সিদ্ধান্ত নিতে বাংলাদেশের মেয়েরা কতটা স্বাধীন

ঢাকার কাছে রূপগঞ্জের নগরপাড়া গ্রামের গৃহবধূ জেসমিন আক্তারের সরল স্বীকারোক্তি লেখাপড়া করে চাকরি করতে পারলে এমন পরাধীন জীবন কাটাতে হতোনা।

গ্রামের আর দশজন সাধারণ নারীর মতোই রান্নাবান্না, বাড়ীর কাজে ব্যস্ততার মধ্যে দিন কাটে জেসমিন আক্তারের। নিম্নবিত্ত পরিবারে একজন গৃহিনী হিসেবে গৃহস্থালির সব কাজের দায়িত্ব তার কাঁধে।

ইচ্ছা থাকা স্বত্বেও প্রাথমিকের গণ্ডি পেরিয়ে মাধ্যমিক স্তরে শিক্ষালাভের সুযোগ হয়নি। অল্প বয়সে বিয়ে হয়েছিল তাও সম্পূর্ণ পরিবারের পছন্দে।

জেসমিন আক্তার বলছিলেন, এ জীবন তার কাছে অনেকটাই পরাধীন। কেননা নিজের পছন্দ বা ইচ্ছামতো কাজ বা সময় কাটানোর সুযোগ তার খুব একটা হয়নি।

জেসমিন আক্তারের উপলব্ধি হলো, “আজকে যদি আমি একটু পড়ালেহা করতাম, একটা চাকরি করতাম তাইলেতো এই সমস্যা থাকতো না।”

রূপগঞ্জের নগরপাড়া গ্রামের জেসমিন আক্তারের মতো জীবন বাংলাদেশে লাখ লাখ নারীর।

জেসমিন আক্তার চান না তার তার সন্তানের ভবিষ্যৎ নিজের মতো হোক।

মেয়ে আনিকা সুলতানা শিমুকে ডিগ্রি পর্যন্ত পড়িয়ে বিয়ে দিয়েছেন। শিমু সন্তান হওয়ার পর মায়ের বাড়িতে এসেছেন। নানী এবং মাকে দেখিয়ে বলেন, আগের দুই প্রজন্মের তুলনায় নারী হিসেবে তিনি যথেষ্ট ভাল আছেন। ডিগ্রি পাশ করে তিনি স্কুল শিক্ষক হতে চান তিনি।

বাংলাদেশে সমাজে নারীরা স্বাধীনতা এবং অধিকারের প্রশ্নে এখন আগের চেয়ে অনেক বেশি সচেতন। শিক্ষা, কৃষি, চাকুরি ব্যবসা-বাণিজ্যে উল্লেখযোগ্য হারে বাড়ছে নারীর অংশগ্রহণ। কিন্তু এখনো অনেকক্ষেত্রেই নারীর ইচ্ছার মূল্যায়ন হয় না।

শিক্ষা, পেশা, পোশাক এমনকি জীবনসঙ্গী বাছাইয়ের মতো ব্যক্তিগত সিদ্ধান্ত নেয়ার ক্ষেত্রে সিদ্ধান্ত নিতে প্রতিবন্ধকতার শিকার হন নারীরা। বহু মেয়ের অভিজ্ঞতাই বলে দেয় জীবনের গুরুত্বপূর্ণ সিদ্ধান্ত গ্রহণের বেলায় সমাজে নারীর সামনে এখনো পদে পদে নিষেধের দেয়াল।

বিশ্ববিদ্যালয়ের কয়েকজন ছাত্রীর কাছে শিক্ষা, পেশা, জীবনসঙ্গী এমনকি পোশাকের ব্যাপারে সিদ্ধান্ত নেয়ার স্বাধীনতা কতটা এ নিয়ে তাদের অভিজ্ঞতা জানতে চাওয়া হয়।

