সুন্দরবন থেকে মুখ ফিরিয়ে নিচ্ছেন বিদেশি পর্যটকরা?

বাংলাদেশের দক্ষিণ-পশ্চিমাঞ্চল জুড়ে বিস্তৃত সুন্দরবন পৃথিবীর সর্ববৃহৎ ম্যানগ্রোভ বনাঞ্চল হিসেবে স্বীকৃত। বাংলাদেশ ও ভারতের পশ্চিমবঙ্গ জুড়ে বিস্তৃত এই বনের আকার দশহাজার বর্গকিলোমিটার, যার ৬,০১৭ বর্গকিলোমিটার রয়েছে বাংলাদেশের ভূখণ্ডে। ১৯৯৭ সালে ইউনেস্কো বিশ্ব ঐতিহ্যবাহী স্থানের তালিকায় অবস্থান করে নেয়া এই বনভূমির প্রায় ৩১ শতাংশই নদীনালা আর খালবিল, যার পরিমাণ ১,৮৭৪ বর্গকিলোমাটার।
.
দেশি-বিদেশি পর্যটকদের কাছে আকর্ষণীয় ও অন্যতম দর্শনীয় এ বন দেশের রাজস্ব আয়ের দিক থেকেও অতি গুরুত্বপূর্ণ। সুন্দরবনের মাছ, কাঠ, মধু থেকে বিপুল রাজস্ব আসে। এর পাশাপাশি বড় অংকের রাজস্ব আসে পর্যটকদের কাছ থেকে। কিন্তু নানা কারণে সুন্দরবনে বিদেশি পর্যটক আশংকাজনকভাবে কমছে। এমনটাই জানা গেছে বন বিভাগের বিগত কয়েক বছরের নথিপত্র থেকে।

সুন্দরবনের পূর্ব বন বিভাগের তথ্য মতে, ২০১২-১৩ সালে সুন্দরবনে বিদেশি পর্যটক এসেছিল ৩ হাজার ৮শ’ ৫৪ জন। ২০১৬-১৭ অর্থ বছরে তা নেমে এসেছে ২ হাজার ১শ’ ২৯ জনে।

২০১৩-১৪ অর্থ বছরে এ সংখ্যা ছিল ২ হাজার ৪শ’ ৬৫ জন। ২০১৪-১৫ অর্থ বছরে তা বেড়ে ৩ হাজার ৭শ’ ৪১ জনে পৌঁছুলেও ২০১৫-১৬ অর্থ বছরে ফের কমে ২ হাজার ৫শ’ ৩৭ জনে নেমে যায়।

শুধু বিদেশি নয়, ২০১২-১৩ অর্থ বছরের পরে ২০১৫-১৬ অর্থ বছর পর্যন্ত দেশি পর্যটকও পড়তিতেই ছিলো। ২০১২-১৩ সালে সুন্দরবনে দেশি পর্যটক সংখ্যা ছিল ১ লক্ষ ১৬ হাজার ৫শ’ ৬০ জন। ২০১৩-১৪ অর্থ বছরে এ সংখ্যা আশংকাজনক হারে নেমে ৭৫ হাজার ৭শ’ ৪২ জনে দাঁড়ায়। তবে ২০১৪-১৫ অর্থ বছরে কিছুটা বেড়ে ৭৭ হাজার ৪শ’ ৭৩ জন দেশি পর্যটক সুন্দরবন ভ্রমণ করেন। ২০১৫-১৬ অর্থ বছরে দেশি পর্যটক আরো বেড়ে হয় ৯১ হাজার ৮শ’ ২১ জন।

তবে ২০১৬-১৭ অর্থ বছরে দেশি পর্যটক সংখ্যা এক লাফে বেড়ে দাঁড়ায় ১ লক্ষ ২২ হাজার ৫শ’ ৩৪ জনে। যদিও বিদেশি পর্যটকদের বেশি রাজস্ব দিতে হয় বলে দেশি পর্যটক বাড়লেও সুন্দরবনের রাজস্ব আয় আগের চেয়ে কমেছে।

