‘সরকারি কর্মচারী দিয়ে কখনও সুষ্ঠু নির্বাচন হবে না’

সাবেক প্রধান নির্বাচন কমিশনার (সিইসি) বিচারপতি মোহাম্মদ আব্দুর রউফ বলেছেন, ‘আমাদের দেশে সুষ্ঠু নির্বাচনের সবচেয়ে বড় বাধা হচ্ছে বিশৃঙ্খলা। এটা ঠিক করতে না পারলে পারমাণবিক শক্তি দিয়েও নির্বাচন সুষ্ঠু করা যাবে না। সুষ্ঠু নির্বাচনের জন্য ভোটারকেই দায়িত্ব দিতে হবে। ফাইভ স্টার, থ্রি স্টার নিয়ে ভোটের দিন ঘোরার দরকার নেই। এসপি, ডিসি’র দরকার নেই। ভোটাররাই তাদের এলাকার পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণ করবে। এজন্য ৫শ’ জন ভোটারের একটি স্থায়ী ভোটকেন্দ্র গড়ে দিতে হবে। সরকারি কর্মচারী দিয়ে সুষ্ঠু নির্বাচন হবে না।’

মঙ্গলবার নির্বাচন কমিশনের সঙ্গে বিশেষজ্ঞদের সংলাপ শেষে সাংবাদিকদের প্রশ্নের জবাবে এসব কথা বলেন তিনি। বেলা ১১টায় রাজধানীর আগারগাঁওয়ের নির্বাচন ভবনে সাবেক নির্বাচন কমিশনার ও সচিবদের সঙ্গে সংলাপে বসে ইসি। প্রধান নির্বাচন কমিশনার (সিইসি) কে এম নুরুল হুদা সংলাপে সভাপতিত্ব করেন। সংলাপে অন্যান্য কমিশনারসহ ইসির ভারপ্রাপ্ত সচিব হেলালুদ্দীন আহমদ উপস্থিত ছিলেন।

তত্ত্বাবধায়ক সরকারের সাবেক সিইসি এটিএম শামসুল হুদা বলেন, দীর্ঘমেয়াদি চিন্তা করতে হবে নির্বাচন কমিশনকে কার্যকরী পদক্ষেপ নিতে হবে। ইসিকে অনেক শক্তিশালী করতে হবে। মানবসম্পদ উন্নয়ন করতে হবে। ভবিষ্যতে সুষ্ঠু নির্বাচন করতে গেলে ইসির নিজস্ব কর্মকর্তাদের রিটার্নিং করতে হবে।

নির্বাচনকালীন সরকার ব্যবস্থা সম্পর্কে তিনি বলেন, কিছু জিনিস আছে যা ইসির আওতাভুক্ত। কিছু জিনিস আছে ইসির কিছুই করার নেই। জাতীয় নির্বাচনের আগে এ ডায়লগে এর সমাধান হবে না। কেননা, নির্বাচনের আর এক বছর বাকি আছে। নির্বাচন সুষ্ঠু করার দায়িত্ব শুধু ইসির একার নয়। অনেক প্লেয়ার আছে, দলগুলোর অনেক দায়িত্ব আছে। গত নির্বাচন ‘বিএনপি’ বয়কট করায় নির্বাচনের কালচারের ক্ষতি হয়েছে। এজন্য দলগুলোকে সজাগ থাকতে হবে, যেন সবাই নির্বাচনে আসে।

তিনি আরও বলেন, একাদশ সংসদ নির্বাচনের কথা যদি বলেন, তত্ত্বাবধায়ক সরকারের কথা যদি বলেন, এটা আর হবে না। এটা পারবেন না। যে পরিবেশ এবং আস্থা আছে এটা মেনে নিয়ে নির্বাচন করতে হবে। ইসি তো এ পরিবর্তন আনতে পারে না। সুতরাং এ নিয়ে আমাদের আলাপই হয়নি। কেননা, এটা পিউরলি রাজনৈতিক দলগুলোর বিষয়। তারা এটা শুধু নির্বাচনের আগে কেন বলবে?

