সংসদ নির্বাচন : দেড় লাখ ইভিএম কিনছে ইসি

জরুরি ভিত্তিতে দেড় লাখ ইলেকট্রনিক ভোটিং মেশিন (ইভিএম) কিনতে যাচ্ছে নির্বাচন কমিশন (ইসি)। আগামী জাতীয় সংসদ নির্বাচনের কিছু ভোট কেন্দ্রে এসব মেশিন ব্যবহার করা হতে পারে। আসন্ন জাতীয় সংসদ নির্বাচনে সম্ভাব্য ভোট কেন্দ্রের সংখ্যা ৪৪ হাজার। মেশিনগুলো কেনার লক্ষ্যে নির্বাচন কমিশন গত সপ্তাহে একটি প্রকল্প অনুমোদন করে পরিকল্পনা কমিশনে পাঠিয়েছে।

‘নির্বাচন ব্যবস্থাপনায় অধিকতর স্বচ্ছতা আনার লক্ষ্যে ইলেকট্রনিক ভোটিং মেশিন (ইভিএম) ক্রয়, সংরক্ষণ ও ব্যবহার’ শীর্ষক এ প্রকল্পে ব্যয় ধরা হয়েছে ৩ হাজার ৮২১ কোটি ৪০ লাখ ৬০ হাজার টাকা।এর সিংহভাগই ব্যয় হবে ইভিএম কেনার খাতে। প্রতি ইউনিট ইভিএমের দাম পড়ছে প্রায় দুই লাখ টাকা।

রোববার এ প্রকল্পের ওপর পিইসি (প্রকল্প মূল্যায়ন কমিটির) সভা অনুষ্ঠিত হবে। এছাড়া ইভিএম সাধারণ মানুষের মধ্যে জনপ্রিয় করতে শিগগিরই ‘ইভিএম মেলা’র আয়োজন করতে যাচ্ছে কমিশন। ইসি সচিবালয় সূত্রে জানা গেছে এসব তথ্য।

আগামী জাতীয় সংসদ নির্বাচন সামনে রেখে ইসির সংলাপে বিএনপিসহ বেশির ভাগ দল নির্বাচনে ইভিএম ব্যবহারের বিপক্ষে মত দিয়েছিল। তবে আওয়ামী লীগ ও তাদের সমমনা কয়েকটি দল মেশিনে ভোট গ্রহণের পক্ষে মত দেয়।

প্রধান নির্বাচন কমিশনার (সিইসি) কেএম নুরুল হুদা একাধিকবার বলেছেন, সবাই না চাইলে জাতীয় সংসদ নির্বাচনে ইভিএম ব্যবহার করা হবে না। তবে সম্প্রতি এক বক্তব্যে ইসি সচিব হেলালুদ্দীন আহমদ গণপ্রতিনিধিত্ব আদেশ, ১৯৭২ সংশোধন করে ইভিএম ব্যবহারের বিধান অন্তর্ভুক্তের ইঙ্গিত দেন।

এছাড়া আইন সংস্কার কমিটিও আরপিও সংশোধন প্রস্তাবে ইভিএম অন্তর্ভুক্তির সুপারিশ করেছে। নির্বাচন বিশ্লেষকরা বলছেন, সাধারণ মানুষের আস্থা অর্জন না করে এ মেশিনে ভোট গ্রহণ করা ঠিক হবে না। পাশাপাশি এ মেশিন পরিচালনায় দক্ষ জনবলও তৈরি করতে হবে।

দু’জন নির্বাচন কমিশনারের সঙ্গে আলাপ করে জানা গেছে, দেড় লাখ ইউনিট ইভিএম কেনার প্রকল্পটি তৈরি করে যৌথভাবে নির্বাচন কমিশন সচিবালয় ও এর আওতাধীন জাতীয় পরিচয় নিবন্ধন অনুবিভাগ। এ প্রকল্পটি কমিশন সভায় তোলা হয়নি, তবে প্রশাসনিকভাবে অনুমোদন করা হয়েছে। জাতীয় নির্বাচনে ইভিএম ব্যবহার করে ভোট গ্রহণের ক্ষেত্রে কমিশনের অনুমোদনের প্রয়োজন হবে।

