সাদ ইস্যুতে বিভক্তির মধ্যেই শুরু হচ্ছে ইজতেমা

গাজীপুরের টঙ্গীর তুরাগ তীরে শুক্রবার শুরু হচ্ছে ৫৩তম বিশ্ব ইজতেমা। মুসলমানদের অন্যতম বৃহত্তম এ ধর্মীয় গণজমায়েতকে কেন্দ্র করে এরই মধ্যে প্রস্তুতিমূলক কাজ সম্পন্ন হয়েছে।

তবে এবারের ইজতেমার আগে তাবলিগ জামাতের বিভক্তি প্রকাশ্যে এসেছে। দিল্লির মাওলানা সাদকে নিয়ে দুই ভাগে ভাগ হয়ে পড়েছেন তাবলিগ অনুসারীরা। আলেমদের বড় অংশটি মাওলানা সাদকে ইজতেমায় আসতে বাধা দিয়ে আসছিলেন। এর মধ্যেই বুধবার তিনি ঢাকায় পৌঁছেছেন। তার এই আসাকে কেন্দ্র করে বুধবার দিনভর বিক্ষোভ হয়েছে বিমানবন্দরসহ ঢাকার বিভিন্ন এলাকায়। দেশের বাইরেও বিভিন্ন কওমি মাদ্রাসায় বিক্ষোভ করেছেন আলেম-ওলামা এবং মাদ্রাসা ছাত্ররা।

২০১৫ সাল থেকে মাওলানা সাদ ইজতেমার আখেরি মোনাজাত করে আসছেন। তবে তার কিছু বিতর্কিত মন্তব্যের কারণে আলেমদের বড় অংশ তার বিরুদ্ধে অবস্থান নিয়েছেন। মাওলানা সাদ যেন ইজতেমায় আসতে না পারেন সে ব্যাপারে আলেমরা স্বরাষ্ট্রমন্ত্রীর সঙ্গে দফায় দফায় বৈঠক করেছেন। তবে শেষ পর্যন্ত তার আসাকে ঠেকাতে পারেননি আলেমরা।

বুধবার দিনভর বিক্ষোভের পর নতুন কর্মসূচি ঘোষণা করেছেন কওমি মাদ্রাসার আলেমরা। তারা ইজতেমার সময় তুরাগ তীরে অবস্থান নেবেন এবং মাওলানা সাদ যেন বয়ান করতে না পারেন সে ব্যাপারে ব্যবস্থা নেবেন। এই ইস্যু নিয়ে এবারের ইজতেমায় উত্তেজনা বিরাজ করতে পারে বলে আশঙ্কা করা হচ্ছে।

প্রস্তুত তুরাগ তীর

বিশ্ব ইজতেমার জন্য প্রশাসনের পক্ষ থেকে নেয়া হয়েছে পাঁচ স্তরের নিরাপত্তা বলয়। সিসিটিভি, ওয়াচ টাওয়ার নির্মাণ ও নানা নিরাপত্তামূলক ব্যবস্থা ছাড়াও পুলিশ, র‌্যাবসহ আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর সদস্যরা এরই মধ্যে ইজতেমা ময়দানে অবস্থান নিয়েছেন। আসছেন দেশ-বিদেশের লাখো মুসুল্লি। তাদের ইজতেমা ময়দানে সমবেত ও ধর্মীয় আনুষ্ঠানিকতা টঙ্গীকে রূপ দিয়েছে যেন এক ধর্মীয় নগরীতে।

শুক্রবার বাদ ফজর আম বয়ানের মধ্যে দিয়ে ৫৩তম বিশ্ব ইজতেমার আনুষ্ঠানিকতা শুরু হবে। রবিবার আখেরি মোনাজাতের মধ্য দিয়ে শেষ হবে এবারের ইজতেমার প্রথম পর্ব।

