সৌদি আরব কি সত্যি বদলাচ্ছে? | তসলিমা নাসরিন

মেয়েদের গাড়ি চালানোর ওপর যে নিষেধাজ্ঞা ছিল, সৌদি আরব গতকাল সেটি তুলে নিয়েছে। মেয়েরা ২০১৮ সালের জুন মাস থেকে গাড়ি চালাতে পারবে।

এটি বিশাল এক সুসংবাদ বটে। ১৯৯০ সালে মেয়েরা প্রথম রাস্তায় নেমেছিল গাড়ি চালানোর অধিকার চাইতে। ৪৭ জন মেয়ে রিয়াদ শহরে গাড়ি চালিয়েছিল। ৪৭ জন মেয়েকেই গ্রেফতার করা হয়েছিল, ওদের মধ্যে কারও কারও চাকরি গেছে। এমন নারীবিদ্বেষী সৌদি রাজতন্ত্র হঠাৎ করে কি নারী স্বাধীনতায় বিশ্বাস করতে শুরু করেছে? মোটেও তা নয়। মেয়েদের গাড়ি চালাতে দেওয়া হয় না—এ নিয়ে গোটা পৃথিবী, বিশেষ করে ইউরোপ, আমেরিকা সৌদি আরবের নিন্দেয় মুখর। নারী-নির্যাতনের দেশ হিসেবেই দেখে সৌদি আরবকে। যাদের সঙ্গে ব্যবসা বাণিজ্য, তারাই দেখে। তেলের ক্রেতারাই। শত প্রশ্নের সামনে অপ্রস্তুত দাঁড়াতে হয় সৌদি আরবকে। তেলের মূল্য বাড়ানো যায় না। অর্থনীতিকে আরও টগবগে করা যায় না। এ কারণেই সৌদি সরকার সিদ্ধান্ত নিয়েছে গাড়ি চালাতে দেবে মেয়েদের। বলতে হয়, এতকাল পর সভ্যতার মুখ দেখবে বলে নারীবিরোধী দেশটি সিদ্ধান্ত নিয়েছে। ভয়াবহ নিন্দে থেকে বাঁচতে গাড়ি চালানোর অনুমতি দিয়েছে মাত্র। এতকাল গাড়ি পুরুষ-আত্মীয়দের দিয়ে চালাতে হতো মেয়েদের, এখন নিজে চালাবে। মেয়েরা বলছে ট্যাক্সিতেও তাদের টাকা ঢালতে হতো, সে টাকাটা বাঁচবে এবার।

সৌদি আরবের এক মন্ত্রী বলেছিলেন, মেয়েরা গাড়ি চালালে মেয়েদের তলপেটের ক্ষতি হবে। কিছুদিন আগে এক সৌদি ইমামও বলেছেন, মেয়েদের মস্তিষ্কের আকৃতি পুরুষের মস্তিষ্কের চার ভাগের এক ভাগ, তাই মেয়েদের গাড়ি চালানো নিষেধ। এমন নারীবিদ্বেষ আজ কিন্তু উবে যায়নি সৌদি পুরুষের মন থেকে। আগের মতোই ঘৃণাগুলো বহাল তবিয়তে আছে। মেয়েদের গাড়ি চালানোর অনুমতি দেওয়া হচ্ছে এ খবর পেয়েই হোয়াটসঅ্যাপে রক্ষণশীল সৌদিদের শুরু হয়ে গেছে বিরোধিতা, এই আইন তারা নাকি প্রয়োগ করতে দেবে না, মেয়েদের ব্যভিচারী হতে দেবে না। মেয়েরা গাড়ি চালালে, অনাত্মীয় পুরুষের সঙ্গে কথা বললে নিশ্চিত ব্যভিচারী হবে, এ তাদের দৃঢ় বিশ্বাস।