এ বিষয়ে জানতে চাওয়া হলে নির্বাচন কমিশনার মো. রফিকুল ইসলাম বলেন, জাতীয় সংসদ নির্বাচনে ইভিএম ব্যবহার করে ভোট গ্রহণের বিষয়ে সিদ্ধান্তের জন্য কমিশন সভায় উপস্থাপিত হয়নি। কমিশনে এমন সিদ্ধান্তের জন্য উপস্থাপন করা হলে তখন সংগ্রহকৃত ইভিএমের সংখ্যা, দক্ষ জনবল ও ব্যবহারকারীদের অবস্থাসহ সার্বিক দিক পর্যালোচনা করে সিদ্ধান্ত নেয়া হবে। দেড় লাখ ইভিএম কেনার প্রকল্প গ্রহণের বিষয়ে দৃষ্টি আকর্ষণ করা হলে এ নির্বাচন কমিশনার বলেন, এটা প্রশাসনিক বিষয়। প্রধান নির্বাচন কমিশনার (সিইসি) ও সচিব এসব বিষয় দেখভাল করেন। এটি মূলত ইসি সচিবালয়ের কাজ। অপর এক নির্বাচন কমিশনার এ বিষয়ে কিছু বলতে চাননি।

ইসির যুগ্মসচিব পর্যায়ের এক কর্মকর্তা নাম গোপন রাখার শর্তে বলেন, সংসদ নির্বাচনে সম্ভাব্য ভোট কেন্দ্রের সংখ্যা ৪৪ হাজার। এতে ২ লাখ ২০ হাজার ভোটকক্ষ ধরা হয়েছে। প্রতিটি ভোটকক্ষের জন্য একটি ও প্রতিটি কেন্দ্রে মোট ভোটকক্ষের অতিরিক্ত একটি ইভিএম রাখার নিয়ম। এ হিসাব অনুযায়ী, পুরো নির্বাচনে ২ লাখ ৬৪ হাজার ইউনিট ইভিএম দরকার হবে। কিন্তু ইসির হাতে এত ইভিএম নেই। এ প্রকল্প বাস্তবায়ন হলে এবং নির্বাচন কমিশন সিদ্ধান্ত নিলে আগামী সংসদ নির্বাচনে অর্ধেকের বেশি আসনে এ ইভিএম ব্যবহার করে ভোট গ্রহণ করা সম্ভব হবে।

এ কর্মকর্তা জানান, বর্তমানে কমিশন প্রথমে ২ হাজার ৫৩৫টি ইভিএম কেনার সিদ্ধান্ত নেয়। তার মধ্যে ৩৮০টি এসে পৌঁছেছে। এরই মধ্যে দেড় লাখ ইলেকট্রনিক ভোটিং মেশিন (ইভিএম) কেনার নতুন প্রকল্প হাতে নেয়া হল।

তবে সাধারণ মানুষের আস্থা অর্জন না করে জাতীয় নির্বাচনে ইভিএম ব্যবহার করা সঠিক হবে না বলে মনে করেন সাবেক নির্বাচন কমিশনার মোহাম্মদ ছহুল হোসাইন। তিনি বলেন, ইভিএমে কারচুপি হবে না এমন বিশ্বাস অর্জন করতে হবে, মানুষকে আশ্বস্ত করতে হবে। তাদের এ মেশিন ব্যবহারের উপকারিতা ও সুযোগ-সুবিধা সম্পর্কে ধারণা দিতে হবে। তারপরই ইভিএম ব্যবহার করা যেতে পারে। তিনি বলেন, শুধু মেশিন কিনলেই হবে না, দক্ষ জনবল ও জনসচেতনতা তৈরি করতে হবে।

