সারাদেশের ওয়াজ মাহফিল পর্যবেক্ষণে স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়


স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয় মনে করছে ওয়াজের নামে অনেকে সাম্প্রদায়িক, জঙ্গিবাদী, নারী বিদ্বেষ ও কটূক্তিমূলক বক্তব্য দিচ্ছেন, যা নিয়ন্ত্রণ করা প্রয়োজন৷


এ লক্ষ্যে স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয় তাদের পর্যবেক্ষণ ও সুপারিশসহ ব্যবস্থা নিতে ইসলামিক ফাউন্ডেশন বাংলাদেশ (ইফাবা), জাতীয় রাজস্ব বোর্ড (এনবিআর) ও বিভাগীয় কমিশনারদের সম্প্রতি চিঠি দিয়েছে৷ চিঠিতে আপত্তিকর ওয়াজের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা গ্রহণ ছাড়াও ওয়াজেরিনদের (ইসলামী বক্তা) নিবন্ধনের ব্যবস্থা, যাঁরা আর্থিক চুক্তিতে ওয়াজ করেন তাঁদের আয়করের আওতায় আনাসহ দেশের আইনবিরোধী কোনো ওয়াজের বিরুদ্ধে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নেয়ার কথা বলা হয়েছে৷

ইসলামিক ফাউন্ডেশনের মহাপরিচালক দেশের বাইরে রয়েছেন৷ তবে ফাউন্ডেশনের সচিব কাজী নুরুল ইসলাম ডয়চে ভেলেকে বলেন, ‘‘স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের চিঠি পাওয়ার পর আমরা কাজ শুরু করেছি৷ আমরা আগেই সারাদেশে ওয়াজেরিনদের একটা তালিকা করেছিলাম, সেটা আপডেট করছি৷ এরপর তাঁদের কীভাবে নিবন্ধনের আওতায় আনা যায় তা নিয়ে আমরা কাজ করব৷ মহাপরিচালক মহোদয় দেশের বাইরে আছেন৷ তিনি ফিরলেই আমরা বৈঠক করব৷ যাঁরা ওয়াজ করেন তাঁদের নিয়েও আমরা আলাদা বৈঠক করব৷”

আরেক প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, ‘‘যাঁরা রাজনৈতিক প্রচার চালায় বিশেষ করে জামায়াতে ইসলামীর লোকজন তাঁদের আমরা তালিকায় রাখছিনা৷ এছাড়া যাঁরা, জঙ্গিবাদ বা রাষ্ট্রের প্রচলিত আইনের বিরুদ্ধে যায় এমন ওয়াজ করেন তাঁরাও তালিকায় থাকবেননা৷ যাঁরা তালিকায় থাকবেন তাঁদের একটি নির্দিষ্ট ইসলামী শিক্ষাগত যোগ্যতা থাকতে হবে৷”

তিনি আরো বলেন, ‘‘আমরা কাউন্সেলিং-এর ব্যবস্থাও করছি৷ যাঁরা ইসলামের ভুল ব্যাখ্যা দিচ্ছেন বা উসকানিমূলক বক্তব্য দেন তাঁদের আমরা প্রথমে কাউন্সেলিংয়ের মাঠমে সঠিক পথে আনার চেষ্টা করব৷”

স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের প্রতিবেদনে একশ্রেণির ইসলামী বক্তার ওয়াজে সাম্প্রাদয়িকতা ও জঙ্গিবাদের উসকানি দেয়ার কথা বলা হয়েছে৷ আর এধরণের ১৫ জন বক্তাকে চিহ্নিতও করা হয়েছে৷ তাঁদের কিছু বক্তব্যের উদ্ধৃতিও দেয়া হয়েছে স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের প্রতিবেদনে৷ যেমন, ‘মূর্তি ভাঙা ধর্মীয় কাজ’, ‘রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর কাফের’, ‘অমুসলিমদের সঙ্গে বন্ধুত্ব করলে ঈমান নষ্ট হয়ে যায়’, ‘গণতন্ত্র, সমাজতন্ত্র ধর্মনিরেপক্ষতাবাদ মুশরিকদের কাজ’, ‘শহিদ মিনারে ফুল দেয়া, ফুল দিয়ে নীরবতা পালন করা শিরক’, ‘জাতীয় সংগীত কওমি মাদ্রাসায় চাপিয়ে দেওয়া যাবে না’, ‘আল্লাহর রাস্তা প্রতিষ্ঠায় উত্তম জিহাদ হচ্ছে সশস্ত্র জিহাদ’, ‘আল্লাহ রসূলকে গালি দিলে কোপাতে হবে’, ‘ইসলামের কিরুদ্ধে আইন করলে কোপাতে হবে’, ‘ নারী হলো শষ্য ক্ষেত্র, সেখানে চাষ করতে হবে’ প্রভৃতি৷

