সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম বনাম গণতন্ত্র

ফেসবুকের মালিকানাধীন ছবি বিনিময়ের প্ল্যাটফর্ম ইনস্টাগ্রাম সম্প্রতি রুশ সরকারের চাপে পড়ে বিরোধী নেতা আলেক্সি নাভালনির পোস্ট করা কিছু ছবি সরিয়ে ফেলেছে। নাভালনির পোস্ট করা ছবিতে রুশ উপপ্রধানমন্ত্রী সের্গেই প্রিখোদকোর ভাবমূর্তি ক্ষুণ্ন করা হয়েছে বলে অভিযোগ করা হয়েছে। ওই ছবিগুলোতে প্রিখোদকোকে নরওয়েতে একটি প্রমোদতরিতে ওলেগ দেরিপাসকা নামের একজন গোষ্ঠীপ্রধানের সঙ্গে খুব ঘনিষ্ঠভাবে দেখা গেছে। নাভালনির দাবি, প্রমোদতরিতে ঘুষ লেনদেন হয়েছে।

নাভালনির পোস্টগুলো দৃশ্যমান হওয়ার পর দেরিপাসকা রুশ কমিউনিকেশন রেগুলেটর কর্তৃপক্ষ রোসকোমনাদজোরর শরণাপন্ন হন। রোসকোমনাদজোর পোস্টগুলো সরিয়ে ফেলতে ফেসবুককে অনুরোধ করেন এবং দ্রুতই সেগুলো সরিয়ে ফেলা হয়। এ ঘটনা নিয়ে অনেক তোলপাড় হয়েছে এবং ফেসবুককে তীব্র সমালোচনার মুখে পড়তে হয়েছে। এ রকম হাজার হাজার ঘটনা প্রতিনিয়ত ঘটছে। আমরা এমন একটা সময় অতিক্রম করছি, যখন বেশির ভাগ মানুষ সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম থেকে প্রয়োজনীয় খবর পেয়ে যাচ্ছে। নিজেদের স্বার্থের বিপক্ষে যাওয়া পোস্টগুলো সরিয়ে ফেলতে মাফিয়া সরকারগুলোকে খুব একটা বেগ পেতে হয় না। উদার গণতন্ত্রের দেশগুলোর পক্ষে সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম নিয়ন্ত্রণ করা অতি দুরূহ।

অবাধ তথ্য সরবরাহের ক্ষেত্রে সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম একদিকে যেমন গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখে; অন্যদিকে অবৈধ, উগ্রপন্থী ও বিদ্বেষ ছড়ানোর মতো ক্ষতিকর পোস্ট বাছাই করে সেগুলো সরিয়ে ফেলতে ব্যর্থ হওয়ায় তাকে কম সমালোচনা শুনতে হয় না। এই ব্যর্থতা ইউরোপীয় সরকারগুলোকে, এমনকি খোদ ইউরোপীয় ইউনিয়নকে (ইইউ) কড়া ব্যবস্থা নিতে বাধ্য করেছে। ইন্টারনেট কোম্পানিগুলোর জন্য ইইউ ইতিমধ্যে আচরণবিধি ঠিক করেছে এবং যেসব কোম্পানি এখনো আনুষ্ঠানিক আইনের আওতায় আসেনি, তাদের দ্রুত সব আনুষ্ঠানিকতা শেষ করার জন্য হুঁশিয়ারি দেওয়া হয়েছে।

ব্রিটিশ গোয়েন্দা সংস্থা জিসিএইচকিউর সাবেক পরিচালক রবার্ট হ্যানিগান সম্প্রতি বলেছেন, প্রযুক্তি কোম্পানিগুলোর ইচ্ছামতো কাজ চালিয়ে যাওয়ার দিন শেষ হয়ে আসছে। জার্মানি সম্প্রতি একটি নতুন আইন পাস করেছে, যাতে অননুমোদিত কোনো কিছু পোস্ট করার ২৪ ঘণ্টার মধ্যে সরিয়ে না ফেলার শাস্তি হিসেবে বিপুল অঙ্কের জরিমানার বিধান রাখা হয়েছে। বিদ্বেষ ছড়ানো ছবি ও বক্তব্য পোস্ট করার মাধ্যমে সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমকে অস্ত্র বানানো এবং এর মধ্য দিয়ে পশ্চিমা সমাজে বিভক্তি ঘটানোর চেষ্টার বিরুদ্ধে এসব প্রতিরোধব্যবস্থা নেওয়া হচ্ছে।

