইলে আমি এ বিষয়ে জাতির কাছে ক্ষমা চাওয়া সংক্রান্ত একটি খসড়া বক্তব্য লিখে পাঠাই আমিরে জামায়াতকে। কিন্তু সেটিও আর বাস্তবায়িত হয়নি।

সবশেষ তিনি জামায়াতকে বিলুপ্ত করার পরামর্শ দেন জানিয়ে ব্যারিস্টার রাজ্জাক জানান, ৩০ ডিসেম্বরের একাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনের পর জানুয়ারি মাসে জামায়াতের করণীয় সম্পর্কে তার মতামত চাওয়া হয়। তখন তিনি যুদ্ধকালীন জামায়াতের ভূমিকা সম্পর্কে দায়দায়িত্ব গ্রহণ করে ক্ষমা চাওয়ার পরামর্শ দেন। অন্য কোনো বিকল্প না পেয়ে এবং মতামতের সাড়া না পেয়ে জামায়াত বিলুপ্ত করে দেয়ার পরামর্শ দেন দলীয় নেতাদের।

জামায়াত তার পরামর্শ গ্রহণ না করায় আক্ষেপ করে ব্যারিস্টার রাজ্জাক লেখেন- অত্যন্ত পরিতাপের বিষয় আমার তিন দশকের সব প্রচেষ্টা ব্যর্থ হয়েছে। ‘বিগত ৩০ বছর আমির সেই চেষ্টাই করেছি। আমি কাঠামোগত সংস্কার ও নারীর কার্যকর অংশগ্রহণের পক্ষে ছিলাম। ২০১৬ সালে চিঠি দিয়ে অভ্যন্তরীণ সংস্কারের ওপর সর্বোচ্চ গুরুত্ব দিয়েছি। অন্য মুসলিম দেশগুলোর উদাহরণ দিয়েছি। কিন্তু কোনো ইতিবাচক সাড়া পাইনি’-লেখেন রাজ্জাক।

পদত্যাগপত্রে ব্যারিস্টার রাজ্জাক উল্লেখ করেন যে, দেশের ধর্মনিরপেক্ষ সংবিধান মেনে ইসলামী মূল্যবোধের ভিত্তিতে জামায়াতকে একটি গণতান্ত্রিক দল গড়ে তোলা এখন সময়ের দাবি। কিন্তু সে দাবি অনুযায়ী জামায়াত নিজেকে এখন পর্যন্ত সংস্কার করতে পারেনি। এটিকে জামায়াতের একটি ব্যর্থতা বলে উল্লেখ করেন তিনি।

তবে জামায়াতে সংস্কারের ইস্যুটি এর আগেও উঠে আসে বারবার। মৃত্যুদণ্ড কার্যকর হওয়া জামায়াতের নেতা মুহাম্মদ কামারুজ্জামানও প্রায় ৯ বছর আগে কারাগার থেকে লেখা এক চিঠিতে দলে সংস্কারের পরামর্শ দিয়েছিলেন।

দীর্ঘ ওই চিঠিতে বিশ্ব রাজনীতির প্রেক্ষাপট বর্ণনা করে কামারুজ্জামান লিখেছিলেন, প্রশ্ন হচ্ছে- আমাদের ভবিষ্যৎ কী? এ ব্যাপারে কয়েক দফা পরামর্শও দেন তিনি। এগুলোর মধ্যে উল্লেখযোগ্য হচ্ছে- ১. যা হবার হবে। আমরা যেমন আছি তেমনি থাকব (বর্তমানে এই কৌশলই অবলম্বন করা হয়েছে)। ২. পরিবর্তিত পরিস্থিতিতে জামায়াত সিদ্ধান্ত নিয়ে পেছন থেকে একটি নতুন সংগঠন গড়ে তুলবে। এই সংগঠন প্রজ্ঞা ও দৃঢ়তার সঙ্গে ধর্মহীন শক্তির মোকাবেলা করবে। ৩. আমাদের যাদের বিরুদ্ধে যুদ্ধাপরাধের মিথ্যা অভিযোগ আনা হচ্ছে, তারা জামায়াতের নেতৃত্ব থেকে সরে দাঁড়াব এবং সম্পূর্ণ নতুন লোকদের হাতে জামায়াতকে ছেড়ে দেব।

পরবর্তী সময়ে মতিউর রহমান নিজামীর স্ত্রী শামসুন্নাহার নিজামী ‘বিবেচনায় আনতে হবে সব কিছু’ শিরোনামে একটি লেখায় কামারুজ্জামানের পরামর্শগুলোর বিরোধিতা করেন। সংস্কার ইস্যু নিয়ে জামায়াতে তখন বিতর্ক শুরু হলে ‘ইসলামী আন্দোলনে হীনম্মন্যতাবোধের সুযোগ নেই’ শিরোনামে একটি প্রবন্ধ প্রকাশিত হয় জামায়াত সমর্থিত একটি জাতীয় দৈনিকে। ধারণা করা হয়, আবু নকীব ছদ্মনামে কারাগার থেকে লেখাটি লিখেছিলেন- মতিউর রহমান নিজামী। প্রবন্ধটি প্রকাশের পর এ ইস্যুতে প্রকাশ্যে আর কথা বলার সাহস দেখায়নি কোনো নেতা।

