শেয়ারবাজারে আইপিও খরা

দীর্ঘ মন্দার পর শেয়ারবাজারে ঊর্ধ্বমুখী প্রবণতা ফিরে এলেও প্রাথমিক গণপ্রস্তাবে (আইপিও) একপ্রকার খরা দেখা দিয়েছে। বিদায়ের অপেক্ষায় থাকা ২০১৭ সালে আইপিও’র মাধ্যমে অর্থ উত্তোলনের পরিমাণ আগের বছরের তুলনায় কমে চার ভাগের এক ভাগে নেমে এসেছে।

শেয়ারবাজার থেকে ২০১৭ সালে মাত্র সাতটি প্রতিষ্ঠান আইপিও ছেড়ে অর্থ উত্তোলন করেছে। প্রতিষ্ঠানগুলোর উত্তোলিত অর্থের পরিমাণ ২১৯ কোটি ২৫ লাখ টাকা। আগের বছর ২০১৬ সালে আইপিও’র মাধ্যমে ১১টি প্রতিষ্ঠান ৮৪৯ কোটি ৩০ লাখ টাকা উত্তোলন করে।

অর্থাৎ এক বছরের ব্যবধানে আইপিও’র মাধ্যমে অর্থ উত্তোলন কমেছে ৬৩০ কোটি পাঁচ লাখ টাকা। শতকরা হিসাবে এ অর্থ উত্তোলনের পরিমাণ কমেছে প্রায় ৩০০ শতাংশ।

শেয়ারবাজার সংশ্লিষ্টরা বলছেন, এ বাজারে যত কোম্পানি তালিকাভুক্ত হবে, বাজারের আকার তত প্রসারিত হবে। দায়িত্বশীলদের উচিত ভালো ভালো কোম্পানি যাতে শেয়ারবাজারে তালিকাভুক্ত হয় সে বিষয়ে পদক্ষেপ নেয়া। আইপিও’র সংখ্যা কম হওয়ায় শেয়াবাজারের প্রত্যাশিত গ্রোথ হচ্ছে না। বাজারে কোম্পানির সংখ্যা বেশি থাকলে কারসাজির পরিমাণ কমে বলেও মত দেন তারা।

তারা আরও জানান, শেয়ারবাজারে তালিকাভুক্ত হলে কোম্পানির জবাবদিহিতা বাড়ে। এ কারণে অনেক কোম্পানি তালিকাভুক্ত হতে চায় না। আবার ব্যাংক থেকে সহজেই ঋণ পাওয়া যায়, সেই ঋণ পরিশোধে গড়িমসি করলেও কোনো সমস্যা হয় না। যে কারণে কোম্পানি শেয়ারবাজারে না এসে ব্যাংক থেকে ঋণ নিচ্ছে। এ সংস্কৃতি বন্ধ করতে দায়িত্বশীলদের প্রয়োজনীয় পদক্ষেপ নিতে হবে। তাহলে শেয়ারবাজারের গ্রোথ বাড়াবে এবং দেশের অর্থনীতিরও প্রবৃদ্ধি হবে।

তথ্য পর্যালোচনায় দেখা যায়, ২০১৭ সালে আইপিও’র মাধ্যমে অর্থ উত্তোলন করা সাত প্রতিষ্ঠানের মধ্যে মিউচ্যুয়াল ফান্ড রয়েছে একটি। আইসিবি এমসিএল ফার্স্ট অগ্রণী ব্যাংক মিউচ্যুয়াল ফান্ড নামে প্রতিষ্ঠানটি উত্তোলন করেছে ৫০ কোটি টাকা।

আগের বছর ২০১৬ সালে আইপিওতে আসা মিউচ্যুয়াল ফান্ডের সংখ্যা ছিল তিনটি। ওই ফান্ড তিনটির সম্মিলিত অর্থ উত্তোলনের পরিমাণ ছিল ১৯০ কোটি টাকা। সে হিসাবে মিউচ্যুয়াল ফান্ডের মাধ্যমে বছরের ব্যবধানে অর্থ উত্তোলন কমেছে ১৪০ কোটি টাকা।

২০১৭ সালে আইপিওতে এসেছে ছয়টি কোম্পানি। কোম্পানিগুলোর সম্মিলিত উত্তোলনের পরিমাণ ১৬৯ কোটি ২৫ লাখ টাকা। আগের বছর আইপিওতে আসে আটটি কোম্পানি। কোম্পানিগুলোর উত্তোলিত অর্থের পরিমাণ ছিল ৬৫৯ কোটি ৩০ লাখ টাকা। সে হিসাবে আইপিও থেকে কোম্পানির অর্থ উত্তোলন কমেছে ৪৯০ কোটি পাঁচ লাখ টাকা।