এখন আমরা সুনির্দিষ্টভাবে জানতে পারছি, ক্রেমলিন ঘনিষ্ঠ ‘ইন্টারনেট রিসার্চ এজেন্সি’ গত মার্কিন নির্বাচনে ট্রাম্পের পক্ষ নিয়ে ফেসবুক ও টুইটারে ব্যাপক প্রচার চালিয়েছিল। যুক্তরাষ্ট্রের স্পেশাল কাউন্সেলর রবার্ট মুয়েলার সম্প্রতি ১৩ জন রুশ নাগরিক ও তিনটি রুশ প্রতিষ্ঠানের বিরুদ্ধে আনা অভিযোগপত্রে বলেছেন, মার্কিন নির্বাচনের আগে রাশিয়ার একটি বিশাল বাহিনী মাসের পর মাস হিলারির বিরুদ্ধে প্রচারণা চালিয়েছে এবং আমেরিকানদের মধ্যে অভিবাসনবিরোধী মনোভাব উসকে দিয়েছে। এই ডিজিটাল যুগে গণতান্ত্রিক প্রতিষ্ঠানগুলোর নিরাপত্তা ও স্বচ্ছতা কতখানি আছে, মুয়েলারের তদন্ত প্রতিবেদন সেই গুরুতর প্রশ্ন তুলেছে। যেসব গণতান্ত্রিক সরকার সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমগুলোকে ক্রেমলিনের বিশেষ অভিযানের হাতিয়ার হিসেবে ব্যবহৃত হওয়ার সুযোগ দিয়েছে, সেসব সরকারকেই সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমগুলো তথ্য দিতে টালবাহানা করছে।

উদাহরণস্বরূপ, যুক্তরাজ্যে এমপি ড্যামিয়ান কলিন্স ২০১৬ সালের ব্রেক্সিট গণভোটে রুশ হস্তক্ষেপ নিয়ে তদন্ত শুরু করার পর দেখা গেল প্রয়োজনীয় সহযোগিতা পেতে ফেসবুক ও টুইটারের সঙ্গে তাঁকে রীতিমতো সংগ্রাম করতে হচ্ছে। এ বিষয়ে টুইটারের সাড়া দেওয়াকে তিনি ‘একেবারেই অপ্রতুল’ হিসেবে বর্ণনা করেছেন। এটি দুঃখজনক। গণতন্ত্র যখন সংকটের মুখে পড়ে, তখন সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমের প্ল্যাটফর্মগুলোকে স্বচ্ছ হওয়ার দায়িত্ব নিতে হয়। রাশিয়ার পক্ষে যেভাবে যুক্তরাষ্ট্রের মতো দেশের নির্বাচনে এত নিবিড়ভাবে হস্তক্ষেপ করা সম্ভব হয়েছে, সেখানে ইউরোপের দেশগুলোতে তাদের হস্তক্ষেপ কোন মাত্রায় থাকতে পারে কল্পনা করুন। সেখানকার অনেক দেশে নির্বাচন হচ্ছে বা হবে। সেখানে অনেক সরকার এখনো জানেই না নির্বাচনী বিজ্ঞাপনের অর্থ সরবরাহ কারা করছে।

এটা প্রায় নিশ্চিত, যেদিন থেকে খবরের জন্ম হয়েছে, সেদিন থেকেই তথ্যের বিকৃতি, অপপ্রয়োগ ও তার নিয়ন্ত্রণ শুরু হয়েছে। কিন্তু আজকের প্রেক্ষাপটে রাষ্ট্রীয় তত্ত্বাবধানে ভার্চ্যুয়াল জগতে যে হাইব্রিড যুদ্ধ চলছে, তা নিঃসন্দেহে নতুন। বৈরী শক্তিগুলো আমাদের উন্মুক্ত ইন্টারনেট জগৎকে বিকৃত ও মিথ্যা তথ্যের নর্দমা বানিয়ে ফেলেছে। স্বয়ংক্রিয় লার্ভার মাধ্যমে সেই পচা ও পূতিগন্ধময় তথ্য ছড়িয়ে পড়ছে। অথচ বড় প্ল্যাটফর্মগুলোর যদি সদিচ্ছা থাকত, তাহলে এসব আবর্জনা দূর করা সহজ হয়ে যেত।

ইংরেজি থেকে অনূদিত। স্বত্ব: প্রজেক্ট সিন্ডিকেট

গাই ভেরহোফস্টাড, বেলজিয়ামের সাবেক প্রধানমন্ত্রী