জামায়াতের একাধিক সূত্র জানায়, মুক্তিযুদ্ধকালীন ভূমিকার জন্য ক্ষমা চাওয়া ও নতুন দল গঠনসহ আরও কয়েকটি ইস্যুতে দীর্ঘদিন ধরেই সোচ্চার শিবির থেকে আসা জামায়াতের তরুণ নেতারা। তাদের বেশিরভাগই আবার সদ্য পদত্যাগকারী ব্যারিস্টার আবদুর রাজ্জাকের অনুসারী বলে পরিচিত। তাদের সঙ্গে একমত পোষণ করে জামায়াতে সংস্কার ইস্যুতে বুদ্ধি পরামর্শ দিয়ে সহায়তা করছেন একজন বুদ্ধিজীবীও (তিনি দীর্ঘদিন ধরে প্রকাশ্য কর্মকাণ্ড থেকে নিষ্ক্রিয় আছেন)।

সম্প্রতি ওই বুদ্ধিজীবী মালয়েশিয়ায় জামায়াত নেতাদের (যারা সংস্কার চান) নিয়ে বৈঠকও করেছেন। সেখানে মালয়েশিয়া ও ইউরোপে থাকা বেশ কয়েকজন গুরুত্বপূর্ণ নেতাও উপস্থিত ছিলেন। ওই বৈঠকে একটি মাত্র ইস্যুই ছিল নতুন দল গঠন। তবে এ নিয়ে জামায়াতের আমির ও সেক্রেটারি জেনারেল- এ দুজনের মধ্যেও মতবিরোধ দেখা দেয়। দলের আমির মকবুল আহমদ সদ্য পদত্যাগ করা আবদুর রাজ্জাকের যুক্তির সঙ্গে একমত ছিলেন। তবে সেক্রেটারি জেনারেল ডা. শফিকুর রহমান এর বিপক্ষে।

দলের কর্মপরিষদের এক সদস্য বলেন, সেক্রেটারি জেনারেলের যুক্তি হচ্ছে- একাত্তরে ভূমিকার জন্য জামায়াত যদি আজ ক্ষমা চায়, পর দিন ক্ষমতাসীন দলের নেতারা বলবেন কেন ক্ষমা চেয়েছে? এর পেছনে উদ্দেশ্য আছে কিনা খোঁজা শুরু করবেন। আর নতুন নামে দল গঠন নিয়ে তার মত- এটি করা হলেও দলীয় নেতাকর্মীরা মামলা-হামলা-নির্যাতন থেকে মুক্তি পাবে না। তবে সেক্রেটারি জেনারেল এ-ও মনে করেন, দলের সব নেতা এসব বিষয়ে একমত পোষণ করলে তাতে তার কোনো আপত্তি নেই।

সর্বশেষ দলের কেন্দ্রীয় নির্বাহী পরিষদের জরুরি সভায় তরুণ নেতৃত্বের দাবির মুখে একাত্তরের ভুল রাজনৈতিক ভূমিকার জন্য ক্ষমা চাওয়া এবং জামায়াত নামক দল বিলুপ্ত করে সমাজসেবামূলক কার্যক্রমে দলকে নিয়োজিত করার নীতিগত সিদ্ধান্ত হয়, যা পরে দলের কেন্দ্রীয় মজলিসে শূরার অনুমোদন পায়নি। জামায়াতের একটি সূত্র জানায়, নতুন নামে দল গঠনের প্রক্রিয়া ইতিমধ্যে শুরু হয়েছে জামায়াতে ইসলামীতে। নতুন নামে দল গঠনের প্রস্তাব আসে জামায়াতের মজলিসে শূরা থেকেই। প্রস্তাব বাস্তবায়নের দায়িত্ব দেয়া হয়েছে দলের নির্বাহী পরিষদকে। চলতি বছরেই নতুন দল গঠিত হতে পারে। তবে দলের নাম চূড়ান্ত হয়নি। সিদ্ধান্ত হয়েছে, নতুন দল ধর্মভিত্তিক হবে না। নতুন দল গঠিত হলেও বিলুপ্ত হবে না নিবন্ধন হারানো জামায়াত। যেটি থাকবে ‘আদর্শিক সংগঠন’ হিসেবে, কিন্তু ভোটে থাকবে না। ভোটের রাজনীতিতে থাকবে নতুন দল।

এ প্রসঙ্গে রাজনৈতিক বিশ্লেষক ড. রেজোয়ান সিদ্দিকী বলেন, ব্যারিস্টার আবদুর রাজ্জাক যদি পদত্যাগ করে মুখ না খুলতেন, তা হলে আমরা বুঝতে পারতাম না যে, জামায়াতে সংস্কার প্রক্রিয়া কতদিন ধরে চলছে। ব্যারিস্টার রাজ্জাক জানিয়েছেন, তিনি ৩০ বছর ধরে চেষ্টা করছেন জামায়াতের ভেতরে একটা সংস্কার প্রক্রিয়া বাস্তবায়ন করার জন্য। ধরেন এখন যাদের বয়স ৬০-৬৫ বছর, মুক্তিযুদ্ধের সময় তাদের বয়স ছিল ১২-১৩ বছর। জামায়াতে যারা তরুণ জেনারেশন তাদের কারোরই বয়স ৫০-এর ওপরে নয়। তারা মুক্তিযুদ্ধ দেখেইনি। কিন্তু তারা কেন দায়ভার বহন করবে।

জানা গেছে, জামায়াতের বেশিরভাগ নেতাই মনে করেন- মুক্তিযুদ্ধকালীন ভূমিকা নিয়ে আজও তাড়া করছে দলটিকে। এটিসহ আরও কয়েকটি ইস্যুতে জামায়াতে তৈরি হয়েছে বড় ধরনের অস্থিরতা। এর সর্বশেষ সংযোজন হিসেবেই দলটির সহকারী সেক্রেটারি জেনারেল ব্যারিস্টার আবদুর রাজ্জাক পদত্যাগ করেছেন। এ ইস্যুগুলো শিগগিরই সুরাহা করতে না পারলে অনেকেই পদত্যাগ করতে পারেন।