বেগম রোকেয়া বিশ্ববিদ্যালয়

সেশনজটের ছোবল থেকে মুক্তি পাবেনা কি শিক্ষার্থীরা?

এইচ. এম নুর আলম : সেশনজট- বিশ্ববিদ্যালয় লাইফে ভয়াবহ একটি নাম। প্রাইমারি লেভেলে এই শব্দটির সাথে কেউ পরিচিত না হলেও কলেজ ও ভার্সিটি লাইফে যে কোনো শিক্ষার্থীর জন্য এই শব্দটি আঁতকে ওঠার মতো। সেশন এবং জট দুটি শব্দ নিয়ে সেশনজট গঠিত হলেও এর ছোবল অত্যন্ত ভয়াবহ। তার বাস্তব চিত্র রংপুরের বেগম রোকেয়া বিশ্ববিদ্যালয় (বেরোবি)। নয় বছরের বিশ্ববিদ্যালয়ে কম বেশি তিন বছরের ভয়াবহ সেশনজটের কবলে পড়েছে শিক্ষার্থীরা। বিশ্ববিদ্যালয়ে অনার্স আর মাস্টার্স শেষ করতে প্রায় ৭/৮ বছর লেগে যাচ্ছে।

প্রতিষ্ঠালগ্ন থেকেই কমবেশি সকল বিভাগেই শিক্ষার্থীদের জন্য হুমকীস্বরুপ সেশনজট নামের কালো ছায়াটি বিদ্যমান । তবে বর্তমানে এটি চরমপর্যায়ে উপনীত হয়েছে বলে জানিয়েছেন সেশনজটের কবলে পড়া বিশ্ববিদ্যালয়ের বিভিন্ন বিভাগের শিক্ষার্থীরা।

বর্তমানে বিশ্ববিদ্যলয়ে মোট ২১ টি বিভাগ রয়েছে। যেখানে ব্যবসা অনুষদের ৪টি বিভাগ ব্যতীত বাকী অনুষদের সবগুলোতেই কমবেশি সেশনজট রয়েছে। এর মধ্যে কম্পিউটার সায়েন্স এন্ড ইঞ্জিনিয়ারিং বিভাগ, ভূগোল ও পরিবেশ বিজ্ঞান, রসায়ন,গণিত,উইমেন এন্ড জেন্ডার স্টাডিস, গণযোগাযোগ ও সাংবাদিকতা, বাংলা, ইতিহাস ও প্রতœতত্ত্ব বিভাগসহ আরো কয়েকটি বিভাগ দেড় থেকে দুই বছরের সেশনজটে রয়েছে। বিশ্ববিদ্যালয়ের ২০১১-১২ শিক্ষাবর্ষের শিক্ষার্থীদের কয়েকটিমাত্র বিভাগের পরীক্ষা ফলাফল প্রকাশিত হলেও এখনো ফলাফল দিতে পারেনি দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা, বাংলা, উইমেন এন্ড জেন্ডার স্টাডিজসহ বেশ কিছু বিভাগে। এখনও পরীক্ষা দিতে পারেনি ইংরেজি বিভাগের শিক্ষার্থীদের।

বেরোবিতে পড়–য়া অধিকাংশ শিক্ষার্থীরা মধ্যবিত্ত ও নি¤œ মধ্যবিত্ত পরিবারের সন্তান। এতে বিশ্ববিদ্যালয়ের ৪র্থ-৭ম ব্যাচের শিক্ষার্থীরা বেশি শিকার।

সেশনজটের কারণ হতে পারে একাডেমিক ও প্রশাসনিক জটিলতা দুটোই। তবে বেগম রোকেয়া বিশ্ববিদ্যালয়ে যে সব কারণে সেশনজট তৈরি হয়েছে সেগুলো হলো- শিক্ষক স্বল্পতাজনিত সেশনজট, দুই উপাচার্যের আমলে দুটি বড় আন্দোলন সেশনজট, নির্ধারিত সময়ে সেমিস্টার শেষ করতে না পারা , অন্ত:কোন্দলজনিত সেশনজট এবং শিক্ষকদের আন্তরিকতার অভাব।

