সেতু আতঙ্কে ভুগছেন কলকাতার বহু বাসিন্দা

ঢাকুরিয়ার মঙ্গলা বিশ্বাস, গড়িয়াহাটের রুমা পোদ্দার আর টালিগঞ্জের শঙ্কর সিং আতঙ্কে ভুগছেন।

দুদিন আগে মাঝেরহাটের ব্রিজটা ভেঙ্গে পড়ার পর থেকেই তাঁদের মনে ভয় ঢুকেছে। কারণ এই তিনজনও যে দক্ষিণ কলকাতার তিনটি গুরুত্বপূর্ণ সেতুর গায়ে অথবা নীচে কিংবা পাশেই থাকেন। ব্রিজগুলোকে ঘিরেই তাদের জীবন।

বৃহস্পতিবার দুপুরবেলা দক্ষিণ কলকাতার অতি ব্যস্ত গড়িয়াহাট মোড়ের উড়ালপুলের নিচে রান্না চাপিয়েছিলেন রুমা পোদ্দার।

মাছের ঝোলে ফোড়ন দিতে দিতেই বলছিলেন, “আমরা জন্ম থেকে এই ব্রীজের নীচেই থাকি। আরও অনেক পরিবার থাকে। পরশুদিন যখন প্রথম শুনলাম যে মাঝেরহাটে ব্রিজ ভেঙ্গে পড়েছে, তখন থেকেই মনে হচ্ছে হঠাৎ করে এখানে না কোনও ঘটনা হয়ে যায়।”

“বাচ্চাকাচ্চা নিয়ে আমরা তো থাকিই, সারাদিন রাত লাখ মানুষের যাতায়াত এই গড়িয়াহাট দিয়ে। তাই ভয় তো পাচ্ছিই।”

ওই উড়ালপুলের নীচেই বসবাস করেন পূর্ণিমা পোদ্দার।

তাঁর কথায়, “মাঝেরহাটের ব্রিজ ভাঙ্গার খবর জানার পর থেকেই ভয় তো হচ্ছেই। ছেলেপুলে নিয়ে থাকি। কোনও যদি ঘটনা ঘটে যায়, পালানোর সময়ও কি পাব?”

ওই ব্রিজের নিচেই গাড়ি পার্কিংয়ের ব্যবস্থা দেখভাল করেন পার্কিং অ্যাটেন্ডেন্ট রাহুল পোদ্দার।

তিনি বলছিলেন, “ওই ব্রিজটার মতো যে এটার অবস্থা হবে না, সেটা কি কেউ বলতে পারে? শুধু আমার না, এখানে যত ড্রাইভার বা মালিক গাড়ি পার্ক করতে আসছেন, তারাও সবাই এই প্রশ্নটাই করছেন, যে মাঝেরহাটের মতো এটা আবার ভেঙ্গে পড়বে না তো? সকলের মনেই একটা ভয় ঢুকেছে।”

এই উড়ালপুল পেরিয়ে রোজ প্রায় সাত থেকে আটবার মিনিবাস নিয়ে কলকাতার কেন্দ্রস্থল বিবাদী বাগ এলাকায় যান চালক স্বপন বিশ্বাস আর বাসের কন্ডাক্টর সমীর গুহ।

দক্ষিণ কলকাতা থেকে বিবাদী বাগ বা ডালহৌসি যেতে হলে তাদের বাস নিয়ে অন্তত তিনটি ব্রিজ আর ফ্লাইওভার পেরতে হয়। আরেকটি ফ্লাইওভারের নিচ দিয়ে যেতে হয় বেশ অনেকটা পথ।

দীর্ঘদিন ধরে বাস চালাচ্ছেন তারা, তবে দুজনেই বলছিলেন যে সেতু বা ব্রিজগুলো পার হওয়ার সময়ে দুদিন ধরে একটু ভয় করতে শুরু করেছে তাদের।

গড়িয়াহাটের উড়ালপুলটার বয়স প্রায় দুদশক, যেখানে মঙ্গলবার ভেঙ্গে পড়া মাঝেরহাট ব্রিজ তৈরি হয়েছিল প্রায় ৫০ বছর আগে।

তবে তার থেকেও পুরনো, ৮২ বছরের একটি সেতু রয়েছে টালিগঞ্জে, আদিগঙ্গার ওপরে। সেটা পেরিয়েই রোজ দুবেলা যাতায়াত করতে হয় স্থানীয় বাসিন্দা শঙ্কর সিংকে।

ওই ব্রিজের ওপরেই দেখা হয়েছিল তার সঙ্গে।

বলছিলেন, “ব্রিজটার অবস্থা খুব খারাপ। নীচের দিকে গেলে নিজের চোখেই দেখতে পাবেন। সিমেন্ট খসে গিয়ে রড বেরিয়ে গেছে, সেগুলোতে আবার জঙ ধরে গেছে। দুবেলা যাতায়াত করি, যে কোনও সময়ে বিপদ ঘটতে পারে।”

ওই টালিগঞ্জ ব্রিজের ওপরেই বাজার রয়েছে একটি। সেখানেই কাপড়ের দোকান মনোরঞ্জন পোড়ের।

“বহু বছর দোকান চালাচ্ছি, আগে কাঁপুনি হত না। কিন্তু এখন দেখি একটু বড় গাড়ি গেলেই ভাইব্রেশন হয়। কিন্তু এখানে দোকান, তাই পেটের দায়ে ভয় নিয়েও দোকান দিতেই হয়। দোকানের সামনেই বেশ কয়েক জায়গা ফেটে গিয়েছিল, নিজেরাই সিমেন্ট দিয়ে বুজিয়েছি,” বলছিলেন মি. পোড়ে।

