শেষ বলে কার্তিকের ছক্কায় ফের বাংলাদেশের স্বপ্নভঙ্গ

টানটান উত্তেজনা শেষে গিয়ে। ভারতের হাত থেকে ৩ ওভারের মধ্যে ম্যাচ বাংলাদেশের হাতে যায়। আবার বাংলাদেশের হাত থেকে ভারতের কাছে। ভারতের কাছ থেকে বাংলাদেশের কাছে। এবং এইভাবে শেষ ২ বলে ভারতের জিততে দরকার ৫ রান। ১৯.৫ ওভারের সময় সৌম্য সরকারের বলে মেহেদী হাসান মিরাজের হাতে ধরা পড়েন নাটকীয়ভাবে। কিন্তু ভাগ্যদেবী হাসেন। দিনেশ কার্তিক বীর হওয়ার জন্য অপেক্ষায়। শেষ বলে ৫ রানের হিসেব কার্তিক এক ছক্কায় মিলিয়ে ফেলেন বাংলাদেশের হৃদয় ভেঙে। রোববার কলম্বোর প্রেমাদাসা স্টেডিয়ামে নিদাহাস ট্রফির শাসরুদ্ধকর ফাইনাল ৪ উইকেটে জিতে ভারত জিতে নিল নিদাহাস তিনজাতি ট্রফির শিরোপা।

টস হেরে বাংলাদেশ ৮ উইকেটে করেছিল ১৬৮ রান। জবাবে জয়ের পথেই হাঁটছিল ভারত। কিন্তু ১৮তম ওভারে গিয়ে দ্য ফিজ নাটকীয় বাঁক এনে দেন ম্যাচে। তখন ১৮ বলে ৩৫ রান দরকার ভারতের। কিন্তু প্রথম চার বল ডট দিলেন মোস্তাফিজুর রহমান। অবিশ্বাস্য বোলিং। পঞ্চম বলে ১ রান। ওভারের শেষ বলে মনিশ পান্ডের উইকেট। জেগে ওঠে বাংলাদেশ। ১২ বলে ৩৪ দরকার ভারতের। কিন্তু তখন উইকেটে আসেন দিনেশ কার্তিক। ওই সময়ে রুবেল হোসেন এলেন আগের তিন ওভারে ১৩ রান দিয়ে ২ উইকেট নেওয়ার পর। কিন্তু তিনি ডেথ ওভারের বোলার না। কার্তি দুটি করে চার-ছক্কায় ২২ রান নিয়ে হিসেব সহজ করেন। শেষ ওভারে সৌম্য সরকার কেন? অধিনায়ক সাকিব আল হাসানের হিসেবে এদিন গোলমাল হয়েছে। তারপরও বাংলাদেশ প্রথমবার কোনো এমন টুর্নামেন্ট জয়ের উৎসব করতে পারতো। প্রথম ৪ বলে ৭ রান। পঞ্চম বলে বিজয় শঙ্কর আউট। শেষ বরে ৪ হলে সুপার ওভার, ছক্কা না মারলে ভারত জেতে না। দুর্ধর্ষ ছক্কায় ভারতের ড্রেসিংরুমকে উন্মাদ করে দেন দিনেশ। আর বাংলাদেশ দল হাঁটু ভেঙে নতজানু এক দল। বুক ভেঙেছে তাদের। আবার। আবার ফাইনালেই। মাত্র ৮ বলে ৩ ছক্কা ও ২ বাউন্ডারিতে অপরাজিত ২৯ রানের ছোট্ট অথচ মহাকাব্যিক ম্যাচ উইনিং হার না মানা ইনিংস দিনেশ কার্তিকের।

