স্কুলে পরীক্ষা পেছাতে সহপাঠীকে খুন করল কিশোর

দিল্লি লাগোয়া গুরগাঁওয়ের এক স্কুল ছাত্রকে খুন করার অভিযোগে ওই স্কুলেরই এক উঁচু ক্লাসের ছাত্রকে গ্রেপ্তার করেছে ভারতের কেন্দ্রীয় তদন্ত ব্যুরো বা সিবিআই।

সাত বছর বয়সী প্রদ্যুম্ন ঠাকুর স্কুলের বাথরুমেই খুন হয় সেপ্টেম্বর মাসে।

সিবিআই জানতে পেরেছে যে পরীক্ষায় যাতে বসতে না হয় সেজন্যই বড়সড় গোলমাল পাকিয়ে স্কুল বন্ধ করে দেওয়ার জন্যই কাউকে একটা খুন করার পরিকল্পনা করেছিল গ্রেপ্তার হওয়া একাদশ শ্রেণির ছাত্রটি।

ঘটনাচক্রে মৃত শিশুটি সেই সময়ে বাথরুমে গিয়েছিল। প্রথমে অবশ্য ওই খুনের অভিযোগে স্কুলবাসের এক কন্ডাক্টরকে গ্রেপ্তার করেছিল পুলিশ।

সিবিআই জানিয়েছে যে তারা গুরগাঁওয়ের রায়ান ইন্টারন্যাশানাল স্কুলের দ্বিতীয় শ্রেণির ছাত্র প্রদ্যুম্ন ঠাকুরের হত্যা মামলায় ওই স্কুলেরই এক সিনিয়র ছাত্রকে গ্রেপ্তার করেছে।

ওই ছাত্রটির বয়স ১৬, তাই তাকে শিশু-কিশোর বিচার বোর্ডে হাজির করা হয়েছে।

বিচার বোর্ডে ছাত্রটিকে গ্রেপ্তার করার কারণ হিসাবে সিবিআই যে নোট জমা দিয়েছে, তাকে উদ্ধৃত করে সংবাদ সংস্থা পিটিআই জানিয়েছে পরীক্ষা আর অভিভাবক-শিক্ষক বৈঠক বানচাল করার উদ্দেশ্য ছিল ধৃত ছাত্রের।

পড়াশোনায় পিছিয়ে থাকা ছাত্রটি ভেবেছিল যদি স্কুলের কেউ খুন হয়, তাহলে নিশ্চয়ই একটা বড় ধরনের গোলমাল পাকাবে আর স্কুল ছুটি হয়ে যাবে। প্রদ্যুম্নকেই যে খুন করবে, এমন কোনো নির্দিষ্ট পরিকল্পনা তার ছিল না।

ধৃত ছাত্রের স্কুলের একতলার বাথরুমে ঘটনাচক্রে গিয়েছিল প্রদ্যুম্ন।

খুন করার জন্য আগে থেকেই একটা ছুরি কিনেছিল সে।
সিবিআই জানিয়েছে নিজের বাবার সামনেই ওই ছাত্র স্বীকার করেছে খুনের ঘটনা। তবে ধৃত ছাত্রটির বাবা সংবাদমাধ্যমকে জানিয়েছেন যে তাঁকে চাপ দিয়ে ছেলের দেওয়া বয়ানে সই করানো হয়েছে।

ধৃত ছাত্রটির পরিচয় গোপন রাখার কারণে তার বাবার পরিচয়ও সংবাদমাধ্যমে গোপন রাখা হচ্ছে।

তবে ধৃত ছাত্রটির বাবা বলছিলেন যে তাঁর ছেলে কখনোই খুন করেনি। তাকে ফাঁসানো হচ্ছে।

তার কথায়, “ছাত্রটির মৃতদেহ দেখে আমার ছেলেই প্রথমে মালি, তারপরে শিক্ষকদের খবর দেয় – সারাদিন স্কুলেই ছিল – পরীক্ষাও দিয়েছে। তার জামায় কোনো রক্তের দাগ ছিল না.. প্রথম থেকে তদন্তে সহযোগিতা করেছে সে। ”

“এর আগে তিনবার সিবিআই দপ্তরে জেরা করা হয়েছে, বাড়িতেও এসেছিল সিবিআই, স্কুলে জেরা করা হয়েছে। মঙ্গলবারও জেরা করতে ডেকেছিল। সারাদিন বসিয়ে রাখার পরে রাত ১২টার সময় সিবিআই বলে যে আমার ছেলেই খুনি – তাকে গ্রেপ্তার করা হচ্ছে। ”

ছেলের দেওয়া বয়ানে যতক্ষণ না সই করছেন তারা বাবা, তাকে সিবিআই দপ্তর থেকে বের হতেও দেওয়া হয়নি বলে ওই ব্যক্তি দাবি করেছেন।