পাশেই সব্জি বিক্রি করেন পূর্ণিমা মন্ডল।

তিনি বলছিলেন, “বহু বছর থেকেই দেখি বড় গাড়ি গেলেই কাঁপে ব্রিজটা। তাই এখন অভ্যেস হয়ে গেছে। মাঝেরহাটের ব্রিজ ভাঙ্গার পরে তাই নতুন করে মনে ভয় ঢোকেনি আমার মনে।”

তবে মঙ্গলবার বিকেলে মাঝেরহাটের ব্রিজ যেভাবে হঠাৎ করে ভেঙ্গে পড়েছে, সেই দৃশ্য দেখার পর থেকে কলকাতার মান্যগণ্য বাসিন্দা থেকে শুরু করে সাধারণ মানুষ, অনেকেই সামাজিক মাধ্যমে লিখতে শুরু করেছেন, যে কোনও ব্রিজ বা ফ্লাইওভার পেরনোর সময়ে তাদের মনে একটা ভয় কাজ করতে শুরু করেছে।

ভয়টা হয়তো অমূলকও নয়। কারণ এই প্রথম যে কলকাতায় কোনও সেতু ভেঙ্গে পড়ল, তা নয়। গত পাঁচ বছরে মাঝেরহাট নিয়ে তিনটি সেতু ভেঙ্গেছে।

বিমানবন্দর থেকে শহরে আসার রাস্তায়, উল্টোডাঙ্গার ফ্লাইওভারের একটি অংশ হঠাৎই ধসে গিয়েছিল রাত্রিবেলা একটি ট্রাকসহ। সেবার কেউ নিহত হননি। আহত হয়েছিলেন ওই ট্রাকের দুজন কর্মী।

তারপরে ২০১৬ সালে উত্তর কলকাতায় একটি নির্মীয়মান ফ্লাইওভারের একটা বড় অংশ ভেঙ্গে পড়েছিল। মৃত্যু হয়েছিল ২৭ জনের। আহত হন ৮০জন।

তারপরে সর্বশেষ সেতু ভেঙ্গে পড়ার ঘটনা মাঝেরহাটে, যেখানে তিনজন মারা গেছেন, আর আহতের সংখ্যা ২৫।

ভেঙ্গে পড়া মাঝেরহাট ব্রিজটির কাছাকাছি বয়স ঢাকুরিয়া ব্রিজেরও, যার পোষাকি নাম চৈতন্য মহাপ্রভু সেতু।

সেটির নীচ দিয়ে যে রেললাইন পশ্চিমে বজবজের দিকে চলে গেছে, সেই একই লাইনের ওপরেই অবস্থিত ছিল মাঝেরহাট ব্রিজটিও।

কয়েক বছর আগে আবিষ্কৃত হয় যে বিরাট আকারের ইঁদুর প্রচুর সংখ্যায় ঢুকে ঢাকুরিয়া ব্রিজটি নড়বড়ে করে দিয়েছে।

প্রথমে সেই ইঁদুর নিধন চললো, তারপরে গতবছর প্রায় দেড়মাস ধরে ব্রিজের একটা অংশ বন্ধ করে রেখে মেরামত করা হয়েছে।

ওই ব্রিজের নিচে বসবাস করেন, এমন কয়েকজন বলছিলেন, যেভাবে সেতু মেরামতি হয়েছে, তারপরে তাদের মনে এখন আর সেটি ভেঙ্গে পড়ার ভয় নেই।

ওই ব্রীজের ঠিক নীচে একটি ছোট দোকান চালান ত্রিপুরারি হালদার।

তিনি বলছিলেন, “যেভাবে মেরামত করা হয়েছে চোখের সামনেই দেখেছি তো। ভালই কাজ হয়েছে। একবার ইঁদুর সরানো হয়েছে, তারপরে সেই গর্তগুলোকে বুজিয়ে দিয়ে ওপরটা নতুন করে সারাই করেছে।”

কিন্তু ওই ব্রিজের ঠিক যে অংশ মেরামত করা হয়েছে, সেই জায়গাতেই দাঁড়িয়ে বৃহস্পতিবার দুপুরে ছবি তুলতে গিয়ে পাশ দিয়ে একটা বাস চলে যাওয়ার সময়ে অনুভব করলাম, একটু কেঁপে উঠল পায়ের নিচটা।

তাহলে কি আমার মনের ভুল? না কি এটা জিফাইরোফোবিয়া – সেতু নিয়ে একটা মানসিক আতঙ্ক?

যেটা কলকাতার অনেক মানুষের মনেই তৈরি হয়েছে!

ত্রিপুরারি হালদারের এক প্রতিবেশী মঙ্গলা বিশ্বাস অবশ্য বলছিলেন, “ওপর থেকে সারানো হয়েছে ঠিকই, কিন্তু নীচে ভেতরের দিকে চিড় ধরছে। রেললাইনের দিকটায় গেলে দেখতে পাবেন।”

ব্রিজের অন্যদিকে দর্জির দোকান চালান পঙ্কজ মন্ডল আর তাঁর স্ত্রী অঞ্জলি মন্ডল।

তারা বললেন, “দুবার করে মেরামতি হয়েছে ঠিকই। কিন্তু কতটা কী হয়েছে সে তো আর আমরা জানি না। তবে এটা দেখছি যে প্রত্যেক বছর ব্রীজটার নীল-সাদা রং হচ্ছে।”

পশ্চিমবঙ্গে সব সরকারি ভবন, রাস্তা ডিভাইডার বা সেতুর ধারগুলি গত ৫-৬ বছর ধরেই নীল-সাদা রং করা হচ্ছে, যেটা রাজ্যের মুখ্যমন্ত্রী মমতা ব্যানার্জির প্রিয় রং বলে পরিচিত।

-বিবিসি বাংলা