শেষ সুযোগ || স্বরূপা রায়

“আজকেই শেষ পরীক্ষা তোর। এই পরীক্ষা দিয়ে চাকরি না পেলে বাবার সাথে দোকানে বসবি। আর কোনো পরীক্ষা দিতে হবেনা। পুরো মন ব্যবসাতে দিবি।” অনিকের মা বললো ওকে খেতে দিতে দিতে।

অনিকের আজ সরকারি ব্যাংকের পরীক্ষা। ও অনেকগুলোই সরকারি চাকরির পরীক্ষা দিয়েছে, কিন্তু কোনোটাতেই ওর হয়নি। একটু একটুর জন্য সব আটকে গেছে। ইন্টার্ভিউ অবধি আজ পর্যন্ত পৌঁছাতে পারেনি। আজ বলতে গেলে ওর শেষ প্রচেষ্টা।

অনিকের বাবা-মায়ের ইচ্ছা ও ওর বাবার মুদি দোকানে বসে বাবাকে সাহায্য করুক। একমাত্র ছেলে যদি ব্যবসা না দেখে, তাহলে আর কে ভাববে!

কিন্তু অনিকের ইচ্ছে সরকারি চাকরি করবে। আর আরামে জীবনযাপন করবে বাবা-মাকে নিয়ে। তার জন্য ৩ বছর ধরে ও অক্লান্ত পরিশ্রম করছে। কিন্তু ঐ যে ভাগ্য, সাথ দিচ্ছেনা অনিকের।

অনিকের রাতে ঘুম হয়নি আজকের পরীক্ষার চিন্তায়। ভোরবেলা উঠে আবার পড়তে বসে গেছিল। তারপর পরীক্ষার জন্য সবকিছু গুছিয়ে মাকে খেতে দিতে বললো। তারপরই মা মনে করিয়ে দিল আবার যে এটাই আমার শেষ চেষ্টা।

“আরে মা জানি তো। এবার আমি এই পরীক্ষাটা পাশ করেই ছাড়বো।” আমি খেতে খেতে বললাম মাকে।
“সে দেখা যাবে। প্রতিবারই তো সেটা শুনি।” মা বললো।
অনিক আর কিছু না বলে মাকে প্রণাম করে বেরিয়ে পড়লো।
পাড়ার বাজারেই অনিকের বাবার দোকান। পরীক্ষা দিতে যাওয়ার জন্য বাড়ি থেকে বেরিয়ে ওর বাবার দোকানে গেল। দোকানে ঢুকে বাবাকে প্রণাম করে বললো, “বাবা পরীক্ষা দিতে যাচ্ছি।”
“হ্যাঁ দিয়ে আয় আর কি! এটাই শেষ।”
“হ্যাঁ জানি।” বলে অনিক বেরিয়ে গেল।

অনিকের বাড়ি ব্যান্ডেলে। স্টেশানে গিয়ে শিয়ালদার জন্য ট্রেন ধরলো অনিক। গোয়েংকা কলেজে সিট পড়েছে অনিকের। শিয়ালদাতে নেমে বাস ধরে অনিক পৌছালো গোয়েংকা কলেজে।

ইতিমধ্যে অনেক ছেলে-মেয়ে এসে পৌঁছেছে পরীক্ষা দেওয়ার জন্য। আগের টাইমের পরীক্ষা চলছে। তাই গেট বন্ধ আছে। গেটের সামনে অনিকের মত পরের টাইমের ছেলে-মেয়ের ভিড়।

অনিক আগে নিজের পরীক্ষার রুম দেখে নিল লিস্টে রোল নম্বরটা মিলিয়ে। তারপর গেট খুললে সবার সাথে ভেতরে ঢোকে অনিক। ভেরিফিকেশান করিয়ে নিজের সিটে গিয়ে বসে সবকিছু অ্যাডজাস্ট করে নেয়।

তারপর পরীক্ষা শুরুর আগে অবধি সবকিছু ভাবতে থাকে, কি কি পড়েছে।

পরীক্ষা শুরু হলো। প্রথমদিকে পরীক্ষা ভালোই চলছিল। তারপর হঠাৎ কি হলো, অংক মিলছেনা অনিকের। সময়ের খেলা হল এইসব সরকারি চাকরির পরীক্ষা। অংকের পেছনে সময় বেশি নষ্ট না করে অনিক বাকি বিষয় গুলো আগে শেষ করলো। তারপর অংকে ফিরে এল। তাও অংক বেশি করতে পারলো না।