ঘটনার পরেই গুরগাঁও পুলিশ প্রদ্যুম্ন হত্যার অভিযোগে অশোক কুমার নামে স্কুলবাসের এক কন্ডাক্টরকে গ্রেপ্তার করেছিল।

অভিযোগ করা হয়েছিল শিশুটিকে যৌন নির্যাতনের পরে গলা কেটে খুন করেছেন তিনি। সংবাদমাধ্যমের সামনেও তাঁকে দিয়ে সেই খুনের কথা স্বীকার করানো হয়েছিল।

তবে পরে মি কুমার নিজে এবং তার পরিবার বার বারই দাবি করে এসেছে তিনি নির্দোষ। অভিভাবকদের ব্যাপক বিক্ষোভের পরে তদন্তভার পুলিশের বদলে দেওয়া হয় সিবিআইকে।

তারা দুই মাস ধরে প্রায় দেড় শ ছাত্র-ছাত্রী-শিক্ষক, কর্মচারীকে জেরা করেছে – ছাত্রছাত্রীদের রক্তের নমুনা পরীক্ষা করেছে – সিসিটিভি ফুটেজ খতিয়ে দেখেছে।

খুন হওয়া ছাত্রটির পরিবারও প্রথম থেকেই বলছিল যে কোনো ঘটনা ধামা চাপা দেওয়া হচ্ছে বলে তাঁদের সন্দেহ ছিলই।
স্কুলেরই ক্লাস ইলেভেনের ছাত্রটি গ্রেপ্তার হওয়ার পরে প্রদ্যুম্ন ঠাকুরের পরিবারের আইনজীবী সুশীল টেকরিওয়াল এক সংবাদ সম্মেলনে বলেন, “প্রচুর তথ্য প্রমাণ যোগাড় করার পরেই রায়ান ইন্টারন্যাশনাল স্কুলের একাদশ শ্রেণির এই ছাত্রটিকে গ্রেপ্তার করেছে সিবিআই। ”

“আদালতের কাছে আবেদন করা হবে যাতে ছেলেটিকে শিশু-কিশোর হিসাবে নয় – প্রাপ্তবয়স্ক অপরাধীর মতোই সাধারণ আদালতে বিচার করা হয় আর যাতে তার মৃত্যুদণ্ড হয়- সেই দাবিও করা হবে আদালতে। ”

“একই সঙ্গে এটাও দেখা দরকার যে স্কুলের তরফে কারা, কেন প্রমাণ লোপাটের চেষ্টা করেছিল – সত্য ঘটনা ধামাচাপা দেওয়ার চেষ্টা করেছিল”, বলছিলেন মৃত শিশুটির পরিবারের আইনজীবী সুশীল টেকরিওয়াল।

কলকাতার মনোরোগ বিশেষজ্ঞ অনুত্তমা ব্যানার্জীর কাছে জানতে চেয়েছিলাম ১৬ বছর বয়সের এক কিশোর কেন শুধু পরীক্ষা বানচাল করার জন্য খুন করতেও দ্বিধা করল না?

তিনি জবাব দেন, “প্রথমেই যে প্রশ্নটা জাগে, পরীক্ষায় অনুত্তীর্ণ হলে কত বড় ক্ষতি হতে পারত বলে সে মনে করল যে খুন করতেও দ্বিধা করল না?”

“এই ঘটনাটা এটাও দেখিয়ে দেয় বাচ্চারা স্কুল, পরীক্ষা- এসব সম্বন্ধে কী ধারণা নিয়ে বড় হচ্ছে, যেখানে একটা মানুষের জীবন নিয়ে নেওয়ার থেকেও নিজের পরীক্ষায় পাস করাটা বড় হয়ে দাঁড়াচ্ছে,” বলছিলেন ড. ব্যানার্জী।

তিনি আরো বলছিলেন, “শুধু যে ছেলেটিকে ধরা হয়েছে তার মানসিকতা বিচার করলে চলবে না। আমাদের গোটা সমাজ তো বটেই, বিশেষ করে তার অভিভাবকদের মানসিকতাও দেখা দরকার। এই বয়সের একটা বাচ্চা ছেলে পরীক্ষায় খারাপ ফল করলে কার কাছ থেকে বেশি ভয় পায়, সেটা বলার অপেক্ষা রাখে না। ”

“তার বাবা মা, শিক্ষক – এঁরা কি ছেলেটির কোনো আচরণ টের পাননি? একজন মনোরোগ বিশেষজ্ঞ হিসাবে বলতে পারি, এতবড় ঘটনার আগে নিশ্চয়ই তার ব্যবহারে, আচারে কিছু না কিছু অস্বাভাবিকতা ছিলই- ঠিকমতো খেয়াল করেনি কেউ। ”

ধৃত ছাত্রটিকে তিনদিনের সিবিআই হেফাজতে পাঠিয়েছে শিশু-কিশোর বিচার বোর্ড।

– বিবিসি বাংলা