সন্তানের লাশের পাশেই ধর্ষিত হয় রোহিঙ্গা নারীরা

রাখাইনে থাকা রোহিঙ্গাদের উপর গণহত্যা ও গণধর্ষণের প্রমাণ বিশ্ব বিবেকের কাছে হাজির হচ্ছে নিত্য-নতুনভাবে। জাতিসংঘ পর্যন্ত বলেছে, গণধর্ষণকে অস্ত্র হিসেবে বেছে নিয়েছে মিয়ানমার সেনাবাহিনী। রোহিঙ্গাদের মধ্যে আতঙ্ক ও ভীতি ছাড়তেই পরিকল্পনা করেই এই ঘৃণ্য কাজ করেছে তারা। এবার আরেকটি সংবাদ সংস্থার অনুসন্ধানেও মিললো সেই প্রমাণ।

রোহিঙ্গা নারীদের ওপর মিয়ানমার সেনাবাহিনীর যৌন নিপীড়নের ঘটনা অনুসন্ধান করতে গিয়ে সংঘবদ্ধ ও পরিকল্পিত ধর্ষণের আলামত পেয়েছে মার্কিন বার্তা সংস্থা এপি। এক অসুন্ধানী প্রতিবেদনে তারা জানিয়েছে, কখনও সামনে স্বামীকে বেঁধে রেখে, কখনও আবার স্বামী-সন্তানকে হত্যার পর ধর্ষণ করা হয় ওই নারীদের।

ধর্ষণের আগে-পরে রোহিঙ্গা নারীদের যোনিতে বন্দুকের নল ঢুকিয়ে দেওয়ার মতো ঘটনাও জানতে পেরেছেন এপির প্রতিবেদক। বাংলাদেশের শরণার্থী শিবিরে অবস্থানরত ২৯ রোহিঙ্গা নারীর সঙ্গে পৃথক পৃথক সাক্ষাৎকারের ভিত্তিতে এই প্রতিবেদন তৈরি করা হয়েছে। ধর্ষণের শিকার হওয়া নারীদের সংখ্যা জেনে আশ্চর্য্য হতে হয়েছে এপির প্রতিবেদককে।

তবে এ অপকর্মের বিষয়ে মিয়ানমার সেনাবাহিনীর বক্তব্য নেয়ার চেষ্টা করলেও কোনও সাড়া পায়নি এপি। এরআগে জাতিসংঘ এবং দুই ব্রিটিশ সংবাদমাধ্যম বিবিসি ও গার্ডিয়ানের পৃথক তিন অনুসন্ধানে একইরকম বাস্তবতা উঠে এসেছিল। মিয়ানমার সেনাবাহিনীর পরিকল্পিত ধর্ষণের কথা সে সময় থেকেই প্রমাণিত হয়ে আসছে।

গত ২৫ আগস্টের পর রোহিঙ্গাদের ওপর নির্যাতনের চিত্র উঠে আসে সবার সামনে। মিয়ানমারের সেনাবাহিনীর নিধনযজ্ঞ থেকে বাংলাদেশে পালিয়ে আসে ছয় লাখেরও বেশি রোহিঙ্গা। তাদের মুখে উঠে আসে সেনাবাহিনীর বর্বরতার চিত্র। পালিয়ে আসা এমন ২৯ জন নারীর সঙ্গে কথা বলেছে এপি।

তাদের বয়স ১৩ থেকে ৩৫ এর মধ্যে। ২০১৬ অক্টোবর থেকে চলতি বছর সেপ্টেম্বরের মাঝামাঝি পর্যন্ত এই নিপীড়ন চলে। পৃথকভাবে তাদের সাক্ষাতকার নেওয়া হলেও সবার ঘটনা প্রায় একই বলে জানায় তারা। প্রত্যেকেই নিজের নামের প্রথম অক্ষর বলতে রাজি হয়েছেন। এপি জানায়, রোহিঙ্গাদের ওপর ধর্ষণ ছিলো পরিকল্পিত ও সংঘবদ্ধ।

পুলিৎজার সেন্টার অন ক্রাইসিস রিপোর্টিংয়ের অর্থায়নে বিশেষ এই প্রতিবেদন তৈরি করে এপি। জাতিসংঘ রোহিঙ্গাদের বিশ্বের সবচেয়ে নিপীড়িত জনগোষ্ঠী বলে চিহ্নিত করেছে। রোহিঙ্গাদের বেশিরভাগেই বসবাস এখন বাংলাদেশে। তাদের সঙ্গেই কথা বলেছে এপি। তারা নাম প্রকাশ করতে রাজি হননি। তাদের আশঙ্কা এতে করে তাদের পরিবারকে খুন করতে পারে মিয়ানমারের সেনাবাহিনী। ‘এফ’ নামে একজন বলেন, জুন মাসের এক রাতে ঘুমাচ্ছিলেন তিনি ও তার স্বামী। হঠাৎ মাঝ রাতে তাদের দরজা ভেঙে ঢুকে পড়ে সাতজন সেনা।