শিক্ষক স্বল্পতাজনিত সেশনজট: বিশ্ববিদ্যালয় মঞ্জুরী কমিশনের (ইউজিসি) বিধি মোতাবেক প্রতি বছর যে শিক্ষক নিয়োগ দেওয়া হয়ে থাকে, এর সাথে প্রতি বছর যে পরিমাণ শিক্ষক অন্যত্র চলে যায় বা শিক্ষাছুটিতে যায় অনেক সময় তার ঘাটতি পূরণ করা হয় না। ফলে নামেমাত্র কোনো বিভাগে কিছু সংখ্যক শিক্ষক থাকলেও শিক্ষাছুটিতে থাকেন অনেকেই। ফলে শিক্ষক স্বল্পতার কারণে জটটা আরো প্রতি সেমিস্টার ৫-৬%বেড়ে যায়। কারণ, প্রতি বছর নতুন নতুন ব্যাচ সৃষ্টি হয় কিন্তু শিক্ষক সংখ্যা বাড়ে না। ফলে স্থায়ী সেশনজটের সৃষ্টি হয় যা লক্ষণীয় মাত্রায় পৌঁছেছে এখানে।

দুই উপাচার্যের আমলে দুটি বড় আন্দোলন: সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিরা এবং শিক্ষার্থীরা মনে করেন, ড. আব্দুল জলিল মিয়ার নিয়ম বহির্ভূুতভাবে নিয়োগ প্রক্রিয়া এবং স্বজনপ্রীতি এবং ড. একে এম নূর-উন-নবী’র বিরুদ্ধে আনীত অভিযোগও অপসারনে যে বড় দুটি আন্দোলন হয়েছে এতে এক বছর পিছিয়েছে বিভাগগুলোর শিক্ষাকার্যক্রম। আন্দোলনে নের্তৃত্বদানকারিরা সেটা পুষিয়ে দেওয়ার প্রতিশ্রুতি দিলেও কয়েকটি বিভাগের কিছুটা সম্ভব হলেও বাকীরা তা করেন নি। ফলে শিক্ষার্থীদের মাঝে চরম দুর্ভোগ দেখা দিয়েছে।

বিশ্ববিদ্যালয়ের বিভিন্ন বিভাগের শিক্ষকদের মাঝে অন্ত:কোন্দলের কারণে নির্ধারিত সময়ে সেমিস্টার শেষ করতে না পারায় সেশনজটের ব্যাপ্তি বেড়েছে বলেও শিক্ষার্থীরা অভিযোগ করেছেন। এছাড়াও অন্যান্য কারণের মধ্যে রয়েছে-

স্বার্থসংশ্লিষ্টতা ও প্রশাসনের একগুঁয়েমিতা: কখনো কখনো শিক্ষক-শিক্ষার্থী-কর্মকর্তা আর কর্মচারিরা তাঁদের দাবি আদায় ও স্বার্থ রক্ষার আন্দোলনে নামেন। দিনের পর দিন আন্দোলন চললে ক্লাস-পরীক্ষা ভাগাড়ে যায়। এ সময় বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসনের কার্যকর পদক্ষেপ না নেওয়া ও কখনো কখনো একগুঁয়েমিতার কারণে এ আন্দোলন তীব্র আকার ধারণ করে। ফলে সহিংসরুপ নিলে কর্তৃপক্ষ বন্ধ ঘোষণা করেন বিশ্ববিদ্যালয়। এছাড়াও দাবি না মেটানো এবং যথাযথ উদ্যোগ গ্রহণ না করায় ক্ষোভ থেকে সেটা ভয়াবহ আন্দোলনে রুপ দেয় যার স্বাক্ষী রংপুরের বেগম রোকেয়া বিশ্ববিদ্যালয়।

আন্তরিকাতা ও একাধিক দায়ত্ব গ্রহণ: উপর্যুক্ত সমস্যাগুলো বিদ্যমান থাকলেও শিক্ষকদের আন্তরিকতার অভাবেও অনেক সময় সেমিস্টার পিছিয়ে যায়। সেমিস্টারে ক্রেডিট আওয়ার পদ্ধতিতে ৩০ টির মতো ক্লাস( ১৫ সপ্তাহে ৪৫ ঘন্টা) নেওয়ার কথা থাকলেও সব ক্লাস নেন না বেশ কিছু শিক্ষক। কখনো কখনো ৬/৭ টি ক্লাস নিয়েই ক্ষান্ত হন কিছু শিক্ষক। আবার এই ক্লাস শুরু করতেই লাগে ২/৩ মাস। কোনো কোনো শিক্ষক ৬ মাসের শেষের দুই মাস বা একমাসেও ক্লাস নিতে গিয়ে আন্তরিকতার পরিচয় দেন না। এর ফলে পড়াশুনার চাপ বাড়ে। ফলাফল খারাপ করেন শিক্ষার্থীরা। যেখানে মাঝে মাঝে ক্লাস শেষ করতে চার মাসও লাগে না সেখানে ছয় মাসেও সেমিস্টার শেষ না হওয়ায় দুশ্চিন্তায় ভোগেন শিক্ষার্থীরা। নির্দিষ্ট সময়ের পর সেমিস্টার শেষ হলেও আবার ফলাফল প্রকাশ নিয়ে জটিলতা সৃষ্টি হয়। অনেক শিক্ষকের একাধিক দায়িত্ব থাকায় ক্লাস নিতে পারেন না তাঁরা।