বুধবার সরেজমিনে দেখা গেছে, তাবলিগ জামাতের উদ্যোগে তুরাগ তীরে নির্মাণ করা হয়েছে বিশাল সামিয়ানা। রাস্তাঘাট মেরামত, মাঠ সমতল করাসহ নানা প্রস্তুতিমূলক কাজ এরই মধ্যে সম্পন্ন হয়েছে। ময়দানের উত্তর পশ্চিম প্রান্তে প্রস্তুত রয়েছে বিদেশিদের জন্য আলাদা নিবাস। তাদের থাকা, খাওয়া ও অবস্থানে যেন কোনো ধরনের সমস্যা না হয় সেজন্য ইজতেমার নিজস্ব স্বেচ্ছাসেবকরা দিনরাত কাজ করছেন। তাদের রান্না-বান্নার জন্য গ্যাস সংযোগ, বিদ্যুত সংযোগসহ সবধরনের প্রস্তুতি নেয়া হয়েছে। এবারের ইজতেমায় ৩২ জেলার প্রত্যন্ত এলাকা থেকে লাখো মুসুল্লি অংশগ্রহণ করবেন। ইজতেমায় আগত এসব মুসল্লির সুবিধার্থে গভীর নলকূপ থেকে পানি সরবরাহ, স্থায়ী টয়লেট ও সার্বক্ষণিক বিদ্যুতের ব্যবস্থা নেয়া হয়েছে। ময়দানের পশ্চিম প্রান্তে বয়ানমঞ্চ, দোয়া মঞ্চ, তুরাগ নদীতে ভাসমান সেতু নির্মাণ করা হয়েছে।

বিশ্ব ইজতেমার মুরব্বি প্রকৌশলী গিয়াস উদ্দিন ঢাকাটাইমসকে জানান, ইতোমধ্যে ইজতেমা ময়দানের কাজ সম্পন্ন করা হয়েছে। পুলিশ প্রশাসন ও জেলা প্রশাসনসহ সরকারের নেয়া নানা পদক্ষেপ সন্তোষজনক। এবার প্রথম পর্বে ঢাকা, পঞ্চগড়, নীলফামারী, শেরপুর, নারায়ণগঞ্জ, গাইবান্ধা, নাটোর, মাদারীপুর, লক্ষ্মীপুর, ঝালকাঠি, ভোলা, মাগুরা ও নোয়াখালী। এসব এলাকার মুসল্লিরা ময়দানে তাদের জন্য নির্ধারিত ২৮টি খিত্তায় অবস্থান করবেন।

মুসল্লিদের সংখ্যা বৃদ্ধি এবং ইজতেমা ময়দানে জায়গা কম থাকায় ২০১৬ সাল থেকে ৬৪ জেলার মুসল্লিদের ৩২ জেলা করে দুই ভাগে ভাগ করা হয়। এই ৩২ জেলার মুসল্লিদের মধ্যে আবার ১৬ জেলা করে দুই ভাগে ভাগ করা হয়েছে। প্রতিবছর ১৬ জেলা করে দুই ধাপে ৩২ জেলার মুসল্লিরা অংশ নেন এই বিশ্ব ইজতেমায়। এবার দুই পর্বে বিশ্ব ইজতেমার প্রথম পর্ব শুরু হবে ১২ জানুয়ারি শুক্রবার। আখেরি মোনাজাত হবে ১৪ জানুয়ারি।

আসছেন দেশ-বিদেশের লাখো মুসল্লি

দেশের বিভিন্ন প্রান্ত থেকে ইজতেমা ময়দানে এরই মধ্যে মুসল্লিরা আসতে শুরু করেছেন। বাস, মিনিবাস, ট্রেনে চড়ে দলে দলের আসছেন মুসল্লিরা। এছাড়া ভারত, পাকিস্তান, সৌদি আরব, মরক্কো, সুদান, মিসর, ইরাক, ইরানসহ অন্তত ১৩৫টি দেশের মুসল্লিরা ইজতেমা ময়দানে আসতে শুরু করেছেন। এসব দেশ থেকে এবার সহস্রাধিক মুসল্লি অংশ নেবেন বলে আশা আয়োজকদের।

ইজতেমা ময়দানে আগত মুসল্লিরা জানান, আল্লাহর সন্তুষ্টি ও পরকালের নাজাতের আশায় তারা ময়দানে এসেছেন। এখানে ইজতেমার মুরব্বিরা দ্বীন ও আখেরাতের নাজাতের উপায় নিয়ে আলোচনা করেন। ইমান, আমল-আখলাকসহ ছয় উসুল নিয়ে আলোচনা হবে। দ্বীনের দাওয়াতের আলোচনা হবে। এর আগে ইজতমা ময়দানের মুরব্বিদের পরামর্শ ও নির্দেশনায় শত শত স্বেচ্ছাসেবক মাঠে সামিয়ানা টাঙ্গানো, চট সেলাই-মেরামত, বাঁশের খুটি পোঁতা, ময়লা আবর্জনা পরিষ্কার, রাস্তা মেরামত, বিদ্যুতের লাইন টানানো, পয়ঃনিষ্কাশন ও পানি সরবরাহের কাজ সম্পন্ন করেন।

