স্কুল ও বাড়িতে অতিরিক্ত চাপ, ভারতে ঘণ্টায় একজন শিক্ষার্থীর আত্মহত্যা

ভারতের রাজধানী দিল্লিতে নবম শ্রেণির একছাত্রী পরীক্ষায় পাস না করতে পারায় আত্মহত্যা করেছে বলে তার বাবা-মা অভিযোগ করেছেন।

দুই শিক্ষক ইচ্ছে করে তাদের বিষয়গুলোতে ফেল করাচ্ছেন বলে ছাত্রীটি নিজেই আশঙ্কা প্রকাশ করেছিল বাবা-মায়ের কাছে। মঙ্গলবার সন্ধ্যায় বাড়ি ফেরার পর ওই ছাত্রীর বাবা-মা প্রথমে দরজা বন্ধ দেখতে পান। দরজা ভেঙে ভেতরে ঢুকে আবিষ্কার করেন মেয়ে গলায় দড়ি দিয়ে ঝুলছে।-খবর বিবিসি অনলাইনের।

স্কুল অবশ্য বলছে, ওই ছাত্রীটির পুনরায় পরীক্ষা নেওয়ার কথা ছিল। কিন্তু হাসপাতালে নেয়া হলেও তাকে বাঁচানো যায়নি। শুধু এই ছাত্রীটি নয়- ভারতে প্রতি ৫৫ মিনিটে একজন ছাত্র বা ছাত্রী আত্মহত্যার পথ বেছে নিচ্ছে।

তথ্য বলছে- তাদের একটি বড় অংশই পরীক্ষায় কম নম্বর পাওয়া, উচ্চশিক্ষার জন্য ভালো কলেজ-বিশ্ববিদ্যালয়ে সুযোগ না পাওয়া বা জীবনে প্রতিষ্ঠিত হওয়া-এ রকম নানাবিধ চাপের মধ্যে বড় হচ্ছে।

আর এগুলোর কোনো একটা পর্যায়ে ব্যর্থ হলেই নিজের জীবন শেষ করে দেয়ার সিদ্ধান্ত নিয়ে ফেলছে। স্কুল আর বাড়ি- চাপ আসে দুই জায়গা থেকেই।

কলকাতার একটি নামি স্কুলের সপ্তম শ্রেণিতে পড়ে রঞ্জিতা নন্দীর ছেলে। রঞ্জিতা বলেন, তিনি না চাইলেও স্কুল আর সামাজিক চাপের কাছে অনেক সময়েই মাথা নত করতে হয় অভিভাবকদের।

তিনি বলেন, আমার ছেলে যে স্কুলে পড়ে, সেখানে প্রত্যেকটা শিক্ষার্থীকে নম্বর নিয়ে ভীষণ চাপ দেয়, সামান্য খারাপ করলেই বাবা মাকে ডেকেও কথা শোনানো হয়। আর বাড়ি ফিরে আমরা বাবা-মায়েরা সেই চাপটাই আবার বাচ্চাদের ওপরে চাপিয়ে দিই- আরও পড়, আরও পড় বলতে থাকি।

তার মতে, এই চাপ নেয়ার জন্য হয়তো বাচ্চাটি তৈরিই হয়নি, অথচ ইচ্ছা না থাকলেও করতে হয়। কারণ যে সমাজে বাস করি- গোটাটাই কম্পিটিশনের ওপরে চলে।

তার কথায়, আমাদের ছোটবেলায় পড়াশোনা নিয়ে বাবা-মায়েরা কিন্তু এতটা চাপ দিতেন না। আমরা সেটি দিই অনেক সময়ে বাধ্য হয়েই।

অন্য আরেকটি স্কুলের ক্লাস নাইনে পড়ে ইন্দ্রানী ঘোষের মেয়ে। তিনি বলেন, এখন সমাজটাই এমন পর্যায়ে পৌঁছে গেছে যে ভালো চাকরি, ভালো বেতন- এগুলোই বাচ্চাদের বা তাদের বাবা-মায়েদের লক্ষ্য হয়ে উঠছে। তাই ওই লক্ষ্যে পৌঁছানোর জন্য বাচ্চারা সবসময়েই একটি চাপের মধ্যে থাকে। আবার বাবা-মায়েরাও নিজেদের অসম্পূর্ণ স্বপ্নগুলো সন্তানদের মধ্য দিয়ে পূরণ করতে চাই। যেটি আমরা করতে পারিনি, সেটি যেন ওরা করে দেখায়। সব মিলিয়ে বাচ্চাগুলোর জন্য একটি ভয়ঙ্কর অবস্থা তৈরি করা হচ্ছে।