সৌদি আরবের নারীবিরোধী অপসংস্কৃতিগুলো, আমার মনে হয় না, খুব সহজে দূর হবে। ওগুলো যেমন আছে, তেমনই থাকবে দীর্ঘকাল। প্রতিটি মেয়ের জন্যই বোরখা বাধ্যতামূলক। কোনও ফাঁক-ফোকর দিয়ে মাথার দু’একটি চুল দৃশ্যমান হলেই সর্বনাশ! বোরখায় আপাদমস্তক মুড়ে সব মেয়েকেই চলাফেরা করতে হবে। তারা রাস্তায় হাঁটুক বা গাড়ি চালাক। মেয়েরা গাড়ি চালাবে, কিন্তু নারীবিদ্বেষী সব আইন রয়েই যাবে। মেয়েরা ধর্ষণের শিকার হলে, শাস্তি মেয়েদেরই পেতে হবে। কারণ, ধর্ষণ ঘটেছে—এই প্রমাণ দেখাতে চারজন সাক্ষী হাজির করতে হবে। ধর্ষণ বলে কোনও শব্দ সৌদি অভিধানে নেই, যা আছে তা ব্যভিচার। ব্যভিচারের শাস্তি নারী-পুরুষ উভয়ে পায়। ধর্ষক না হয় শাস্তি পায়, ধর্ষণের শিকারকেও কেন শাস্তি পেতে হবে! অনাত্মীয় পুরুষের সঙ্গে কোনও মেয়েকে দেখা গিয়েছে, এর মানে মেয়েটি ব্যভিচার করেছে। মেয়েদের অপহরণ করে এনে গণধর্ষণ করলেও মেয়েদের দোষ, চারজন সাক্ষী না নিয়ে এলে ধর্ষকদের মতো শাস্তি তারাও পাবে। সাক্ষী কোথায় পাবে মেয়েরা? ধর্ষকরা কি সাক্ষী রেখে ধর্ষণ করে?

সৌদি মেয়েরা স্বামীর অনুমতি ছাড়া দেশের বাইরে ভ্রমণ করতে পারে না। রোগের চিকিৎসা করতে গেলেও পুরুষ-অভিভাবকের অনুমতির দরকার হয়। পুরুষ-অভিভাবকের অনুমতি ছাড়া মেয়েদের বিয়ে করা, তালাক দেওয়া, ইস্কুল-কলেজে পড়া, চাকরি করা, ব্যবসা করা, ব্যাংক অ্যাকাউন্ট খোলা সম্ভব নয়। মেয়েদের অভিভাবক পিতা, স্বামী, ভাই, কাকা বা পুত্র। কোনও অনাত্মীয় পুরুষের সঙ্গে মেলামেশা মেয়েদের জন্য নিষিদ্ধ। ২০১৩ সালে সড়ক দুর্ঘটনায় গুরুতর আহত এক মহিলাকে বাঁচানোর জন্য তার হাত কেটে ফেলার প্রয়োজন ছিল। কিন্তু এই অপারেশন সম্ভব হয়নি কারণ মহিলার কোনও পুরুষ-অভিভাবক ছিল না, অপারেশনের জন্য যে অভিভাবক অনুমতি দিতে পারত। স্বামী ছিল, স্বামী সেই একই গাড়ি দুর্ঘটনায় মারা গিয়েছিল।

মানাল আল-শারাফ নামের যে সৌদি মেয়েটি ২০১১ সালে রাতের অন্ধকারে সৌদি আরবে গাড়ি চালিয়েছিল, আর তার সেই চালানোটা রেকর্ড করে ইউটিউবে দিয়েছিল, যে কারণে তার জেলও হয়েছিল, সে বলেছে, মেয়েদের গাড়ি চালানো থেকে নিষেধাজ্ঞা উঠেছে, এবার লড়াইটা করতে হবে অভিভাবক আইনের বিরুদ্ধে। মেয়েদের যে পুরুষ-অভিভাবক ছাড়া স্বাভাবিক জীবন-যাপন করার অনুমতি নেই, তার বিরুদ্ধে। মেয়েরা নিজেই নিজের অভিভাবক—এটিই প্রতিষ্ঠিত করতে হবে। জানি না, অভিভাবক আইন নির্মূল করতে আর কত যুগের প্রয়োজন। মানাল এই দাবিগুলো জোরেশোরে করছে। সৌদি আরবে বসে এই দাবিগুলো করতে পারত না। অস্ট্রেলিয়ায় আছে বলেই করতে পারছে। আরব দেশ ছিল বর্বরদের দেশ। মারামারি, হানাহানি, কাটাকাটি, রক্তারক্তি—এই করত লোকেরা। মেয়েদের মানুষ বলে কোনও দিন মনে করেনি। আজও মেয়েদের মানুষ বলে মনে করার কোনও লক্ষণ নেই। অর্থনীতির স্বার্থে, আর নিন্দে থেকে বাঁচার স্বার্থে মেয়েদের গাড়ি চালানোর অনুমতি দিচ্ছে, মেয়েদের অধিকার রক্ষা করার জন্য কিছুই করছে না। বিবাহ, তালাক, সন্তানের অভিভাবকত্ব, উত্তরাধিকার—এসব আইন খাটিয়ে মেয়েদের চরমভাবে বঞ্চিত করছে, মানবাধিকারও ভীষণ লঙ্ঘন করছে। মেয়েদের নিজের অধিকার দাবি করারও অধিকার ও-দেশে নেই। সরকারিভাবেই যৌনবস্তু হয়ে বেঁচে থাকতে হয়। যৌনবস্তু বলেই বা কারও ব্যক্তিগত সম্পত্তি বলেই পায়ে শেকল পরে থাকতে হয়।