এদিকে, লাখ লাখ মুসল্লির সমাগমকে সামনে রেখে ইজতেমা ময়দানে গতবারের চেয়ে নিরাপত্তাব্যবস্থা আরও বাড়ানো হয়েছে। স্থায়ী সিসিটিভি বসানোসহ থাকছে ১৫টি ওয়াচ টাওয়ার, পুলিশ, র‌্যাবের আলাদা কন্ট্রোল রুম। ইজতেমা মাঠের একটি কেন্দ্রীয় এবং পাঁচটি সাব কন্ট্রোল রুম থাকছে।

গাজীপুর পুলিশ সুপার মোহাম্মদ হারুন-অর-রশিদ বলেন, ইজতেমা উপলক্ষে জেলা পুলিশের পক্ষ থেকে পাঁচ স্তরের নিরাপত্তাব্যবস্থা গ্রহণ করা হয়েছে। গত ইজতেমায় সাড়ে পাঁচ হাজার পুলিশ সদস্য দায়িত্ব পালন করেছিল। এবার ইজতেমায় সাত হাজার পুলিশ সদস্য দায়িত্ব পালন করবে। এছাড়াও সাদা পোশাকে পুলিশ সদস্যের সংখ্যা বৃদ্ধি করা হয়েছে। ইজতেমা ময়দান ও এর আশপাশের এলাকায় ৪১টি সিসি ক্যামেরা স্থাপন করা হয়েছে। এই সিসি ক্যামেরাগুলো স্থায়ীভাবে স্থাপন করা হয়েছে। যাতে সারা বছর ইজতেমা ময়দানের আগত তাবলিগ জামাতের মুসল্লিদের নিরাপত্তার বিষয়টি পর্যবেক্ষণ করা যায়। গতবারের মতো এবারেও ইজতেমায় ড্রোন ক্যামেরা ব্যবহার করা হবে। এছাড়া বিদেশি মেহমানখানায় সাদা পোশাকে পুলিশ কাজ করবে। আর্চওয়ে ও মেটাল ডিটেক্টর দিয়ে তল্লাশির ব্যবস্থা থাকবে। থাকবে নৌটহলও, যাতে ময়দানের পশ্চিম পাশ দিয়ে কোনো দুষ্কৃতিকারী প্রবেশ করতে না পারে।

গাজীপুর ট্রাফিক পুলিশ ইন্সপেক্টর সোহরাব আহমেদ মজুমদার বলেন, ইজতেমা উপলক্ষে ৭১৯ জন ট্রাফিক পুলিশ ও ৩০০ জন আনসার সদস্য দায়িত্ব পালন করবেন। বুধবার বিকাল পর্যন্ত ঢাকা-ময়মনসিংহ মহাসড়কের কোথায় কোনো যানজটের খবর পাওয়া যায়নি।

গাজীপুর সড়ক ও জনপথ বিভাগের নির্বাহী প্রকৌশলী ডিএকেএম নাহীন রেজা বলেন, ইজতেমা উপলক্ষে টঙ্গী স্টেশনরোড ও টঙ্গী বাজার বাসস্ট্যান্ড এলাকার ফুটওভারব্রিজ দুটি মেরামতের পাশাপাশি মেরামত করে রাতে বাতির ব্যবস্থা করা হয়েছে।