কলকাতার একটি ইংরেজি মাধ্যম স্কুলের শিক্ষিকা দীপান্বিতা মজুমদারের অনেক সময়েই খেয়াল করেছেন যে বাচ্চাদের পড়াশোনা অথবা বড় হয়ে ওঠার প্রতি বাবা-মায়েদের নজরদারির অভাব এবং কোনো ক্ষেত্রে স্পষ্ট অবহেলাও থাকে।

তিনি বলেন, অভিভাবকদের সঙ্গে আমাদের বৈঠকগুলোতে দেখি অনেক সময়ে বাবারা প্রায় আসেনই না। অনেক বাবা-মা তো আবার এটিও খেয়াল রাখেন না যে, মেয়ের পরীক্ষা চলছে বা নম্বর বের হচ্ছে।

তার মতে, কিন্তু পরীক্ষায় খারাপ করলে যখন আমরা বাবা-মাকে ডেকে কথাগুলো বলি, তখন তারা বাড়ি ফিরে বাচ্চাদের ওপরে বকাবকি করেন। একটি কথা অনেক বাবা-মাকেই বলতে শুনি যে, এত খরচ করার পরও কেন এ রকম খারাপ ফল হল! এই কথাটি একটু বড় বাচ্চারা একদম নিতে পারে না।

তিনি আরও বলেন, ওদের মনে একটি জিনিস কাজ করে, যখন আমার প্রয়োজন ছিল বাবা-মায়ের সাহায্যের, তখন তারা কিছু বলেননি, কিন্তু ফল খারাপ হতেই খরচের প্রসঙ্গ তোলা হচ্ছে। স্কুলের যেমন দায়িত্ব আছে, তেমনই বাবা-মায়েদেরও নজর রাখা উচিত বাচ্চাদের বড় হয়ে ওঠার ওপরে।

কলকাতার একজন শিশু মন বিশেষজ্ঞ সময়িতা ব্যানার্জি, যিনি গ্রাফোলজি অর্থাৎ হাতের লেখার সাহায্যে শিশু মনের চিকিৎসা করেন।

তার কাছে জানতে চাওয়া হয়েছিল পড়াশোনার চাপ সহ্য করতে না পেরে আত্মহননের পথ কেন বেছে নিচ্ছে ভারতের হাজার হাজার শিশু?

সময়িতার কথায়, যে শিশু তার বাড়ির পরিবেশ নিয়ে খুশি, বন্ধুদের সঙ্গে সময় কাটায় আনন্দে, মোটের ওপরে যার একটা সুইট হোম আছে, তার যদি কখনও পরীক্ষায় খারাপ ফল হয়, সেটি সে সহ্য করে নিতে পারে। কিন্তু যেসব বাড়ির বা স্কুলের পরিবেশটাতেই গণ্ডগোল বা যারা ইলেকট্রনিক মিডিয়া-টিভি ইত্যাদি বেশি দেখে, এ রকম বাচ্চাদের স্নায়ুতন্ত্রের বিকাশে কিছুটা সমস্যা তৈরি হয়।

তিনি বলেন, এদের যখন ছোটখাটো ব্যর্থতা মোকাবেলা করতে হয়, তখন তাদের কাছে সেটি খু্ব কঠিন হয়ে যায়। আর সমস্যাটা যদি বড়সড় কিছু হয়, তা হলে সে আর মোকাবেলা করতেই পারে না। তখন চরম সিদ্ধান্ত নিয়ে ফেলে।

সরকারি তথ্যানুযায়ী, ২০১৪ থেকে ২০১৬- এই তিন বছরে ২৬ হাজার পড়ুয়া আত্মহত্যা করেছে ভারতে। ২০১৬ সালে ১৩০০ ছাত্রছাত্রী মহারাষ্ট্রে আর পশ্চিমবঙ্গে ১১০০ ছাত্রছাত্রী নিজেদের জীবন শেষ করে দিয়েছে।

পরীক্ষায় ফেল করা ছাড়া পড়াশোনায় খারাপ করা, অপছন্দের কোনো বিষয় পড়তে বাধ্য করা- এমনকি পড়াশোনায় খারাপ ফল হতে পারে। এই ভয় থেকেও অনেক ছাত্রছাত্রীই আত্মহত্যা করছে।

শিশুমন বিশেষজ্ঞ সময়িতা ব্যানার্জি বলেন, তাদের এটি বোঝানোর মতো কেউ নেই যে একবার পরীক্ষায় খারাপ ফল করা মানেই জীবনের শেষ নয়।