সরকার প্রকারান্তরে হেফাজতকে পুষছে : অবস্থান কর্মসূচিতে সংস্কৃতিকর্মীরা

হেফাজতে ইসলাম, ওলামা লীগের মতো সাম্প্রদায়িক শক্তির উত্থান ও আস্ফালনে দেশের মানবিক পরিস্থিতি অত্যন্ত উদ্বেগজনক বলে মনে করছেন সাংস্কৃতিক ব্যক্তিত্বরা। হেফাজতে ইসলামের দাবির পরিপ্রেক্ষিতে পাঠ্যপুস্তকে পরিবর্তন, ভাস্কর্য অপসারণ করায় ক্ষুব্ধ সংস্কৃতিজনরা অভিযোগ করেছেন, সরকার প্রকারান্তরে হেফাজতকে পুষছে।

‘মুক্তিযুদ্ধের চেতনা ও বাঙালি সংস্কৃতিবিরোধী সাম্প্রদায়িক গোষ্ঠী রুখে দাঁড়াও’ শিরোনামে আজ শনিবার দুপুরে রাজধানীর কেন্দ্রীয় শহীদ মিনারে সম্মিলিত সাংস্কৃতিক জোটের আয়োজনে সংস্কৃতিকর্মীদের অবস্থান কর্মসূচি পালিত হয়।

সংগঠনের সভাপতি গোলাম কুদ্দুছ বলেন, একই সময়ে জোটের আহ্বানে দেশের ৪৫টি জেলায় এই কর্মসূচি পালিত হয়েছে। অবস্থান কর্মসূচি ১১টা থেকে ১টা পর্যন্ত চলে।

কর্মসূচিতে অংশ নিয়ে রামেন্দু মজুমদার বলেন, ‘সরকার এখন হেফাজতকে একটি রাজনৈতিক শক্তি হিসেবে প্রতিষ্ঠা করে জুজুর ভয় দেখাতে চায়। আমার মনে হয়, এটাই এখন বর্তমান সরকারের সাফল্য।’ তাঁর ভাষ্য, ‘প্রধানমন্ত্রী নিজ থেকে ভাস্কর্য প্রসঙ্গে বলার পরই এ নিয়ে তো জল ঘোলা হলো।’

রামেন্দু বলেন, আজকাল তো কিছু বলা যায় না। জুজু হয়ে গেছে, কেউ কিছু বললে তা ধর্মের বিরুদ্ধে বলা হয়। এভাবে এদের প্রশ্রয় দিলে, এই ধর্ম ব্যবসায়ীদের প্রতিহত করা না গেলে নিজেদের কবর আমরা নিজেরাই খুঁড়ব। ভাস্কর্য অপসারণ, পাঠ্যপুস্তকে পরিবর্তন ও সর্বশেষ রাঙামাটির লংগদুতে পাহাড়িদের বাড়িঘর পোড়ানোর ঘটনায় বামধারার রাজনৈতিক দলগুলোর নিস্ক্রিয়তায় ক্ষুব্ধ প্রতিক্রিয়া আসে তাঁর কাছ থেকে।

রামেন্দু মজুমদার বলেন, ‘রাজনৈতিক দলগুলোর মধ্যে কোনো তাড়াহুড়ো নেই। তারা এখন ভোটের হিসাব কষছে, ক্ষমতায় থাকার হিসাব কষছে।’

স্বাধীন বাংলা বেতার কেন্দ্রের শিল্পী আশরাফুল আলম বলেন, ‘হেফাজতের কথা বলছে? তারা তো দৃশ্যমান। তাদের কর্ম সবই পত্রিকায় আসে। এরা ছাড়া অনেক ব্যবসায়ী, চাকরিজীবী এ চিন্তা ধারণ করে। এদের বিষয়ে সতর্ক থাকতে হবে। আমাদের মধ্যে কারা এসব প্রতিবাদে আসছে না, তাদের বিষয়েও নজর রাখুন। কারণ এই ধরনের সমাবেশে এই পরিমাণ জনসমাগমে সবাই সন্তুষ্ট হতে পারেন, আমি না।’

নাট্যকার মামুনুর রশীদ বলেন, ‘ভাস্কর্যকে যখন মূর্তি বলা হয় তখন আমাদের শিক্ষা-দীক্ষা সবকিছু পরাজিত হয়ে সংস্কৃতির ওপর আঘাত আসে। আমাদের প্রধানমন্ত্রী যখন এই শব্দটি উচ্চারণ করেন এবং বলেন এই ভাস্কর্যটি এখানে থাকা উচিত নয় তখন আরো বেশি হতাশ হয়ে পড়ি।’ তিনি বলেন, ‘আমাদের মাননীয় প্রধানমন্ত্রী দুজনকে পুষছেন একজন হলেন অর্থমন্ত্রী আবুল মাল আবদুল মুহিত আর আরেকজন তেঁতুল হুজুর। তাঁকে (অর্থমন্ত্রীকে) সংস্কৃতিবান্ধব মানুষ হিসেবে জানতাম কিন্তু তিনি জনগণের ওপর ঝাঁপিয়ে পড়েছেন, ব্যাংক বন্ধের ব্যবস্থা করছেন। এ অবস্থা অব্যাহত থাকলে আগামী তিন বছরের মধ্যে ব্যাংক বন্ধ হয়ে যাওয়ার পরিস্থিতি তৈরি হবে। তেঁতুল হুজুরকে পুষতে গিয়ে আজ দেশের মুক্তিযুদ্ধ, ধর্মনিরপেক্ষতা এবং বাঙালি সংস্কৃতি জব্দ হবার উপক্রম হলো।’