নির্দিষ্ট সময়ে সেমিস্টার শেষ করতে না পারা: সেমিস্টার পদ্ধতিতে পরিচালিত বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে নির্দিষ্ট সময়ে সময়ে সেমিস্টার শেষ করতে না পারায় খানিকটা সেশনজটের ছোবলে পড়ে শিক্ষার্থীরা। একটি সেমিস্টার ছয় মাসে শেষ করার কথা থাকলেও শেষ হয় ৮/৯ মাসে। কখনো এটার ব্যাপ্তি ১০ মাসেও পৌঁছে। ফলে বারো মাসে বা এক বছরে দুটি সেমিস্টার শেষ হওয়ার কথা থাকলেও দেড় বছর লেগে যায়।

অনেক বিভাগের শিক্ষার্থীরাই সেমিস্টার সঠিক সময়ে শেষ না হওয়ায় সেশনজটে পড়ার একটি কারণ হিসেবে সংশ্লিষ্ট বিভাগের শিক্ষকদের আন্তরিকতাকে দায়ী করেছেন। তাদের অনেকখানি অভিযোগ করতে দেখা গেছে যে, পরীক্ষা শেষ হবার পরও ২/৩ মাসেও পরীক্ষা নিয়ন্ত্রণ দপ্তরে ফলাফল পাঠানো হয় না। বিশ্ববিদ্যালয়ের চার বছর মেয়াদী ব্যাচেলর ডিগ্রী প্রোগ্রাম সংক্রান্ত ১২ তম সিন্ডিকেটে অনুমোদনপ্রাপ্ত ‘সংবিধি ও প্রবিধি’ অনুযায়ী প্রত্যেক সেমিস্টার ফাইনাল ফলাফল পরীক্ষা সমাপ্তি থেকে ছয় সপ্তাহ এবং চতুর্থ বর্ষের ২য় সেমিস্টার ফাইনাল শেষ পরীক্ষাসহ ইন্টার্নশীপ/মনোগ্রাফ বা ভাইভার পর ৮ সপ্তাহের মধ্যে প্রকাশ করার কথা বলা হলেও তা করতে পাচ্ছে না বিভাগগুলো। প্রত্যেক সেমিস্টারের ক্লাস-পরীক্ষা শুরু এবং শেষ সংক্রান্ত একাডেমিক ক্যালেন্ডার প্রণয়নের কথা থাকলেও এটি নামে মাত্র দেওয়া হয় কিন্তু কার্যকারিতা নেই।

তবে শিক্ষকরা দাবি করেছেন, সেশনজটের মূল কারণ হলো শিক্ষক সংকট। একটি বিভাগের প্রত্যেক ব্যাচে শিক্ষার্থীর তুলনায় প্রয়োজনীয় সংখ্যক শিক্ষক নেই। ফলে একজন শিক্ষককে প্রতিনিয়ত ২/৩ টির জায়গায় ৭/৮ টি কোর্সের ক্লাসও নিতে হয়। আবার পরীক্ষা শেষে একই সাথে খাতাও মূল্যায়ন করতে হয় ফলাফল প্রদান করার জন্য। ফলে হিমশিম খেতে হচ্ছে শিক্ষকদের। আবার বিশ্ববিদ্যালয়ের ২০১৭ সালের ডায়েরি অনুযায়ী, বিশ্ববিদ্যালয়ে সাড়ে আট হাজার শিক্ষার্থীর জন্য শিক্ষক রয়েছেন ১৪৫ জন। এর মধ্যে মোট ১৪ টি বিভাগে ২৪ জনের মতো শিক্ষক দেশে-বিদেশে শিক্ষাছুটিতে রয়েছেন যাদের পরিবর্তে বদলি কোনো শিক্ষক নেই। এ ভয়াবহ রুপ থেকে পরিত্রাণ পেতে পর্যাপ্ত শিক্ষক নিয়োগের কথা জানিয়েছেন শিক্ষকগণ।

