শীতের সঙ্গে পাল্লা দিয়ে বাড়ছে রোগ

শীতের তীব্রতার সঙ্গে পাল্লা দিয়ে যেন বাড়ছে শীতজনিত রোগ। ইতিমধ্যে রাজধানীসহ দেশের বিভিন্ন স্থানে শীতজনিত রোগে আক্রান্ত হয়ে হাসপাতালে রোগীর ভিড় বেড়েছে। আক্রান্তদের মধ্যে শিশু ও বৃদ্ধই বেশি। শীতের শুরু থেকে এ পর্যন্ত সারাদেশে শীতজনিত রোগে আক্রান্ত হয়েছে ৫২ হাজারের বেশি। আর এসব রোগে মৃত্যু হয়েছে ৬ জনের।

এখবর লেখার সময় সন্ধ্যা সাড়ে ৬টার তথ্যে জানা গেছে, গত ২৪ ঘণ্টায় এসব রোগে আক্রান্ত হয়ে হাসপাতালে ভর্তি হয়েছে ৬০৬ জন। এটি বাংলাদেশের সব সরকারি হাসপাতালের চিত্র। তবে এর বাইরেও অনেকে আক্রান্ত হয়ে বিভিন্ন চিকিৎসকের কাছে ও প্রাইভেট হাসপাতালে গিয়ে চিকিৎসা নিচ্ছেন।

বিশেষজ্ঞদের মতে, বাংলাদেশে শীতকালীন স্বাভাবিক তাপমাত্রায় বিভিন্ন ধরনের রোগব্যাধি দেখা দেয়। এর মধ্যে সর্দি-কাশি, নিউমোনিয়া, ডায়রিয়া, হাঁপানি, টনসিলাটাইসিস, ব্রংকিওলাইটিস, সাইনোসাইটিস, বাত, আর্থ্রাইটিস, চামড়ার শুষ্কতা অন্যতম। এসব রোগ থেকে সুরক্ষায় শীত এড়িয়ে চলতে হবে। প্রয়োজনে চিকিৎসকের পরামর্শ নিতে হবে।

এ প্রসঙ্গে আন্তর্জাতিক খ্যাতিসম্পন্ন চিকিৎসক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয়ের মেডিসিন অনুষদের ডিন অধ্যাপক এবিএম আবদুল্লাহ বলেন, অন্যান্য বছরের তুলনায় এ বছর শীতের তীব্রতা বেশি। স্বাভাবিক শীতকালীন রোগব্যাধির পাশাপাশি তীব্র শীতে হাইপোথার্মিয়া হতে পারে। বিশেষ করে বয়স্কদের ক্ষেত্রে এটি হওয়ার আশঙ্কা সবচেয়ে বেশি।

তিনি বলেন, বয়স বাড়ার সঙ্গে সঙ্গে এমনিতেই মানুষের শরীরের তাপ উৎপাদন ক্ষমতা কমতে থাকে। তীব্র শীতে বয়স্কদের ক্ষেত্রে হাইপোথার্মিয়া হতে পারে। এক্ষেত্রে রোগীর শরীর ধীরে ধীরে ঠাণ্ডা হয়ে আসে। শরীরে তাপ উৎপাদন কম হওয়ায় হাত-পা কুঁকড়ে যায়। এমনকি শরীর অবশ হয়ে আসতে থাকে। এছাড়া হাঁপানি, ডায়রিয়া, সর্দি-কাশিসহ অন্যান্য রোগ তো আছেই। এসব রোগ থেকে বাঁচতে হলে অবশ্যই শীত এড়িয়ে চলতে হবে।

শরীর গরম রাখতে গরম পোশাক পরতে হবে, গরম পানি খেতে হবে। এমনকি গোসলের ক্ষেত্রে গরম পানি ব্যবহার করতে হবে। যেহেতু এসব রোগে বয়স্ক ও শিশুরা বেশি আক্রান্ত হয়ে থাকে তাই তাদের প্রতি বিশেষ নজর দিতে হবে। রুম গরম রাখতে রুম হিটার ব্যবহার করা যেতে পারে। তাছাড়া রোগে আক্রান্ত হলে অবশ্যই চিকিৎসকের পরামর্শ নিতে হবে।

স্বাস্থ্য অধিদফতরের ন্যাশনাল হেলথ ক্রাইসিস ম্যানেজমেন্ট সেন্টারের তথ্যমতে, শীতের শুরু থেকে অর্থাৎ ১ নভেম্বর ২০১৭ থেকে ৮ জানুয়ারি ২০১৮ পর্যন্ত শীতজনিত রোগে সারাদেশে ৫২ হাজার ৩১২ জন আক্রান্ত হয়েছে। এর মধ্যে এআরআই (অ্যাবস্ট্রাক্টিভ রিসপারেটরি ইনফেকশন) এ আক্রান্ত হয়েছেন ৯ হাজার ১৩৮ জন।