বাংলাদেশের দেওয়া ১৬৭ রানের চ্যালেঞ্জ নিয়ে ব্যাট করতে নেমে শুরুটা ভালোই করে ভারত। ৩২ রানের ওপেনিং জুটি গড়েন দুই ওপেনার শিখর ধাওয়ান ও রোহিত শর্মা। দারুণ এ জুটি ভাঙ্গেন অধিনায়ক সাকিব আল হাসান। পরের ওভারে সুরেশ রায়নাকে খালি হাতে বিদায় করেন রুবেল হাসান। ফলে ভালোভাবেই ম্যাচে ফিরে আসে বাংলাদেশ। কিন্তু টাইগারদের স্বপ্নে বাঁধা হয়ে তখনও উইকেটে ছিলেন ভারতীয় অধিনায়ক রোহিত শর্মা। লোকেশ রাহুলকে নিয়ে ৫১ রানের জুটি গড়ে চাপ সামলে নেন অধিনায়ক। এরপর ১৫ রানের ব্যবধানে এ দুই ব্যাটসম্যানকে ফেরাতে সমর্থ হলে আবার খেলায় ফিরে আসে টাইগাররা।

কিন্তু পঞ্চম উইকেটে বাংলাদেশকে বড় চাপে ফেলে দেয় মানিশ পান্ডে ও বিজয় শঙ্করের ৩৫ রানের জুটি। ইঙ্গিত দিচ্ছিলো আরও ভয়ংকর কিছুর। আর ঠিক তখনই দলের ত্রাতা হয়ে আসেন মোস্তাফিজুর রহমান। ১৮তম ওভারে প্রথম বলই দেন ডট। পঞ্চম বলে লেগ বাইয়ের সূত্রে আসে ১ রান। প্রান্ত বদল। স্ট্রাইকে আসেন মানিশ। তাকে সাব্বিরের কেচে পরিণত করে টাইগারদের উল্লাসে ভাসান কাটার মাস্টার। উইকেট-মেডেন নিয়ে বাংলাদেশকে জয়ের স্বপ্ন দেখান তিনি। কিন্তু ম্যাচের তখন মূল উত্তেজনাই বাকি। শেষ দুই ওভারে তখন দরকার ৩৪ রান। কিন্তু রুবেল হোসেনের ওই ওভারে ২টি করে চার ও ছক্কায় ২২ রান তুলে নেন দিনেশ কার্তিক। আর তাতেই শেষ হয় টাইগারদের স্বপ্ন।

শেষ ওভারে দরকার ছিল ১২ রানের। একজন পার্ট টাইম বোলার হিসেবে শুরুটা খারাপও করেননি তিনি। প্রথম ৩ বলে দেন ৩ রান। চতুর্থ বলে চার মারতে সমর্থ হন শঙ্কর। পঞ্চম বলে আউটও করেন তাকে। শেষ বলে দরকার ৫ রানের। কিন্তু শেষ বলে ভাগ্যটা যায় কার্তিকের সঙ্গেই। ছক্কা মেরেই দলের জয় নিশ্চিত করেই মাঠ ছাড়েন তিনি। আরও একটি স্বপ্নভঙ্গ হয় বাংলাদেশের। মাত্র ৮ বলে ২৯ রানের বিধ্বংসী এক ইনিংস খেলেন কার্তিক। ২টি চার ও ৩টি ছক্কা মারেন তিনি। তবে দলের পক্ষে সর্বোচ্চ ৫৬ রান করেন অধিনায়ক রোহিত। ৪২ বল মোকাবেলা করে ৪টি চার ও ৩টি ছক্কায় এ রান করেন তিনি। পান্ডে ২৮ ও রাহুল ২৪ রান করেন। বাংলাদেশের পক্ষে ৩৫ রানের খরচায় ২টি উইকেট নেন রুবেল।

এদিন নিজেদের ইনিংসের শুরুটা খারাপ করেনি বাংলাদেশ। প্রথম ওভারে আসে ২৭ রান। প্রত্যাশিত সূচনা। কিন্তু এরপর যুজবেন্দ্র চাহালের ঘূর্ণিতে পড়ে সব এলোমেলো হয়ে যায় টাইগারদের। তবে শুরুটা করেন ওয়াশিংটন সুন্দর। চতুর্থ ওভারে লিটনকে ফেরান তিনি। আর পরের ওভারে বল করতে এসেই বাংলাদেশকে জোড়া ধাক্কা দেন চাহাল। তবে টাইগারদের সেরা ব্যাটসম্যান তামিমের আউটে তার চেয়ে শারদুল ঠাকুরের কৃতিত্ব ছিল বেশি। বাউন্ডারি লাইনে লাফিয়ে উঠে দুর্দান্তভাবে ক্যাচ লুফে নেন শারদুল। দুই বল পর সুইপ করতে গিয়ে স্কয়ার লেগে দাঁড়ানো শিখর ধাওয়ানের সহজ ক্যাচ দিয়ে আউট হন সৌম্য সরকার।