জিসিসির প্রধান নির্বাহী কেএম রাহাতুল ইসলাম বলেন, বিশ্ব ইজতেমার সার্বিক কার্যক্রম মনিটরিং করার জন্য পাঁচটি কন্ট্রোলরুম স্থাপন করা হয়েছে। ইস্তেমায় আগত দেশি-বিদেশি মেহমানদের অভিনন্দন ও স্বাগত জানিয়ে ১৩টি তোরণ নির্মাণ করা হয়েছে। ইজতেমা ময়দানের সার্বিক নিরাপত্তা মনিটরিং কাজে পুলিশের জন্য ১৫টি ও র‌্যাবের জন্য নয়টি ওয়াচ টাওয়ার স্থাপন করা হয়েছে। ইজতেমায় নিরাপত্তার দায়িত্বে নিয়োজিত সদস্যদের জন্য ১৫৪টি অস্থায়ী টয়লেট নির্মাণ করা হয়েছে। মুসল্লিদের ওজু-গোসল, পয়ঃনিষ্কাশন ও সুপেয় পানি সরবরাহের জন্য ইজতেমা ময়দানে ১৩টি গভীর নলকূপ দ্বারা ১৮.৫০ কিলোমিটার পাইপলাইনের মাধ্যমে প্রতিদিন তিন কোটি ৫৪ লাখ গ্যালন সুপেয় পানির সরবরাহ নিশ্চিত করা হয়েছে। ইজতেমা আয়োজক কমিটির চাহিদা মোতাবেক ১০০ ড্রাম ব্লিচিং পাউডার সরবরাহ করা হয়েছে। এছাড়া ২১টি গার্বেজ ট্রাকের মাধ্যমে দিন-রাত বর্জ্য অপসারণ কার্যক্রম নিশ্চিত করা হয়েছে। ইজতেমা ময়দান ও এর আশাপাশের এলাকায় ২৬টি ফগার মেশিন দিয়ে মশক নিধন করা হবে। ইজতেমা ময়দানের চারিপাশে ৪৯৬টি বৈদ্যুতিক বাতির ব্যবস্থা করা হয়েছে। সুষ্ঠু ও সফলভাবে ইজতেমা পালনের জন্য গাজীপুর সিটি করপোরেশনের কাউন্সিলর, কর্মকর্তা ও কর্মচারীদের সমন্বয়ে ১২টি কমিটি গঠন করে দায়িত্ব বন্টন করে দেয়া হয়েছে। ইজতেমায় আগত মুসল্লিদের চিকিৎসা সেবা নিশ্চিত করতে ৪৫টি চিকিৎসা সেবাকেন্দ্র স্থাপন করা হয়েছে। ইজতেমায় আগত বিদেশি মেহমানদের রান্না কাজের জন্য ১৩৬টি গ্যাসের চুলা স্থাপন করা হয়েছে।

জনস্বাস্থ্য প্রকৌশল বিভাগ সূত্রে জানা গেছে, ইজতেমা ময়দানে আগত মুসল্লিরা একসঙ্গে নয় হাজার শৌচাগার ব্যবহার করতে পারবেন। মুসল্লিদের জন্য পাঁচ হাজার ওজুখানা প্রস্তুত রাখা হয়েছে। বিদেশি মেহমানদেন জন্য ২৯০টি গোসলখানা ও গরম পানির ব্যবস্থা করা হয়েছে। ইজতেমা ময়দানের জন্য ১০ জন জনস্বাস্থ্য প্রকৌশলীকে দায়িত্ব দেয়া হয়েছে।

মাওলানা সাদের আগমনকে কেন্দ্র করে যানজট

বুধবার দুপুরে তাবলিগ জামাতের মুরুব্বি দিল্লির মাওলানা সাদের আগমনকে কেন্দ্র করে তাবলিগ জামাতের একটি অংশের মুসল্লিরা বিমান বন্দরের সামনে রাস্তায় অবস্থান নেন। এতে ঢাকা-ময়মনসিংহ মহাসড়কে যানজট দেখা দেয়। ফলে উত্তরা থেকে বোর্ডবাজার পর্যন্ত প্রায় ১৫ কিলোমিটার এলাকাজুড়ে দেখা দেয় যানজট। এতে দুর্ভোগে নাকাল হন ইজতেমাগামী এবং সাধারণ যাত্রীরা।

১৪ জানুয়ারি আখেরি মোনাজাতের মধ্য দিয়ে শেষ হবে ইজতেমার প্রথমপর্ব। চার দিন পর ১৯ জানুয়ারি শুরু হবে দ্বিতীয় পর্ব। ২১ জানুয়ারি আখেরি মোনাজাতের মধ্য দিয়ে শেষ হবে এবারের বিশ্ব ইজতেমার আনুষ্ঠানিকতা। ১৯৬৭ সাল থেকে ১৬০ একর জমি বিস্তৃত ইজতেমা ময়দানে তাবলিগ জামাতের উদ্যোগে এই ধর্মীয় সমাবেশ হয়ে আসছে।