শেখ হাসিনার ঘোষণায় সিন্ডিকেট চক্র বেকায়দায়

আগামী ১১ ও ১২ মে অনুষ্ঠিতব্য ছাত্রলীগের ২৯তম সম্মেলনের জন্য বিভিন্ন প্রস্তুতিমূলক কমিটি গঠিত হয়েছে। ঢাকা মহানগর উত্তর, দক্ষিণ ও ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সম্মেলন হয়ে গেছে। গত কয়েকটি কমিটিতে একটি শক্তিশালী সিন্ডিকেট তৎপর থাকলেও এবারই প্রথম তাদের বিরোধীরা কোমর বেঁধে মাঠে নেমেছে। ফলে বেকায়দায় পড়েছে সিন্ডিকেট, তারা চেয়েছিল ইলেকশন। এ পরিস্থিতিতে সিলেকশন না ইলেকশনের মাধ্যমে ছাত্রলীগের নতুন কমিটি হবে, তা নিয়ে আলোচনা শুরু হয়েছে। তবে এবার সিলেকশনের পক্ষে নিজের অবস্থান জানিয়ে দিয়েছেন আওয়ামী লীগ সভাপতি ও ছাত্রলীগের সাংগঠনিক নেত্রী শেখ হাসিনা। এটাকে সিন্ডিকেটের ওপর বড় আঘাত বলে মনে করছেন সংশ্লিষ্ট অনেকেই।

সংশ্লিষ্ট একটি সূত্র জানিয়েছে, বর্তমান সিন্ডিকেট সংগঠনে তাদের আধিপত্য ধরে রাখতে ভোটের কৌশল নিয়ে এগুচ্ছে, এ খবরটি আগেই জানতে পেরেছেন শেখ হাসিনা। ফলে তাদের থামাতে ভোট নয়, রাজনৈতিক ইতিহাস, পারিবারিক ব্যাকগ্রাউন্ড দেখেই এবার নেতা বাছাইয়ের দিকে এগুচ্ছে আওয়ামী লীগ হাইকমান্ড। সোমবার (৩০ এপ্রিল) আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক ওবায়দুল কাদের, যুগ্ম সম্পাদক জাহাঙ্গীর কবির নানক ও আবদুর রহমানের সামনে এ নির্দেশনা দিয়েছেন শেখ হাসিনা। এবার আর নাম প্রস্তাব করে নয়, জীবনবৃত্তান্ত জমা নিয়ে খোঁজখবর করে নেতা ঠিক করা হবে বলেও জানান তিনি।

আওয়ামী লীগ ও ছাত্রলীগের শীর্ষ নেতাদের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, সম্মেলনের দিন যত ঘনিয়ে আসছে সিন্ডিকেটের তৎপরতা ততই বাড়ছে। বিশেষ করে ঢাকা মহানগর ও ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সম্মেলনের পর সিন্ডিকেটের সদস্যরা নিজেদের পছন্দের কমিটি দিতে বেশ তৎপর। রাজধানীর কাওরানবাজার, পল্টন, ধানমন্ডি, পান্থপথসহ বেশ কয়েকটি জায়গায় তারা কয়েক দফা বৈঠকও করেছেন।

ছাত্রলীগের সাবেক নেতা এবং বর্তমানে আওয়ামী লীগের কেন্দ্রীয় কমিটির এক সদস্য নাম প্রকাশ না করার শর্তে বলেন, ছাত্রলীগের আজকের অবস্থার জন্য আমি শুধু তাদের দোষ দেব না, এর জন্য আমরাও অনেকাংশে দায়ী। নিজেদের স্বার্থে বারবার সংগঠনটিকে ব্যবহার করা হয়েছে, এখনো হচ্ছে। এজন্যই ছাত্রলীগের নেতা বানানোর জন্য সাবেকদের এত তোড়জোড়। এ উদ্দেশ্যে একটি শক্তিশালী সিন্ডিকেট গড়ে উঠেছে।

তিনি প্রশ্ন রেখে বলেন, যদি ব্যক্তিস্বার্থ না-ই থাকে, তাহলে আওয়ামী লীগের শীর্ষ পর্যায়ের কয়েকজন নেতা নিজেদের পছন্দের নেতা বসাতে এত আগ্রহী কেন? এই সিন্ডিকেটের খপ্পর থেকে ছাত্রলীগকে মুক্ত করতে শেখ হাসিনার হস্তক্ষেপ জরুরি বলে মনে করেন ওই নেতা।

আওয়ামী লীগের আরেক নেতা বলেন, ভোটের নাটক সাজিয়ে পছন্দের নেতা নির্বাচিত করার দিন শেষ। এ উদ্যোগ বন্ধ করে দিয়েছেন নেত্রী। নেতৃত্ব নির্বাচনের দায়িত্ব এবার আর কারো হাতে ছাড়া হবে না। তিনি নিজেই নেতৃত্ব নির্বাচন করবেন। আগাছা-পরগাছা-অনুপ্রবেশকারী ঠেকাতে এবার প্রার্থীদের পারিবারিক রাজনৈতিক অতীত দেখে পদ পদবি দেওয়া হবে। এরই মধ্যে সে কাজও শুরু হয়ে গেছে বলে জানান তিনি।

