সৌদি-মার্কিন সম্পর্কে টানাপড়েনের আভাস

জাতিসংঘের নভেম্বরের পরিসংখ্যান অনুযায়ী, গত তিন বছরে ইয়েমেনে সৌদি জোটের বিমান হামলায় ৫ হাজারেরও বেশি বেসামরিক নিহত হয়েছে। একই মাসের তৃতীয় সপ্তাহে মার্কিন সংবাদমাধ্যম নিউ ইয়র্ক পোস্ট এক প্রতিবেদনে জানিয়েছিল, ইয়েমেন যুদ্ধে বেসামরিক নিধনযজ্ঞে ব্যবহৃত অস্ত্রের একটা বড় অংশ যুক্তরাষ্ট্র থেকে আসা। ইয়েমেন যুদ্ধের তিন বছরে ওবামা ও ট্রাম্প প্রশাসনের সরবরাহকৃত চার হাজার কোটি ডলারেরও বেশি মূল্যের মার্কিন অস্ত্র ব্যবহৃত হয়েছে। ব্রিটিশ বার্তা সংস্থা রয়টার্স বলছে, সেই মারণাস্ত্র সরবরাহকারী ট্রাম্প নাকি এবার ইয়েমেনে সৌদি জোটের সাম্প্রতিক অবরোধে নেতিবাচক প্রতিক্রিয়া জানিয়েছে। জেরুজালেমকে ইসরায়েলি রাজধানীর স্বীকৃতি দিয়ে ট্রাম্প ‘অন্যায্য ও কাণ্ডজ্ঞানহীন’ কাজ করেছেন; সৌদি আরবের এই প্রতিক্রিয়ার দিনেই রিয়াদের ইয়েমেন অবরোধে মার্কিন প্রেসিডেন্টের ধৈর্য হারানোর খবর দিয়েছে আন্তর্জাতিক সংবাদমাধ্যম। মার্কিন সংবাদমাধ্যম ব্লুমবার্গ একে সৌদি আরবের বিরুদ্ধে ট্রাম্পের বিরল সমালোচনা আখ্যা দিয়েছে। এ ঘটনায় দুই দেশের সম্পর্কসূত্রে একটি প্রশ্নচিহ্ন খুঁজে পেয়েছে রয়টার্স।

যুক্তরাষ্ট্র ও সৌদি আরবের পতাকা
সৌদি নেতৃত্বাধীন জোট ইয়েমেনে ইরান সমর্থিত হুথি বিদ্রোহীদের বিরুদ্ধে অভিযান পরিচালনা করছে। তিন বছর ধরে চলা এ যুদ্ধের কারণে ইয়েমেনে যে পরিস্থিতি তৈরি হয়েছে তাকে বিশ্বের সবচেয়ে বড় মানবিক সংকট আখ্যা দিয়েছে জাতিসংঘ। অথচ এ যুদ্ধেই এতোদিন সৌদি জোটকে বিমান হামলা পরিচালনা, গোয়েন্দা সহায়তাসহ বিভিন্ন ধরনের সহযোগিতা দিয়ে আসছে যুক্তরাষ্ট্র। ইয়েমেনের কথিত জঙ্গি আস্তানাগুলো লক্ষ্য করে ড্রোন হামলাও চালিয়ে যাচ্ছে দেশটি। কিন্তু সম্প্রতি জেরুজালেমকে ইসরায়েলের রাজধানী হিসেবে যুক্তরাষ্ট্রের স্বীকৃতি প্রশ্নে সৌদি সরকার ও ট্রাম্পের মধ্যে টানাপড়েনের আভাস মিলেছে।

জাতিসংঘ, ইউরোপীয় ইউনিয়ন, আরব লীগ, সৌদি আরব, জর্ডানসহ বিভিন্ন দেশ ও সংস্থার আহ্বান উপেক্ষা করে বুধবার (৬ ডিসেম্বর) জেরুজালেমকে ইসরায়েলের রাজধানী হিসেবে স্বীকৃতির ঘোষণা দেন ট্রাম্প। হোয়াইট হাউসে কূটনীতিকদের অভ্যর্থনা কক্ষে এক ঘোষণায় ট্রাম্প বলেন, ‘আমি মনে করছি, জেরুজালেমকে ইসরায়েলের রাজধানী হিসেবে আনুষ্ঠানিক স্বীকৃতির এটাই সময়।’ বৃহস্পতিবার (৭ ডিসেম্বর) বিবিসির প্রতিবেদনে বলা হয়, সৌদি আরবসহ অন্যান্য আরব দেশগুলো মার্কিন প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্পের সিদ্ধান্তের নিন্দা জানিয়েছে। এক বিবৃতিতে সৌদি আরব জানায়, ‘রাজপরিবার মার্কিন প্রেসিডেন্টের সিদ্ধান্তে মর্মাহত। ইতোমধ্যে এমন অন্যায্য ও কাণ্ডজ্ঞানহীন আচরণের পরিণাম সম্পর্কে সতর্ক করেছি আমরা।’