মরিয়ম আক্তার বলেন তিনি চলচ্চিত্র নির্মাণ কিংবা ডিজিটাল প্রোডাকশনকে ক্যারিয়ার হিসেবে নিতে চান। কিন্তু এ জন্য তাকে নিরন্তর লড়াই চালিয়ে যেতে হচ্ছে।

“মেয়েরা ফিল্ম বানাবে, ডিরেক্টর হবে এইটা সমাজ দেখতে চায় না, দেখতে চায় মেয়েরা ক্যামেরার সামনে থাকবে। ওনারা চান না এটা আমি প্রফেশন হিসেবে নেই।”

মরিয়ম মনে করেন, বিশ্ববিদ্যালয় পর্যায়ে এসেও তার সিদ্ধান্ত গ্রহণে স্বাধীনতা পুরোপুরি নেই। “চাইলেই আমি অনেক কিছু করতে পারি না। কোথাও যেতে চাইলেও হয় না। যেমন আমার বন্ধুরা শুটিংয়ে যায় বিভিন্ন যায়গায়, আমি যদি বলি যে আমি যাব বা আমি এ কাজ করবো তখন বলে যে এটাতো ছেলেদের কাজ। তুমি করতে পারবা না। ওইদিক থেকে তারাই একটা সিদ্ধান্ত নিয়ে নেয় যে পারবে না..!”

আরেক ছাত্রী জেরিন তাসনিম বললেন মেয়ে হিসেবে প্রতি পদে বৈষম্যের অভিজ্ঞতা।

“আমার ভাইরা ছোটবেলা থেকে তাদের মনমতো ঘুরছে। যখন খুশি বাসা থেকে বের হয়, বাসায় আসে। কিন্তু আমার ডেডলাইন হচ্ছে সাতটা। আমি যদি সাতটা ত্রিশেও বাসায় ঢুকি তখন দেখা যায় আমার ভাই উল্টা আমার ওপর চড়াও হয়ে যায় যে তুমি কেন এত দেরি করলা?”

মেয়েদের জীবনসঙ্গী এমনকি বন্ধু বাছাইয়ের ক্ষেত্রেও নানা বিধিনিষেধের কবলে পড়তে হয় এখনো। মেয়ে হওয়ার কারণে সিদ্ধান্ত নেয়ার ব্যাপারটি পরিবারের হাতেই থাকে, চাইলেও অধিকাংশ মেয়ে স্বাধীনভাবে বন্ধু নির্বাচন করতে পারে না।

ফারজানা আক্তার বলেন, “রাতে দেরি করে বাসায় গেলে অনেক কথা শুনতে হয়, খারাপভাবে দেখা হয়। আর পোশাকের ব্যাপারটাও আমি অতটা স্বাধীন না। ওয়েস্টার্ন টাইপের পোশাক পরলে অনেকে মনে করে অভদ্র মেয়ে। হিজাবি যারা তাদেরকে ভদ্র মনে করা হয়। সবাই এরকম না কিন্তু কিছু মানুষের দৃষ্টিভঙ্গি এমনই।”

তবে জেরিন বলছেন বিয়ের ক্ষেত্রে কিছুটা স্বাধীনতা পাওয়া যাচ্ছে। “আগে আঠারো বছর হলেই বিয়ে দিত। আমাকেও বলেছিল বিয়ের কথা কিন্তু আমি অনেক বুঝিয়েছি অনেক কষ্ট করতে হয়েছে আমি পড়ালেখা করবো, নিজের পায়ে দাঁড়াবো তারপর আমি বিয়ে করবো। এই জায়গাটায় আমাকে স্বাধীনতা দিয়েছে কিন্তু সবজায়গায় না। ফ্যামিলির মনমতো যদি হয় তখন আমার পছন্দের মানুষকে আমি বাছাই করতে পারবো, এছাড়া না। পুরোপুরি স্বাধীনতা নেই।”