বিচারিক ক্ষমতা দিয়ে সেনা মোতায়েন সম্পর্কে তিনি বলেন, বর্তমান আইন অনুযায়ী এখন নির্বাহী ও জুডিশিয়াল আলাদা। তাই বিচারিক ক্ষমতা নিয়ে সেনা মোতায়েন সম্ভব নয়। ভোটাররা যেন নির্ভয়ে ভোট দিতে পারে এবং বাড়ি ফিরতে পারে সে ব্যবস্থা করতে হবে। সেটা বিজিবি, র‌্যাব এবং পুলিশের মাধ্যমেই করা সম্ভব।

তিনি বলেন, নির্বাচনে সব পার্টির আসার জন্য ইসির চ্যালেঞ্জ হচ্ছে-তাদের কাজকর্মে নিরপেক্ষতা প্রমাণ করতে হবে। এমন কিছু করবেন না যেন আস্থা ক্ষুণ্ন হয়। কিছুটা আস্থা তৈরি হয়েছে এটাকে ধারণ করতে হবে।

এই সরকারের অধীনেই যদি নির্বাচন হয় তাহলে কমিশন কীভাবে নির্বাচনটাকে বিতর্কমুক্ত করতে পারবে- এ প্রশ্নের জবাবে মুহাম্মদ ছহুল হোসাইন বলেন, এই ইস্যুটি পিউরলি পলিটিক্যাল ইস্যু। নির্বাচন কমিশন কী করবে? নির্বাচন কমিশনের তো করার কিছু নেই। এটা রাজনৈতিক দলগুলোর মধ্যে সমঝোতার মাধ্যমে সমাধান করতে হবে।

তিনি বলেন, বাংলাদেশের কোনো নির্বাচনেই বিচারিক ক্ষমতা দিয়ে সেনা মোতায়েন করা হয়নি। বিচারিক ক্ষমতা যে দিতে হবে এমন কোনো কথা নেই। আর্মি থাকবে। কারণ আমরা আইনের শাসনে বিশ্বাস করি। সেখানে মেজিস্ট্রেট থাকবে, কোর্ট থাকবে।

ইসি মধ্যস্ততাকারী হিসেবে রাজনৈতিক দলগুলোর মধ্যে দূরত্ব কমাতে পারে কি না- এ প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, যদিও এটা খুব কঠিন কাজ। আমার মনে হয় নির্বাচন কমিশন একটি উদ্যোগ নিতে পারে। এ উদ্যোগ যদি ফেইল করে তাহলে দোষটা তাদের (ইসি) না। সুষ্ঠু নির্বাচন অনুষ্ঠান করা ইসির দায়িত্ব। আর এজন্য এ ধরনের উদ্যোগ ইসি নিতে পারে। কিন্তু এ উদ্যোগ যে সফল হবে এমন কোনো গ্যারান্টি নেই। সফল না হলে ইসির কোনো দায় নেই।

তিনি বলেন, আমরা বলেছি উনারা শক্তভাবে, দৃঢ়ভাবে আইনকে প্রয়োগ করবেন। আমি নতুন করে দুটি কথা বলেছি। একটা হলো নির্বাচনে প্রায় ৬ লাখ লোক কাজ করে। এই লোকগুলো যদি নিরপেক্ষ না থাকে তাহলে নির্বাচন সুষ্ঠু হবে না। এদের মোটিভেইট করতে হবে। বহু আগে থেকেই তাদের চিহ্নিত করে ট্রেইন করতে হবে।

তিনি আরও বলেন, প্রবাসীদের ভোটার করার আইন করেছিলাম আমরা। তাদের ভোটাধিকার প্রয়োগের জন্য প্রত্যেক অ্যাম্বাসি বা হাইকমিশনে ভোটকেন্দ্র স্থাপনের পরামর্শ দিয়েছি।