জেরুজালেমের স্বীকৃতি প্রশ্নে মধ্যপ্রাচ্যজুড়ে অস্থিরতার মধ্যেই অবরুদ্ধ ইয়েমেনে জরুরি ভিত্তিতে মানবিক সহায়তা পৌঁছানোর সুযোগ দিতে সৌদি আরবের প্রতি আহ্বান জানান মার্কিন প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প। সৌদি নেতৃত্বাধীন জোটের এ অবরোধের ব্যাপারে ওয়াশিংটন ধৈর্য হারিয়ে ফেলেছে বলেও উল্লেখ করেন তিনি।

ট্রাম্প ও সৌদি বাদশাহ সালমান
ইয়েমেনে হুথি বিদ্রোহীদের বিরুদ্ধে প্রায় তিন বছর ধরে অভিযান চলমান থাকার মধ্যেই এক মাস আগে দেশটির বন্দরগুলোতে অবরোধ আরোপ করে সৌদি নেতৃত্বাধীন জোট। ইয়েমেন থেকে রিয়াদে ক্ষেপণাস্ত্র হামলার প্রচেষ্টার অভিযোগে ওই অবরোধ আরোপ করা হয়। অবশ্য, পরে ওই অবরোধ শিথিল করা হলেও এবং বুধবার তা ভেঙে যাওয়ার আভাস মিললেও ইয়েমেনের জনগণ এখনও অনেক শোচনীয় পরিস্থিতিতে আছে। দেশটির প্রায় ৮০ লাখ মানুষ দুর্ভিক্ষের দ্বারপ্রান্তে অবস্থান করছে। কলেরা ও ডিপথেরিয়া ছড়িয়ে পড়েছে। দ্য নরওয়েজিয়ান রিফিউজি কাউন্সিল (এনআরসি) বলছে, হুদাইদাহ ও সালিফ বন্দরে প্রথম দফায় খাদ্য ও জ্বালানি পৌঁছালেও যে পরিমাণ সহায়তা দরকার সেই তুলনায় তা খুবই সামান্য। কারণ, ২ কোটি ৭০ লাখ জনসংখ্যার দেশ ইয়েমেন প্রায় সম্পূর্ণভাবে খাদ্য, জ্বালানি ও ওষুধের ওপর নির্ভরশীল।

এই পরিস্থিতিতে ৬ ডিসেম্বর দেওয়া বিবৃতিতে ট্রাম্প লিখেছেন, ‘আমি আমার প্রশাসনের কর্মকর্তাদের নির্দেশ দিয়েছি তারা যেন ইয়েমেনের অসহায় মানুষদের কাছে খাদ্য, জ্বালানি, পানি এ ওষুধ পৌঁছানোর সুযোগ দেওয়ার জন্য সৌদি নেতৃত্বকে অনুরোধ করেন। মানবিক কারণে জরুরি ভিত্তিতে এটা করা উচিত।’ ট্রাম্পের এ বিবৃতিকে স্বাগত জানিয়েছে আন্তর্জাতিক দাতব্য সংস্থা অক্সফাম। ট্রাম্পের বিবৃতিটি দিতে অনেক দেরি হলেও তা খুব জরুরি’ বলে উল্লেখ করেছে সংস্থাটি।

রয়টার্সের প্রতিবেদনে বলা হয়, পরস্পর বন্ধু রাষ্ট্র হলেও ট্রাম্পের এক অনুচ্ছেদে লেখা ওই বিবৃতি সৌদি আরবের পররাষ্ট্রনীতি নিয়ে যুক্তরাষ্ট্রের উদ্বেগের স্পষ্ট চিহ্ণ বহন করছে। ইয়েমেন যুদ্ধে সৌদি জোটকে মার্কিন সহায়তার প্রসঙ্গ টেনে ব্লুমবার্গ বলছে, সৌদি আরবের বিরুদ্ধে ট্রাম্পের এ সমালোচনা বিরল ঘটনা। দাতব্য সংস্থা অক্সফাম আমেরিকার মানবিক সহায়তা বিষয়ক নীতি পর্যালোচনাকারী স্কট পল মনে করেন, সৌদি আরবকে অবরোধ তুলে নেওয়ার জন্য ট্রাম্পের এ আহ্বান দীর্ঘ বিলম্বিত; তবে তা অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। বুধবার (৬ ডিসেম্বর) এক বিবৃতিতে তিনি বলেন, ‘যুক্তরাষ্ট্রের সমর্থনই ইয়েমেনে এমন ভয়াবহ সংকট তৈরি করতে সহায়তা করেছে এ সত্যটুকু আমরা এড়িয়ে যেতে পারি না।’