যে ১৫ জনের নাম রয়েছে তাদের অনেককেই টেলিফোনে যোগাযোগ করে পাওয়া যায়নি৷ তবে তাঁদের মধ্যে একজন ইসলামী ঐক্যজোটের যুগ্ম মহাসচিব মাওলানা সাখাওয়াত হোসাইন বলেন, ‘‘স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের প্রতিবেদন আমি দেখেছি৷ আমাকে ১৫ জনের তালিকায় রেখে তারা ঠিক করেনি৷ কারণ জিহাদ মানে যুদ্ধ৷ আমি বাংলাদেশ সরকারকে মিয়ানমারের বিরুদ্ধে জিহাদের আহ্বান জানিয়েছি৷ কারণ মিয়ানমার বাংলাদেশের আকাশ সীমা লঙ্ঘন করেছে৷ তারা রোহিঙ্গাদের ওপর মানবতাবিরোধী অপরাধ করেছে৷ তাই মিয়ানমারের বিরুদ্ধে জিহাদের আহ্বান জানিয়ে আমি কোনো অন্যায় করিনি৷ এটা আমি প্রকাশ্যেই করেছি৷”

এদিকে ওয়াজ মাহফিল করে এখন অনেক অর্থও উপার্জিত হচ্ছে৷ কেউ কেউ হেলিকপ্টারে করেও একদিনে একাধিক জায়গায় ওয়াজ করছেন৷ তাঁরা বড় অংকের টাকা নিয়ে চুক্তিতে ওয়াজ করেন৷ আর এখন অনেক বক্তা ইউটিউব চ্যানেল খুলে, সিডি বের করেও অর্থ আয় করছেন৷ স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয় এজন্য জাতীয় রাজস্ব বোর্ডকেও চিঠি দিয়েছে তাঁদের আয়করের আওতায় আনার জন্য৷

জাতীয় রাজস্ব বোর্ডের চেয়ারম্যান মোশাররাফ হোসেন ভূইয়া বলেন, ‘‘আয়কর যোগ্য আয় করলেই তাঁকে কর দিতে হবে৷ ওয়াজ মাহফিল করে যদি কেউ আয় করেন তাহলে তা অবশ্যই করের আওতায় আনা হবে৷ এনিয়ে স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের কোনো চিঠি আমার হাতে এখনো আসেনি তবে আমরা এটা নিয়ে কাজ করছি৷ আরো অনেকে আয়কর দিতে চাননা, যেমন ডাক্তার, ইঞ্জিনিয়ার তাঁদেরও আয়করের আওতায় আনা হবে৷”

স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয় ওয়াজ নিয়ে মোট ৬ দফা সুপারিশ করেছে৷ সুপারিশের মধ্যে বিদ্বেষমূলক ওয়াজের কারণে সতর্ক করা ছাড়াও সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতি বিনষ্টকারী ও রাষ্ট্রবিরোধী বক্তব্য যাঁরা দেবেন তাঁদের আইনের আওতায় আনার কথাও বলা হয়েছে৷

এনিয়ে শোলাকিয়ার ইমাম মাওলানা ফরিদউদ্দিন মাসউদ বলেন, ‘‘বাংলাদেশে ওয়াজ মাহফিলের একটি ঐহিত্য আছে, বিশেষ করে শীতকালে৷ তাই এটা নিয়ে ঢালাওভাবে কিছু বলা ও করা হলে তাতে নেতিবাচক প্রতিক্রিয়া হতে পারে৷ আমার কথা হলো, কেউ যদি তাঁর ওয়াজে দেশের প্রচলিত আইনবিরোধী কিছু করেন তাহলে তাঁর বিরুদ্ধে আইনেই ব্যবস্থা নেয়ার সুযোগ আছে এবং সেটা নেয়া উচিত৷”

আরেক প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, ‘‘হ্যাঁ এখন ওয়াজ করে অনেকে ভালোই আয় করছেন৷ তাঁদের করের আওতায় আনা যেতে পারে৷ কিন্তু সাংস্কৃতিক অঙ্গনে আরো যাঁরা আয় করছেন তাহলে তাঁদেরও করের আওতায় আনতে হবে৷ তা না হলে ন্যায়বিচার হবেনা৷”

ওয়াজ মাহফিল মনিটরে ইসলামী চিন্তাবিদদের নিয়ে একটি কাউন্সিল করা যায় কিনা জানতে চাইলে তিনি বলেন, ‘‘তাতে লাভ হবে বলে মনে হয়না৷ কারণ বাংলাদেশে মাওলানারা কোনো বিষয়ে একমত হতে পারেন না৷ যে যার চিন্তা অনুযায়ী কাজ করেন৷”