যে মেয়েই স্বাধীনতা চায়, তাকে দেশ থেকে বেরিয়ে যেতে হয়। এভাবে ক’দিন! পৃথিবীর অনেক বর্বর দেশই সভ্য হয়েছে, অনেক নারীবিরোধী সমাজ নারীর সমানাধিকার মেনে নিয়েছে। কিন্তু সৌদি আরব পৃথিবীর অন্যতম দরিদ্র দেশ থেকে পৃথিবীর অন্যতম ধনী দেশ হয়ে উঠলেও, এত বিশাল পরিবর্তনের মধ্য দিয়ে দেশটি গেলেও, পাশ্চাত্যের দেশ থেকে তেলের খনি আবিষ্কার থেকে শুরু করে হাসপাতালের ডাক্তারি প্রায় সবই শিখলেও, নারীর সমানাধিকার সম্পর্কে কিছুই শেখেনি।

নারীবিদ্বেষী পুরুষের তো অভাব নেই সৌদি আরবে। দুঃখ এই, নারীবিদ্বেষী নারীদেরও অভাব নেই। মগজ ধোলাইয়ের ফল চমৎকার বটে। ২০০৬ সালের এক জরিপে দেখা গেছে শতকরা ৮৯ ভাগ মেয়ে চায় না মেয়েরা গাড়ি চালাক আর ৮৬ ভাগ মেয়ে মনে করে না পুরুষের সঙ্গে পাশাপাশি বসে তাদের কাজ করা উচিত। ৯০ ভাগ সৌদি মেয়ে চায় না অভিভাবক আইনটা চলে যাক। মেয়েরা যখন নিজের সম্মান বিক্রি করে দিতে আপত্তি করে না, আমি স্তব্ধ হয়ে বসে থাকি।

নারীর সমানাধিকার চাইলেই লোকে বলে নারীতান্ত্রিক সমাজ চাইছি। তারা ভয় পেয়ে যায়, মনে করে পুরুষতান্ত্রিক সমাজ ভেঙে পড়লেই বুঝি নারীতান্ত্রিক সমাজ গড়ে উঠবে, আর তখনই পুরুষ যেমন করে নির্যাতন করেছে নারীকে, নারীও তেমন করে নির্যাতন করবে পুরুষকে। আমি অবাক হই, কেন মানবতান্ত্রিক সমাজের কথা পুরুষেরা ভাবতেও পারে না! সমতা, সমানাধিকার, সহমর্মিতার ভিত্তিতে সমাজ গড়ে তোলার পক্ষপাতি নয় বেশির ভাগ পুরুষই। একই মানবজাতি, অথচ অর্ধেককে পেশির জোরে পিষতে থাকে বাকি অর্ধেক। একই মানবজাতি, অথচ অর্ধেকের বিরুদ্ধে প্রতারণা করে গিয়েছে বাকি অর্ধেক। পুরুষদের কীর্তিকলাপ দেখে সত্যি লজ্জা হয়।

লেখক : নির্বাসিত লেখিকা।