সাবেক তত্ত্বাবধায়ক সরকারের উপদেষ্টা এবং বাংলাদেশ সিকিউরিটিজ অ্যান্ড এক্সচেঞ্জ কমিশনের (বিএসইসি) সাবেক চেয়ারম্যান এ বি মির্জ্জা আজিজুল ইসলাম বলেন, আইপিও’র মাধ্যমে অর্থ উত্তোলন কমার একটি কারণ হলো দেশে সার্বিক বিনিয়োগ পরিস্থিতি খুব একটা সন্তোষজনক নয়। বিশেষ করে সামনে নির্বাচন, এটা নিয়ে বেসরকারি খাতে বিনিয়োগে কিছুটা অনিশ্চয়তা আছে। মোট বিনিয়োগ হচ্ছে না, তাই শেয়ারবাজারেও কোম্পানি আসার পরিমাণ কমেছে।

‘দুই নম্বর কারণ হলো- আমাদের বেশিরভাগ প্রতিষ্ঠান এখনও পারিবারিক নিয়ন্ত্রণে। তারা জবাবদিহিতার কারণে শেয়ারবাজারে আসতে চান না। কারণ শেয়ারবাজারে আসলে বার্ষিক সাধারণ সভা (এজিএম) করতে হয়। শেয়ারহোল্ডারদের নিয়ে মিটিং কারতে হয়। বিএসইসি ও স্টক এক্সচেঞ্জে জবাবদিহিতা থাকে। এসব কারণে অনেক কোম্পানি শেয়ারবাজারে আসতে চায় না’- যোগ করেন মির্জ্জা আজিজুল ইসলাম।

বিশিষ্ট এ অর্থনীতিবিদ বলেন, ওই দুটি কারণের বাইরে আর একটি কারণ হলো ব্যাংকঋণ। আমাদের দেশে সংস্কৃতি হয়ে গেছে যে, ব্যাংক থেকে ঋণ নিলে তা আর পরিশোধ করতে হয় না। সে কারণে অনেকে ব্যাংক থেকে ঋণ নেন। তারা ভাবেন, যখন ঋণ পরিশোধ করতে পারি, তখন পরিশোধ করবো। আর না পারলে পরিশোধ করবো না। শেয়ারবাজারে তো সেই সুযোগ নেই। এসব কারণে আইপিও কমেছে।

তিনি আরও বলেন, বাজার এখন যে পরিস্থিতিতে রয়েছে তাতে আইপিও’র পরিমাণ বাড়া উচিত ছিল। আইপিও কম আসার কারণে সার্বিক শেয়ারবাজারের যে গ্রোথ আমরা আশা করি সেটা হচ্ছে না। আমাদের আরও বেশি কোম্পানির তালিকাভুক্তি দরকার। যাতে কোম্পানির বৈচিত্র্য থাকে। বেশি কোম্পানি বাজারে থাকলে মেনুপুলেশনের (কারসাজি) সুযোগ কম থাকে।

ইসলামী বিশ্ববিদ্যালয়ের ফিন্যান্স অ্যান্ড ব্যাংকিং বিভাগের সহকারী অধ্যাপক মো. বখতিয়ার হাসান বলেন, যারা প্রিমিয়াম চাচ্ছে তাদের বুক বিল্ডিং পদ্ধতিতে আসতে হচ্ছে এবং বুক বিল্ডিং পদ্ধতিতে আসতে নানা প্রক্রিয়া সম্পন্ন করতে হয়, এতে দীর্ঘ সময় লাগে। যে কারণে আইপিওতে আসা কোম্পানির সংখ্যা কম। এছাড়া সার্বিক বিনিয়োগের পরিবেশও ভালো নয়, তাই অর্থ উত্তোলনের পরিমাণ কম। আবার যেটুকু অর্থের প্রয়োজন হচ্ছে তা সহজেই ব্যাংক থেকে কোম্পানি নিতে পারছে। এসব কারণে আইপিও’র পরিমাণ কমেছে।

তথ্য পর্যালোচনায় দেখা যায়, ২০১৭ সালে একমাত্র ‘আমরা নেটওয়ার্কস’ প্রিমিয়াম নিয়ে আইপিওতে এসেছে। সংগত কারণে এ কোম্পানির আইপিও’র মাধ্যমে সব থেকে বেশি অর্থ উত্তোলন করেছে। কোম্পানিটির উত্তোলিত অর্থের পরিমাণ ৫৬ কোটি ২৫ লাখ টাকা। এর মধ্যে প্রিমিয়াম বাবদ কোম্পানিটি নিয়েছে ৪১ কোটি ২০ লাখ টাকা।

এছাড়া বছরটিতে আইপিও’র মাধ্যমে অর্থ উত্তোলন করা কোম্পানিগুলোর মধ্যে- শেফার্ড ইন্ডাস্ট্রিজ ২০ কোটি, নূরানী ডাইং ৪৩ কোটি, বিবিএস কেবলস ২০ কোটি, ওয়াইম্যাক্স ইলেকট্রোড ১৫ কোটি এবং নাহি অ্যালুমিনিয়াম ১৫ কোটি টাকা উত্তোলন করেছে।