তখনই বুঝে যান কি ঘটতে চলেছে তার সঙ্গে। তার বাবা-মা ও ভাই খুন হয়েছে এই সেনা সদস্যদের হাতে। আর এবার আসলো তার জন্য। এসেই তার স্বামীকে বেঁধে ফেলে, মুখে কাপড় গুজে দেয়। অসহায় হয়ে পড়ে দুজনই। এরপর সংঘবদ্ধ ধর্ষনের শিকার হন ওই নারী। একইসঙ্গে চলতে থাকে বেত্রাঘাত। একটা সময় মুখের কাপড় ফেলতে চিৎকার করতে সক্ষম হয় তার স্বামী।

কিন্তু তখনই সেনারা গুলি করেন। একজন কেটে ফেলেন গলা। আর ধর্ষণের পর তাকে বাইরে এনে পুড়িয়ে দেন বাড়ি। দুই মাস পর এফ জানতে পারেন তিনি গর্ভবতী।

নিপীড়নের শিকার প্রত্যেক নারীই বলেন, মিয়ানমারের সেনাবাহিনীর একদল কর্মী এই কাজে যুক্ত ছিলো। একজন বাদে প্রত্যেক নারীই বলেছেন যে হামলকারীদের পরনে সেনাবাহিনীর মতো ইউনিফর্ম ছিলো। যেই একজন বলেছিলেন যে হামলাকারী সামরিক পোশাকে ছিলেন না তাকেও সেনাঘাঁটিতে দেখেছেন প্রতিবেশীরা।

অনেক নারী জানান, হামলাকারীদের পোশাকে তারা, তীর কিংবা সামরিক বাহিনীর অন্যান্য চিহ্ন দেখতে পেয়েছেন। ‘এফ’ এর মতোই ধর্ষণের শিকার হয়েছেন প্রায় সবাই। প্রথমে পুরুষদের কাছ থেকে তাদের আলাদা করে ফেলা হয়। এরপর অন্য কোথাও নিয়ে গিয়ে সংঘবদ্ধ ধর্ষণ করা হয় তাকে।

ধর্ষণের শিকার নারীরা জানান, চোখের সামনেই হত্যা করা হয় তাদের সন্তানদের। স্বামীকে গুলি করে বা পিটিয়ে মেরে ফেলা হয়। প্রিয়জনকে মাটি দিয়ে রাতের অন্ধকারেই পালিয়ে আসতে হয় সবাইকে। নিপীড়নের কথা বলতেই থাকেন নারীরা। সেই কষ্ট নিয়েই পায়ে হেটে লম্বা পথ পাড়ি দিয়ে আসেন বাংলাদেশে।

‘এন’ নামে একজন বলেন, তিনি ধর্ষণের পর বেঁচে গেছেন। কিন্তু নিজের স্বামী, দেশ ও শান্তি হারিয়েছেন। তারপরও তিনি কথা বলেন হয়তো কেউ তার কথা শুনবেন। তিনি বলেন, ‘আমার কিছুই নেই। আমি শুধু কথাই বলতে পারি।’

এপি থেকে সেনাবাহিনীর সঙ্গে কথা বলতে চাওয়া হলেও বারবার প্রত্যাখান করেছে তারা। তবে সরকারি এক গবেষণায় তারা দাবি করেছে যে সেনাবাহিনী কোনও নিধনযজ্ঞে জড়িত ছিলো না। এমনটি সেনা কর্মকর্তা তিন্ত সোয়ে বলেছিলেন, রোহিঙ্গা নারীরা ধর্ষণের মতো আকর্ষণীয় না। তবে চিকিৎসক ও ত্রাণ কর্মীরা জানিয়েছেন তারা ধর্ষণের সংখ্যা দেখে বিস্মিত। মূল সংখ্যার অল্প কয়েকজনই হয়তো সামনে এসেছেন। মেডিসিন স্যানস ফ্রন্টিয়ার জানায়, তারা ধর্ষণের শিকার ১১৩ জনের চিকিৎসা করেছেন। তাদের এক তৃতীয়াংশই ১৮ বছরের নিচে। সবচেয়ে কম বয়সীজনের বয়স ৯ বছর।

ড. মিসবাহ উদ্দিন একজন সরকারি স্বাস্থ্য কর্মকর্তা। তার স্বাস্থ্য কেন্দ্রে প্রচুর নারী ও শিশু চিকিৎসা নিতে আসে। ব্যাপারটি নিয়ে খুবই উদ্বিগ্ন তিনি। তিনি রোগীদের ফাইল বের করে দেখাতে থাকেন কিভাবে ধর্ষণের শিকার হয়েছেন তারা। ৫ সেপ্টেম্বর ৭ মাসের একজন গর্ভবতী নারীকে ধর্ষণ করে তিন সেনা।

আরেকজন জানান, ২০ দিন আগে ঘুমিয়ে থাকা অবস্থায় তার বাড়িতে হামলা চালায় তিন সেনা এবং ধর্ষণ করে। অপর এক নারী জানান। দুই এক মাস আগে দুই সেনা তার বাড়িতে হামলা চালিয়ে তার স্বামীকে মারতে থাকে। এরপর তাকে ধর্ষণ করে। মিসবাহ আহমেদ বলেন, যারা চিকিৎসা নিতে আসে তারা কোনও উপায় না পেয়ে আসে। আর বাকিরা নীরবে কষ্ট সহ্য করে যায়।