মামুনুর রশিদ আরো বলেন, ‘বামপন্থী রাজনৈতিক দলগুলোর নিষ্ক্রিয়তা নিয়ে সরব হন। কমিউনিস্ট পার্টি, জাসদসহ দলগুলো এখন গড্ডালিকা প্রবাহে গা ভাসিয়েছে। রাজনৈতিক দলগুলোর মধ্যে এখন শর্ষের মধ্যে ভূত ঢুকে গেছে। এতই ভয় পেয়ে আছে ওরা যে টুঁ শব্দটিও করছে না। প্রগতিশীল রাজনীতির এ কোন হাল? এ তো এক মহাদুঃসময়।’ তিনি বলেন, এ সংগ্রাম চলছে, চলবেই।

নাট্যকার নাসির উদ্দিন ইউসুফ বলেন, ‘স্বাধীন বাংলাদেশে, বাঙালি জাতিরাষ্ট্রে এটা কোনোভাবেই অনুমোদন করে না। রাঙামাটিতে বাড়িঘর পুড়িয়ে দেওয়া হয়েছে, যশোরে মন্দিরে হামলা হয়েছে কিন্তু এতে আমরা ব্যর্থ হয়েছি। আমি বলছি না যে, কিছু জঙ্গিকে হত্যার মধ্য দিয়ে তার চূড়ান্ত বিজয় সম্ভব। জয় তখনই হবে যখন সাংস্কৃতিকভাবে জনগোষ্ঠীকে জয়লাভ করবে।’

সম্মিলিত সাংস্কৃতিক জোটের সাধারণ সম্পাদক হাসান আরিফ বলেন, ‘জঙ্গি শক্তির উদ্ভব হয়েছে সারা দেশে। আমরা যখন সৃজনকর্ম দিয়ে এর বিরুদ্ধে সংগ্রাম গড়ে তুলছি, তখন গণমানুষের সমর্থন পেলেও সরকারের কোনো সমর্থন পাচ্ছি না।’ সংস্কৃতিকর্মীদের একটি ঐক্যবদ্ধ আন্দোলন গড়ে তোলার আহ্বান জানিয়ে তিনি বলেন, ‘আজকে আমরা যে সময়ে দাঁড়িয়ে আছি, তা ভালো নেই। সংগ্রামে আজ দ্বিধা ও সংশয়ের কোনো অবকাশ থাকলে চলবে না। আমাদের এই আন্দোলন বাংলাদেশের মানুষকে বাঁচিয়ে রাখার আন্দোলন।’

চলমান পরিস্থিতিতে বাংলাদেশে মানবিক পরিস্থিতি অত্যন্ত উদ্বেগজনক বলে মন্তব্য করেছেন জাতীয় কবিতা পরিষদের সভাপতি অধ্যাপক মুহাম্মদ সামাদ। তিনি বলেন, সংস্কৃতিকর্মীদের যখন মুরতাদ বলা হয়, বরেণ্য ব্যক্তিত্বদের অশ্রাব্য গালি দেওয়া হয়, তখন অসাম্প্রদায়িক চেতনায় আঘাত আসে। তাঁর অভিযোগ, মৌলবাদী শক্তিটি দেশ থেকে সংখ্যালঘুদের তাড়িয়ে দিতে হুমকি দিচ্ছে।

সভাপতির বক্তব্যে সম্মিলিত সাংস্কৃতিক জোটের সভাপতি গোলাম কুদ্দুছ বলেন, ‘আমরা আমাদের বক্তব্য দিয়ে, আমাদের কর্ম দিয়ে যাদের বিরুদ্ধে আমরা আন্দোলন করছি, কথা বলছি তাদের সঙ্গে সরকারের কোনো সুসম্পর্ক চাই না।’

অবস্থান কর্মসূচিতে আরো অংশ নেন বাংলাদেশ গণসংগীত সমন্বয় পরিষদের সভাপতি ফকির আলমগীর, বাংলাদেশ নৃত্যশিল্পী সংস্থার সহসভাপতি ড. নিগার চৌধুরী, পথনাটক পরিষদের সভাপতি মান্নান হীরা, চারুশিল্পী সংসদের সাধারণ সম্পাদক মনিরুজ্জামান, যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক কামাল পাশা চৌধুরী।

আলোচনার পাশাপাশি অনুষ্ঠান প্রাঙ্গণে চারুশিল্পীরা তুলির মাধ্যমে তাঁদের প্রতিবাদের ভাষা তুলে ধরেন। একই সঙ্গে দেশের প্রতিশ্রুতিশীল শিল্পীরা আবৃত্তি পরিবেশেন করেন।