২০১২-১৩ অর্থ বছরে সুন্দরবন পূর্ব বন বিভাগের পর্যটকদের কাছ থেকে পাওয়া মোট রাজস্ব ছিল ১ কোটি ৩ লক্ষ ৬৮ হাজার ৮শ’ ৯০ টাকা। ২০১৩-১৪ অর্থ বছরে যা কমে দাঁড়িয়েছিল ৬৭ লক্ষ ৪ হাজার ৬০ টাকা। ২০১৪-১৫ অর্থ বছরে তা বেড়ে ৮৫ লক্ষ ৩১ হাজার ২শ’৭০ টাকায় পৌঁছুলেও ২০১৫-১৬ অর্থ বছরে ফের ৭৫ লক্ষ ৬৫ হাজার ৪শ’ ৮০ টাকায় নেমে যায়।
সর্বশেষ ২০১৬-১৭ অর্থ বছরে রাজস্ব আয় হয় ৮২ লক্ষ ৬১ হাজার ৬শ’ ১০ টাকা, যা ২০১২-১৩ অর্থবছরের চেয়ে প্রায় ২১ লাখ টাকা কম। এ হিসেবে গত পাঁচ অর্থবছরে সুন্দরবন থেকে অন্তত কোটি টাকা কম রাজস্ব আদায় হয়েছে।

তবে কি সুন্দরবন থেকে মুখ ফিরিয়ে নিচ্ছেন বিদেশী পর্যটকরা?
এ ব্যাপারে সুন্দরবনের পর্যটন স্পট করমজলের ইনচার্জ হাওলাদার আজাদ কবির পরিবর্তন ডটকমকে বলেন, ‘ব্যাপারটা করমজলের ক্ষেত্রে এমনটাই বলবো। বিদেশি কম আসছে। দেশি পর্যটক মোটামুটি আসলেও কিছু বানর, আটকা কিছু হরিণ- কুমির পর্যটকরা পছন্দ করছেন না।’

‘তাছাড়া মংলা থেকে করমজলে নদীপথে আসার ভাড়া অনেক বেশী বলে অনেক পর্যটক ক্ষোভ প্রকাশ করেছেন,’ মন্তব্য করেন কবির।
এদিকে, পূর্ব বন বিভাগের বিভাগীয় বন কর্মকর্তা মো. মাহমুদুল হাসান বলেন, ‘নিরাপত্তা সঙ্কটের পাশাপাশি সুন্দরবন কেন্দ্রিক বড় কোনো পর্যটন প্রকল্প না থাকায় পর্যটক ও রাজস্ব আয় কমছে।’

বঙ্গোপসাগর উপকূলবর্তী অঞ্চলে অবস্থিত সুন্দরবন একটি প্রশস্ত বনভূমি, যা বিশ্বের প্রাকৃতিক বিস্ময়াবলীর অন্যতম। পদ্মা, মেঘনা ও ব্রহ্মপুত্র নদীত্রয়ের অববাহিকার বদ্বীপ এলাকায় অবস্থিত এই অপরূপ বনভূমি বাংলাদেশের খুলনা, সাতক্ষীরা, বাগেরহাট, পটুয়াখালি ও বরগুনা জেলা জুড়ে বিস্তৃত। সমুদ্র উপকূলবর্তী নোনা পরিবেশের সবচেয়ে বড় ম্যানগ্রোভ বন হিসেবে সুন্দরবন বিশ্বের সর্ববৃহৎ অখণ্ড বনভূমি। সুন্দরবনকে জালের মত জড়িয়ে রয়েছে সামুদ্রিক স্রোতধারা, কাদা চর এবং ম্যানগ্রোভ বনভূমির লবণাক্ততাসহ ক্ষুদ্রায়তন দ্বীপমালা। মোট বনভূমির ৩১.১ শতাংশ, অর্থাৎ ১,৮৭৪ বর্গকিলোমিটার জুড়ে রয়েছে নদীনালা, খাঁড়ি, বিল মিলিয়ে জলাকীর্ণ অঞ্চল। রয়েল বেঙ্গল টাইগার ছাড়াও নানান ধরণের পাখি, চিত্রা হরিণ, কুমির ও সাপসহ অসংখ্য প্রজাতির প্রাণীর আবাসস্থল হিসেবে পরিচিত এই বন।