বিগত নির্বাচন পেট্রলবোমার ওপর দিয়ে করতে হয়েছিল, আগামীতে তা যদি না হয় সে বিষয়ে কি পরামর্শ দিয়েছেন এ প্রশ্নের জবাবে সাবেক নির্বাচন কমিশনার মো. শাহনেওয়াজ বলেন, আমাদের সময়ে বিরাট একটি দল ও জোট না আসায় আর নির্বাচনে বাধা দেয়ার কারণে আমরা সমস্যায় পড়েছিলাম। যান, মাল সম্পদের অনেক ক্ষয়ক্ষতি হয়েছে। কিন্তু এ নির্বাচন কমিশন ও দেশের জন্য সৌভাগ্য সুন্দর নির্বাচনের জন্য সবাই আগ্রহী হয়ে আছে। এখন ইসির উচিত হবে সুন্দর নির্বাচনের লক্ষ্যে এগিয়ে যাওয়া। নির্বাচনী আসন নিয়ে খুব একটা সমস্যা নেই। একইভাবে বিদ্যমান আইনেই নির্বাচন করা সম্ভব।

তিনি বলেন, রিটার্নিং অফিসার সাধারণত জেলাভিত্তিক জেলা প্রশাসকরা হয়। এবার যেন ইসির কিছু কর্মকর্তাকে দায়িত্ব দেয়া হয়। বাধা দেয়ার বিষয় এখন পর্যন্ত না আসায় এ ইসি সুন্দর একটা নির্বাচন দিতে পারবে বলে আমার বিশ্বাস। এখন ইসিকে সুন্দর একটি নির্বাচনী পরিবেশ তৈরি করে নিতে হবে।

দলীয় সরকারের অধীনে নির্বাচন কতটা কঠিন-এ প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, আমার মনে হয় ইসি যদি শুধু নির্বাচনের দিকেই লক্ষ্য রাখে তাহলে সরকার থাকায় কোনো প্রতিবন্ধকতা তৈরি হবে না। আরপিও এর ৫ ধারা এবং সংবিধানের ১২৬ ধারা অনুসারে ইসিকে যে ক্ষমতাগুলো দেয়া হয়েছে সেগুলো প্রয়াগ করলে যে সরকারই ক্ষমতায় থাকুক না কেন সুষ্ঠু নির্বাচন করা সম্ভব। যেখানে প্রয়োজন হবে সেখানে সেনাবাহিনী মোতায়েন করবে। কিন্তু এজন্য সেনাবাহিনীকে মেজিট্রেসি ক্ষমতা দেয়ার দরকার নেই।

সংলাপে আরও উপস্থিত ছিলেন নির্বাচন কমিশনার মো. সাইফুল আলম, ব্রি.জে. (অব.) এম সাখাওয়াত হোসেন, মোহাম্মদ আবদুল মোবারক, মোহাম্মদ আবু হাফিজ, সাবেক ইসি সচিব ড. এ এফ এম মহিউর রহমান, সাবেক সচিব হুমায়ুন কবির, সাবেক আইজিপি মোহম্মদ হাদীস উদ্দীন, সাবেক প্রধানমন্ত্রীর মুখ্য সচিব আবদুল করিম, সাবেক সচিব এএসএম ইয়াহিয়া চৌধুরী, সাবেক মহাপরিচালক বিজিবি ও আনসার-ভিডিপি মেজর জেনারেল (অব.) রফিকুল ইসলাম, স্থানীয় সরকার বিভাগ ও সাবেক সচিব মঞ্জুর আহমেদ।

আসন্ন জাতীয় সংসদ নির্বাচন উপলক্ষে অংশীজনদের সঙ্গে সংলাপ শুরু করেছে ইসি। এরই ধারাবাহিকতায় এ সংলাপ হয়। এ পর্যন্ত ৪০টি দলের সঙ্গে বৈঠক করেছে ইসি। এছাড়া সুশীল সমাজ, সাংবাদিক, নির্বাচনী পর্যবেক্ষক ও নারী নেত্রীদের সঙ্গে সংলাপ করেছে ইসি।

দীর্ঘ তিন মাস ধরে এ সংলাপ চলে। আজ মঙ্গলবার সংলাপের শেষ দিন।