সময় শেষ। মন খারাপ করে বেরিয়ে এল অনিক পরীক্ষার হল থেকে।

বাড়ি আসতেই অনিকের মা জিজ্ঞেস করলো, “কিরে কেমন হলো?”
“ভালো না। অংক খুব কঠিন এসছিল। বেশি পারিনি।”
“বাস! ঝামেলা শেষ। এটাতেও হবেনা। কাল থেকে দোকানে বসবি।”
“মা এভাবে তোমরা আমার স্বপ্ন ভেঙে দেবে?”
“আর কত? অনেক হয়েছে। বুড়ো ছেলে ঘরে বসিয়ে খাওয়াবো নাকি? তোর বয়সি সবাই হয় প্রাইভেটে চাকরি করছে নাহলে বাবার ব্যবসা দেখছে। আর তুই বাবার ঘাড় ভেঙে খাচ্ছিস।”
“মা প্লিজ। আমি পারবো না ওসব দোকান সামলাতে। আমাকে আরেকটু সময় দাও।”
“আরে, আমরা তো আগেই বলে দিয়েছিলাম যে এটাই তোর লাস্ট চান্স। আর হবে না।”
অনিক আর কিছু না বলে নিজের ঘরে ঢুকে দরজা বন্ধ করে দেয়।
রাতে ডাইনিং টেবিলে বসে অনিকের বাবা জিজ্ঞেস করলো ওর মাকে, “তোমার ছেলে কোথায়?”
“নিজের ঘরে আছে। পরীক্ষা ভালো হয়নি। তাই মনের দুঃখে ঘরেই বাড়িতে আসার পর থেকে। দুপুরে কিছু খায়ওনি। অনেক জোর করেছিলাম। তাও খেলো না।”
“আচ্ছা। কি চায় ও?”
“আবার পরীক্ষা দিতে চায়।”
“ঠিক আছে। ওকে ডেকে নিয়ে আসো। আমি কথা বলি ওর সাথে। ও দিক পরীক্ষা। ছেলেকে ব্যবসায় ঢুকতেই হবে এমন না। আরোও কয়েকবার চেষ্টা করুক।”
“হ্যাঁ আমিও সেটাই ভাবছিলাম। ডেকে আনি ওকে।”
“হ্যাঁ যাও।”

অনিকের মা ওর ঘরের সামনে গিয়ে দরজা ধাক্কা দিয়ে অনিককে ডাকলো। অনেকক্ষণ ডাকাডাকির পরেও অনিক কোনো সাড়া না দেওয়ায় অনিকের মায়ের মনে ভয় জাগে।

“কই শুনছো? একবার এসো। ও দরজা খুলছে না।” অনিকের মা অনিকের বাবাকে ডাক দিয়ে বলে।

অনিকের বাবা এসেও অনেকবার ডাকাডাকি করে সাড়া না পেয়ে ভাড়াটিয়া অনিকের বয়সি ছেলেদুটোকে ডেকে আনে দরজা ভাঙার জন্য।

ছেলেদুটো এসে দরজা ভাঙতেই সবাই দেখে অনিক সিলিং ফ্যান থেকে ঝুলছে। সবাই হতভম্ব হয়ে যায়। অনিকের বাবা-মা কিচ্ছু বুঝতে পারেনা।

ভাড়াটিয়া ছেলেদুটো গিয়ে তাড়াতাড়ি অনিককে নামায়। কিন্তু ততক্ষণে সব শেষ। অনিকের নিঃশ্বাস পড়ছে না।

অনিকের বিছানায় পড়ে আছে ওর আজকের পরীক্ষায় অ্যাডমিট কার্ড আর একটা নোট।

নোটে লেখা, “বাবা-মা আমাকে মাফ করো। আমি হেরে গেছি।”

১৫ দিন পর,

অনিকের মা একমনে আকাশে দিকে তাকিয়ে বারান্দায় বসে আছে। চোখ দিয়ে অনবরত জল পড়ছে।

ভাড়াটিয়া ছেলেদুটো এসে অনিকের মায়ের পাশে বসলো-

একটা ছেলে বললো, “কাকিমা একটা কথা ছিল।”

চোখ মুছে নিজেকে সামলে অনিকের মা বললো, “হ্যাঁ বল।”

“আজকে অনিকের শেষ পরীক্ষাটার রেজাল্ট বেরিয়েছে। জানো কাকিমা, ও পাশ করেছে।”

অনিকের মা এটা শুনে প্রচন্ড কান্নায় ভেঙে পড়ে।

লেখক :

স্বরূপা রায়
শিলিগুড়ি, ভারত