মাত্র ৬ রানে ৩ উইকেট হারিয়ে চাপে পরা দলের হাল দারুণ ফর্মে থাকা মুশফিকুর রহীমকে নিয়ে ধরেন সাব্বির রহমান। ২৫ রানের জুটি গড়ে ভালো কিছুর ইঙ্গিতও দিচ্ছিলেন তারা। কিন্তু চাহালের গুগলিতে আবার ধাক্কা খায় টাইগাররা। আউট হন মুশফিক। এরপর টাইগারদের দৃষ্টি ছিল আগের ম্যাচের নায়ক মাহমুদউল্লাহ দিকে। ৩৬ রানের জুটিতে বড় সংগ্রহের স্বপ্ন দেখচিল দলটি। কিন্তু বিপত্তি ঘটে মাহমুদউল্লাহ-সাব্বিরের ভুল বোঝাবুঝিতে। রানআউটে কাটা পরেন মাহমুদউল্লাহ। দলের বড় বিপদে উইকেটে আসেন অধিনায়ক সাকিব। সাব্বিরের সঙ্গে ১৯ রানের জুটি গড়ার পর তিনিও পরেন রানআউটের ফাঁদে।

দলীয় ১৩৩ রানে ৬ উইকেট হারানোর পর টাইগাররা তখন স্বপ্ন বাঁচিয়ে রেখেছিলেন সাব্বির। দারুণ লড়াই করেন তিনি। ১৯তম ওভারে উনাদকাটের বলে বোল্ড হওয়ার আগে দলকে সম্মানজনক স্থানে নিয়ে যান তিনি। এরপর শেষ দিকে দারুণ ব্যাটিং করেন মেহেদী হাসান মিরাজ। মাত্র ৭ বলে ২টি চার ও ১টি ছক্কায় ১৯ রান করেন তিনি। ফলে লড়াকু সংগ্রহই পায় বাংলাদেশ। দারুণ ব্যাটিং করে দলের পক্ষে সর্বোচ্চ ৭৭ রানের দারুণ এক ইনিংস খেলেন তিনি।৫০ বল মোকাবেলা করে ৭টি চার ও ৪টি ছক্কায় নিজের ইনিংসটি সাজান তিনি। ২১ রান করেন মাহমুদউল্লাহ। ভারতের পক্ষে চাহাল ৩টি ও উনাদকাট ২টি উইকেট নেন।

সংক্ষিপ্ত স্কোর :

বাংলাদেশ : ২০ ওভারে ১৬৬/৮ (তামিম ১৫, লিটন ১১, সাব্বির ৭৭, সৌম্য ১, মুশফিক ৯, মাহমুদউল্লাহ ২১, সাকিব ৭, মিরাজ ১৯*, রুবেল ০, মোস্তাফিজ ০*; উনাদকাট ২/৩৩, সুন্দর ১/২০, চাহাল ৩/১৮, ঠাকুর ০/৪৫, শঙ্কর ০/৪৮)।

ভারত : ২০ ওভারে ১৬৮/৬ (ধাওয়ান ১০, রোহিত ৫৬, রায়না ০, রাহুল ২৪, পান্ডে ২৮, শঙ্কর ১৭, কার্তিক ২৯*, সুন্দর ০*; সাকিব ১/২৮, মিরাজ ০/১৭, রুবেল ২/৩৫, অপু ১/৩২, মোস্তাফিজ ১/২১, সৌম্য ১/৩৩)।

ফলাফল : ভারত ৪ উইকেটে জয়ী।