জানা গেছে, ইসির এ প্রকল্পে ৬টি খাতে ব্যয় ধরা হয়েছে। এতে দেড় লাখ ইভিএম মেশিন ক্রয়, ভোটারদের মধ্যে জনসচেতনতামূলক কার্যক্রম গ্রহণ ও বাস্তবায়ন, নির্বাচন কর্মকর্তাদের প্রশিক্ষণ ও দক্ষতা বৃদ্ধির কথা বলা হয়েছে। এসব মেশিন বিভিন্ন পর্যায়ের নির্বাচনে ব্যবহার করা হবে বলেও প্রকল্পের ডিপিপিতে উল্লেখ করা হয়েছে। প্রকল্পটি ৫ বছর মেয়াদে (জুলাই ২০১৮ থেকে ২০২৩ সালের জুন) বাস্তবায়ন করা হবে। প্রকল্পের অন্যতম উদ্দেশ্য- দ্রুত সময়ের মধ্যে নির্বাচনের ফল প্রকাশ ও নির্বাচন ব্যবস্থাপনায় আস্থা ফেরানো।

জানা গেছে, কমিশনের ২২তম সভায় বিভিন্ন পর্যায়ের নির্বাচনে ইভিএম ব্যবহার সংক্রান্ত একটি প্রকল্প গ্রহণের সিদ্ধান্ত নেয়া হয়। এরপর ইসির পরিকল্পনা ও উন্নয়ন শাখার এক চিঠির পরিপ্রেক্ষিতে নির্বাচন ব্যবস্থাপনা শাখা তাদের জবাবে জানায়, গত জুলাই থেকে ২০২৩ সালের জুন পর্যন্ত একাদশ জাতীয় সংসদ, ১১টি সিটি কর্পোরেশন, ৩২৩টি পৌরসভা ও ৪ হাজার ৫৫৫টি ইউনিয়ন পরিষদ নির্বাচন অনুষ্ঠিত হবে।

এতে বলা হয়েছে, সংসদ নির্বাচনে সম্ভাব্য ৪৪ হাজার ভোট কেন্দ্রে ২ লাখ ২০ হাজার ভোটকক্ষ থাকবে। এতে ২ লাখ ৬৪ হাজার ইউনিট ইভিএম প্রয়োজন হবে বলে উল্লেখ করা হয়েছে। ১১টি সিটি কর্পোরেশনে সম্ভাব্য ৫ হাজার কেন্দ্রে ৩০ হাজার ভোটকক্ষে ৩৫ হাজার ইভিএমের প্রয়োজন হবে। ৩২৩টি পৌরসভায় সম্ভাব্য চার হাজার কেন্দ্রের ২৪ হাজার ভোটকক্ষে ২৮ হাজার এবং ৪ হাজার ৫৫৫টি ইউনিয়ন পরিষদে ৪৫ হাজার ৫০০ কেন্দ্রের ২ লাখ ৭৩ হাজার কক্ষে ৩ লাখ ১৮ হাজার ৫০০ ইভিএম প্রস্তাব করা হয়েছে।

প্রকল্প সংশ্লিষ্ট একজন কর্মকর্তা জানান, প্রতি ইউনিট ইভিএমের দর প্রথমে ২ লাখ ৪০ হাজার টাকা প্রস্তাব করা হয়েছিল। পরে তা কমিয়ে প্রায় দুই লাখ টাকায় নামিয়ে আনা হয়েছে। সর্বশেষ কমিশন যে ১৯০ সেট ইভিএম সংগ্রহ করেছে তার দর পড়েছে ১ লাখ ৯২ হাজার ৯৭৫ টাকা। যদিও প্রকল্পে প্রস্তাবিত ইভিএমের দর ড. হুদা কমিশনের কেনা ইভিএমের চেয়ে কয়েকগুণ বেশি।

এর আগে ড. শামসুল হুদার নেতৃত্বাধীন কমিশন প্রথমবার নির্বাচনে ইভিএম ব্যবহার করে। প্রথম পর্যায়ে ২০০৯ সালে বাংলাদেশ প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয় (বুয়েট) থেকে ১১ হাজার ৫৫৬ টাকা দরে ১৩০ ইউনিট ইভিএম সংগ্রহ করে ওই কমিশন। দ্বিতীয় ধাপে একই প্রতিষ্ঠান থেকে ৩২ হাজার ৫৪৭ টাকা দরে ৪০০টি ও তৃতীয় পর্যায়ে মেশিন টুলস ফ্যাক্টরি (বিএমটিএফ) থেকে ৪৬ হাজার ৫০১ টাকা দরে ৭০০টি সব মিলিয়ে ১ হাজার ২৩০ ইউনিট কিনেছিল ড. হুদা কমিশন।