আলোচনা আছে সিন্ডিকেটটির নেতৃত্বে রয়েছেন আওয়ামী লীগের এক যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক, একজন সাংগঠনিক সম্পাদক, কেন্দ্রীয় কমিটির একজন সাবেক সদস্য এবং ছাত্রলীগের বেশিরভাগ সাবেক শীর্ষ নেতা। আর সিন্ডিকেটের অভিভাবক হিসেবে রয়েছেন আওয়ামী লীগের এক শীর্ষ নেতা। সম্মেলনের তারিখ ঘোষণা হওয়ার সঙ্গে সঙ্গেই তারা তৎপরতা শুরু করে দিয়েছেন। দীর্ঘদিন দেশের বাইরে অবস্থান শেষে সিন্ডিকেটের একজন গুরুত্বপূর্ণ সদস্য সম্প্রতি দেশে ফিরেছেন। দুই-তিন দিন আগে এর কয়েকজন সদস্য একসঙ্গে বসেছিলেন করণীয় ঠিক করতে। সিন্ডিকেটবিরোধীদের তৎপরতার কারণে এবার নিজেদের অফিস ও ব্যবসা প্রতিষ্ঠানে বৈঠক এড়াতে একটি হোটেলের কক্ষও ভাড়া নিয়ে রাখা হয়েছে বলে জানা গেছে।

এর আগে সিন্ডিকেটের বিষয়টিকে অনেকেই মিডিয়ার সৃষ্টি বলে উড়িয়ে দিলেও এবার এর বিরুদ্ধে অনেকেই কথা বলছেন। আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক ওবায়দুল কাদেরের মুখেও সিন্ডিকেটের কথা গুরুত্বসহকারে উঠে এসেছে। তিনি বলেন, বাংলাদেশ ছাত্রলীগে যারা আগামী কমিটির নেতৃত্বে আসবেন, তারা কেউ কোনো সিন্ডিকেটের কথায় চলবে না। ছাত্রলীগ চলবে বঙ্গবন্ধুর আদর্শে এবং শেখ হাসিনার নির্দেশে।

দলের যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক আবদুর রহমান বলেন, ছাত্রলীগের বিষয়টা আলাদা। নেত্রীর (শেখ হাসিনা) সঙ্গে এ সংগঠনের সম্পর্কটা আবেগের। তাই ছাত্রলীগের বিষয়গুলো তার ওপর ছেড়ে দেওয়া উচিত। আমরা চাই নেত্রীর সংগঠন নেত্রীর কাছে ফিরে যাক।

ছাত্রলীগের বর্তমান কমিটির ভাইস প্রেসিডেন্ট মেহেদি হাসান বলেন, সম্মেলনের বিষয়ে নেত্রীর সিদ্ধান্তই চূড়ান্ত। তিনি যেভাবে বলবেন সেভাবেই হবে। সিন্ডিকেট বা সিন্ডিকেটবিরোধী যাই বলা হোক না কেন, আমরা আসলে কোনো পক্ষ বিপক্ষ চাই না। আমরা চাই নেতৃত্ব নির্বাচন নেত্রী নিজে করুন। ভোট বিষয়ে তিনি বলেন, আমাদের সম্মেলনে শুধু সভাপতি ও সাধারণ সম্পাদক পদে ভোট হয়ে থাকে। অন্য পদে হয় না। ভোট হলে সব পদেই হওয়া উচিত। তিনি আরো বলেন, বর্তমান ৩০০ সদস্যের কমিটির অনেকে প্রথমবার এসেই সম্পাদকীয় পদে জায়গা পেয়েছেন। এমনটা যেন আর না হয়।

সিন্ডিকেটবিরোধী আওয়ামী লীগের এক কেন্দ্রীয় নেতা বলেন, কোটা সংস্কার আন্দোলনের পর ছাত্রলীগের নেতৃত্ব নিয়ে নতুন করে ভাবার সময় এসে গেছে। একাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনকে সামনে রেখে সংগঠনটিকে গড়ে তুলতে হবে। তিনি বলেন, নেত্রীর সঙ্গে এ বিষয়ে কথা হয়েছে। গত কয়েকটি কমিটির অভিজ্ঞতা তুলে ধরে এবার নতুন কিছু করা যায় কি না সেটি তাকে জানিয়েছি। সবকিছু বিচার বিশ্লেষণ করে আওয়ামী লীগ সভাপতি এবার নিজেই সিদ্ধান্ত নেবেন এমন প্রত্যাশার কথা জানান তিনি।