প্রতি বছর বিশ্ববিদ্যালয়ের ভর্তি পরীক্ষা সঠিক সময়ে অনুষ্ঠিত হবার কথা থাকলেও নানা আন্দোলন আর সমস্যার কারণে সংগঠিত হয় না। নভেম্বরে বা ডিসেম্বরে পরীক্ষা অনুষ্ঠিতের তারিখ নির্ধারিত হলেও বিশ্ববিদ্যালয়ের বিভিন্ন জটিলতার কারণে মাস পিছিয়ে যায় যার প্রমাণ গত কয়েক বছরের ভর্তি পরীক্ষা। একাডেমিক বর্ষ জানুয়ারি থেকে শুরুর কথা থাকলেও সেটি গড়িয়ে মার্চ-এপ্রিলে চলে যায়। ফলে আরো একদফা সেশনজটের বোঝা কাঁধে নিয়েই নতুন একটি ব্যাচকে প্রবেশ করতে হয় পরবর্তী সংগ্রাম মোকাবেলা করতে।

এই সেশনজটের কবল থেকে মুক্তি পেতে চায় শিক্ষার্থীরা। সাবেক দুই উপাচার্যের আমল অনিয়মের বেড়াজালে আবদ্ধ থাকলেও সে কারণে বর্তমান উপাচার্যের আমল যেনো সুন্দর হয় সেটি প্রত্যাশা সকলের। সেশনজটের এই ছোবল থেকে মুক্তি পেতে নতুন উপাচার্য ড. নাজমুল আহসান কলিমউল্লাহ (বিটিএফও) কে কার্যকর ভূমিকা পালন করতে হবে। বিভাগগুলোতে পর্যাপ্ত পরিমাণে শিক্ষক নিয়োগ দিতে হবে।
গণযোগাযোগ ও সাংবাদিকতা এবং ইতিহাস ও প্রতœতত্ত্ব বিভাগের শিক্ষক নিয়োগ জটিলতা দূর করতে হবে। একাডেমিক ভবন নির্মাণ করে বিভাগগুলোর ক্লাসরুমের পর্যাপ্ততা দিতে হবে, সেমিনারে বই এবং ল্যাব না থাকায় নির্দিষ্ট কোর্সের ক্লাস করতে পারছে না অনেকেই, সেটা নিশ্চিত করতে হবে। শিক্ষক-শিক্ষার্থীসহ অন্যান্যদের ন্যায্য দাবি পূরণ করতে হবে। তা না হলে এর ফলে অনাহূত আন্দোলন এবং সংকট সৃষ্টি হতে পারে।

নির্দিষ্ট সময়ে একাডেমিক শিক্ষাবর্ষ শেষ করতে না পারায় বছরে বছরে মোটা অংকের টাকা গুণতে হচ্ছে এইসব শিক্ষার্থীদের পরিবারের। এছাড়াও চাকুরির আবেদনও করতে পাচ্ছেনা অনেক শিক্ষার্থী। পর্যাপ্ত ল্যাব ও সেমিনারে বইয়ের অভাবে শিক্ষার্থীদের শিক্ষার মানোন্নয়নে বাধাগ্রস্ত হচ্ছে- এ বিষয়ে বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসনের কার্যকর পদক্ষেপ নিতে হবে। প্রত্যেক বিভাগের শিক্ষকদের সাথে একাডেমিক কাউন্সিলিং করতে হবে। শিক্ষকরা অনেক সময় একাধিক দায়িত্বে থাকলে নির্দিষ্ট সময়ে ক্লাস-পরীক্ষা নিতে পারেন না। এর ফলেও সেশনজট হতে পারে। সেজন্য শিক্ষকদের একাধিক দায়িত্ব থেকে মুক্তি দিতে হবে।

সর্বোপরি একটি বিধি-সংবিধি প্রণয়ন করে স্বচ্ছতার সাথে পরিকল্পনামাফিক বিশ্ববিদ্যালয়ের জটিলতা ও সেশনজট নিরসন এবং মানোন্নয়নে কাজ করতে হবে।

লেখক : শিক্ষার্থী, বেগম রোকেয়া বিশ্ববিদ্যালয়, রংপুর।