এ রোগে মৃত্যু ঘটেছে ৫ জনের। ডায়রিয়ায় আক্রান্ত হয়েছেন ২৬ হাজার ৭৩৬ জন, এতে মৃত্যু ঘটেছে এক জনের। এছাড়া অন্যান্য রোগ যেমন নিউমোনিয়া, আমাশয়, জ্বর, কাশি ইত্যাদি রোগে আক্রান্ত হয়েছেন ১৬ হাজার ৪৩৮ জন। এদিকে গত ২৪ ঘণ্টায় এসব রোগে আক্রান্ত হয়েছে ৬০৬ জন। এর মধ্যে এআরআইয়ে আক্রান্ত হয়েছেন ৯২ জন, ডায়রিয়ায় ৩৫৮ জন ও অন্যান্য রোগে ১৫৬ জন। অধিদফতরের তথ্যমতে, দেশের হাসপাতালগুলোতে শীতজনিত রোগে আক্রান্ত রোগীর সংখ্যা বাড়ছে।

এ প্রসঙ্গে স্বাস্থ্য অধিদফতরের মহাপরিচালক অধ্যাপক ডা. আবুল কালাম আজাদ বলেন, শীতের তীব্রতা বাড়ার সঙ্গে সঙ্গেই অধিদফতরের পক্ষ থেকে একটি এপিডেমিওলোজি টিম গঠন করা হয়েছে। এ সময় কোন ধরনের রোগের তীব্রতা বেশি, রোগীরা কী ধরনের সমস্যায় পড়ছে এবং নতুন কোনো রোগ আসছে কিনা সে বিষয়ে তারা নজর রাখছে। তাছাড়া দেশের সব সিএসদের নির্দেশ দেয়া হয়েছে শীতকালীন রোগের পর্যাপ্ত ওষুধ মজুদ রাখার জন্য। কোনো জেলায় ওষুধের ঘাটতি থাকলে অবশ্যই অধিদফতর থেকে ওষুধ সংগ্রহ করে রোগীদের প্রয়োজন অনুযায়ী ওষুধ সরবরাহের নির্দেশ দেয়া হয়েছে।

এদিকে আইসিডিডিআরবির তথ্যমতে, শীতের প্রকোপ বাড়ার পর গড়ে প্রতিদিন ৪শ’ থেকে ৪৫০ জন ডায়রিয়ার রোগী মহাখালীর হাসপাতালে আসছে। এরা মূলত শীতজনিত (রোটা ভাইরাস) ডায়রিয়ায় আক্রান্ত। এদের মধ্যে শিশুর সংখ্যা গড়ে ৬৫ ভাগ ও প্রাপ্তবয়স্ক ৩৫ ভাগ। আক্রান্তদের গড়ে ২৪ ঘণ্টা হাসপাতালে রেখে চিকিৎসা দেয়া হচ্ছে।

এ প্রসঙ্গে আইসিডিডিআরবির ডায়রিয়াল ডিজিজ প্রধান ড. আজহারুল ইসলাম বলেন, শীতের তীব্রতা বাড়লে রোটা ভাইরাসজনিত ডায়রিয়া রোগীর প্রকোপ বাড়ে। সাধারণত শিশুরা এতে বেশি আক্রান্ত হয়। তিনি বলেন, যেহেতু এটা এক ধরনের ডায়রিয়া। তাই বিশুদ্ধ পানি পানের প্রতি বিশেষ গুরুত্ব দিতে হবে।

বাসা ও বাসার চারপাশ পরিচ্ছন্ন রাখতে হবে। বিশেষ করে শিশুরা যেন ময়লা-আবর্জনা মুখে না দেয় সেদিকে লক্ষ্য রাখতে হবে। আর ৬ মাসের কম বয়সী শিশুদের মায়ের বুকের দুধ ছাড়া অন্যকিছু খাওয়ানো থেকে বিরত থাকতে হবে।

শীতজনিত রোগের মধ্যে সবচেয়ে বেশি আক্রান্ত হয় অ্যাবস্ট্রাক্টিভ রিসপারেটরি ইনফেকশন বা শ্বাসযন্ত্রজনিত সমস্যায়। এ প্রসঙ্গে রিসপারেটরি বিশেষজ্ঞ ও শহীদ সোহরাওয়ার্দী হাসপাতালের পরিচালক অধ্যাপক ডা. উত্তম বড়–য়া যুগান্তরকে বলেন, বৃদ্ধ ও শিশু উভয়ের ক্ষেত্রে এ ধরনের শ্বাসযন্ত্রজনিত রোগের তীব্রতা সবচেয়ে বেশি। কারণ এ দু’বয়সে রোগপ্রতিরোধ ক্ষমতা কম থাকে। ইতিমধ্যে আমার হাসপাতালেও এ ধরনের রোগী আগের তুলনায় দ্বিগুণ আসতে শুরু করেছে।

শীতে শিশু ও বৃদ্ধদের অ্যাজমা, হাঁপানি, ব্রংকিওলাইটিস, নিউমোনিয়া থেকে বাঁচাতে পর্যাপ্ত গরম কাপড়সহ হাতমোজা, পা মোজা পরিয়ে রাখতে হবে। সর্বক্ষেত্রে কুসুম গরম পানি ব্যবহার করতে হবে। তারপরেও যদি কেউ অসুস্থ হয়ে পড়ে, শ্বাসকষ্টে ঘুমাতে না পারে, ঠোঁট-মুখ নীল হয়ে যায়, বুক স্বাভাবিকের তুলনায় বেশি ওঠানামা করে তাহলে অবশ্যই হাসপাতালে নিয়ে যেতে হবে।