২০১৩ সালে রাজশাহী সিটিসহ কয়েকটি নির্বাচনে যান্ত্রিক ত্রুটির কারণে ইভিএমে নির্বাচন না করার সিদ্ধান্ত নেয় বিগত কাজী রকিবউদ্দীন কমিশন। বর্তমান কমিশন দায়িত্ব নেয়ার পর ইভিএমে প্রযুক্তিগত ব্যাপক উন্নতি এনেছে।

প্রকল্পের মাধ্যমে কেনা ইভিএম ২০১৯ সালের শুরুতে অনুষ্ঠেয় উপজেলা নির্বাচনে ব্যাপকভাবে ব্যবহার করা হবে বলে জানিয়েছেন নির্বাচন কমিশন সচিব হেলালুদ্দীন আহমদ। তিনি বলেন, জাতীয় সংসদ নির্বাচনের এক মাস পরই ধাপে ধাপে উপজেলা নির্বাচন অনুষ্ঠিত হবে। ওই নির্বাচনে ব্যাপকভাবে ইভিএম ব্যবহার করা হবে। আর সব পক্ষ একমত হলে জাতীয় নির্বাচনেও ইভিএম ব্যবহার করা হতে পারে।

এক প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, স্থানীয় সরকার নির্বাচনে ইভিএম ব্যবহারের পরিধি বাড়ানোর সিদ্ধান্ত কমিশনের রয়েছে। এ কারণে ইসি সচিবালয় প্রকল্প তৈরি করে তা পরিকল্পনা কমিশনে পাঠিয়েছে।

ইভিএম পরিচালনা খাতে ব্যয় হচ্ছে লাখ লাখ টাকা : ইসি সচিবালয় সূত্রে জানা গেছে, বর্তমান কমিশনের সময়ে রংপুর, খুলনা, গাজীপুর, সিলেট, রাজশাহী ও বরিশাল সিটি কর্পোরেশন এবং কক্সবাজার পৌরসভার কিছু কেন্দ্রে ইভিএম ব্যবহার করে ভোট গ্রহণ করা হয়েছে। এসব কেন্দ্রে ইভিএম পরিচালনা খাতে ব্যয় হচ্ছে লাখ লাখ টাকা।

রংপুর সিটি কর্পোরেশনের ভোটে একটি কেন্দ্রের জন্য ৩ লাখ ৯৪ হাজার টাকা এবং খুলনার দুটি কেন্দ্রের ভোট পরিচালনায় ৬ লাখ ৬৯ হাজার টাকা ব্যয় হয়েছে। চলতি অর্থবছরে সিলেট সিটির দুটি কেন্দ্রের জন্য ৪ লাখ ১ হাজার ৫০০ টাকা, বরিশালের ১১টি কেন্দ্রের জন্য ১৭ লাখ ৩১ হাজার টাকা, রাজশাহীর দুটি কেন্দ্রের জন্য ৪ লাখ ১ হাজার টাকা খরচ হয়েছে।

এর মধ্যে বরিশাল সিটিতে একটি কেন্দ্রের ইভিএম অকার্যকর ছিল। সেখানে প্রচলিত পদ্ধতিতে ভোট গ্রহণ করা হয়। পরিচালনা খাতে ইভিএম সেটসহ আনুষঙ্গিক মালামাল পরিবহন, টিমের কর্মকর্তা-কর্মচারীদের সম্মানী ভাতা, গাড়ি ভাড়া, ডেকোরেটর সামগ্রী ভাড়া, স্ক্রিনসহ মাল্টিমিডিয়া প্রজেক্টর-শব্দযন্ত্র ভাড়া, মাইকিংসহ বিভিন্ন খাতে এ টাকা ব্যয় হয়েছে।-যুগান্তরের সৌজন্যে