হামলার মাত্রা এখন অনেক তীব্র হলেও মিয়ানমারের সেনারা নতুন করে এটি করছে না। অং সান সু চি নিজেও নির্বাচিত হওয়ার আগে সেনাবাহিনীর সমালোচনা করেন। ২০১১ সালে এক ভিডিও বার্তায় তিনি বলেছিলেন, ‘ধর্ষণই রাইফেল। এটাই হাতিয়ার হিসেবে ব্যবহার করছে মিয়ানমারের সেনাবাহিনী।’আর এখন সু চি সরকার সেনা বর্বরতা নিন্দা জানাতে শুধু ব্যর্থই হয়নি বরং অভিযোগগুলো মিথ্যা বলে উড়িয়ে দিয়েছে। আহমেদ বলেন, এই নারীদের অবিশ্বাস করার কোনও সুযোগই নেই। এরপর একের পর এক ফাইল দেখাতে থাকেন তিনি।

গাইনোকোলজিস্ট আরজিনা আখতার এই হত্যাযজ্ঞের ফল দেখেছেন। আগস্টের পর থেকে এত নারী তার হাসপাতালে আসতে শুরু করে যে তিনি ফর্ম পূরণ করতে না করেছেন। এতে করে দ্রুত চিকিৎসা করার সুযোগ পাচ্ছেন তিনি। সেপ্টেম্বর ও অক্টোবরে অন্যান্য নারীদের সঙ্গে ২০-৩০ জন ভর্তি হয়েছেন যারা ধর্ষণের শিকার হয়েছেন। ক্ষতের কথা বলতে গিয়ে তিনি জানান, বন্দুকের নল নারীদের যোনির ভেতর প্রবেশ করানো হয়। প্রবেশ করানো হয় ধারালো বস্তুও। সাম্প্রতিক সময়ে অনেকে গর্ভপাতের জন্য আসেন। আরজিনা জানান, এখন সেটা সম্ভব না। তবে শিশুদের দায়িত্ব নেয়ার প্রতিশ্রুতি দিয়েছেন তিনি।

কিন্তু এখনও অনেক রোহিঙ্গা বাচ্চা নিতে চাইছেন না বলে জানান আরজিনা। তবে ২৫ আগস্ট পরিস্থিতি আরও খারাপ হয়। ধর্ষণের পর তার প্রতিবেশীরা ‘এফ’ এর সেবা করেছিলেন। তিন মাস পরেও তার দুর্দশা কাটেনি। তার বাড়ি পুড়ে গেছে। স্বামী মারা গেছে। পেটের সন্তান নিয়ে নিশ্চিত নন। তার চাওয়া ছিলো পরিস্তিতি যেন আর খারাপ না হয়। তবে সেপ্টেম্বরের মাঝামাঝি পরিস্থিতি আবারও খারাপ হয়। প্রতিবেশীর বাড়িতে ঘুমিয়ে থাকার সময় সেনারা বাড়িতে হামলা চালায়। এবার ছিলেন পাঁচজন। ঢুকেই ৫ বছরের ছেলেকে জবাই করে সেনারা। হত্যা করে পুরুষকে। এরপর তার স্ত্রী ও এফ এর দিকে এগোতে থাকে সেনারা।

আবারও সেই দুঃস্বপ্ন শুরু হয় ‘এফ’ এর। দুইজন সেনা এফ এর পেট চেপে ধরে। অন্য নারী প্রতিরোধের চেষ্টা করলে তাকেও মারতে থাকে সেনারা। একটা সময় হাল ছেড়ে দেয়া ছাড়া উপায় ছিলো না তার। সংঘবদ্ধ ধর্ষণের শিকার হন সে নারী। এরপর তাদের ফেলে চলে যায় হামলাকারীরা। মাটিতেই পড়েছিলেন তারা।

ব্যাথা ও মানসিক যন্ত্রণায় উঠে দাঁড়ানোর শক্তিও ছিলো না তাদের। কিন্তু একটা সময় জেগে উঠেন। দুই বন্ধু হাতে হাত রেখে উঠে দাঁড়ানোর চেষ্টা করেন। খুড়িয়ে খুড়িয়ে যান পাশের গ্রামে। সেখানে পাঁচদিন থেকে যাত্রা করেন বাংলাদেশের পথে।

বাংলাদেশে আশ্রয় নেয়া রোহিঙ্গাদের মধ্যে ৭০ শতাংশই নারী। বাংলাদেশে নিরাপাদে থাকলেও ভয়াবহ সেই নির্যাতনের ছোবল এখনও তাদের মন থেকে যায়নি। ক্যাম্পে নারীদের জন্য বিশেষ কাউন্সিল টিমের কাছে ধীরে ধীরে তাদের উপর নির্যাতনের কথা বলতে শুরু করেছেন রোহিঙ্গা নারীরা।