হঠাৎ ‘অস্থির’ বাংলাদেশের ক্রিকেট

শ্রীলঙ্কার বিপক্ষে টি-টোয়েন্টি সিরিজে হঠাৎ করেই নতুন মুখের সমারোহ বাংলাদেশ দলে। জাকির হাসান, আফিফ হোসেন, আরিফুল হক, নাজমুল হাসান, আবু জায়েদ ও মাহাদি হাসান। একটা সিরিজে ছয় নতুন মুখ! প্রধান নির্বাচকেরা যত এটিতে ‘টেস্টের ক্লান্তি ঘোচানো’র অজুহাত দিন না কেন, ব্যাপারটা কেউই সহজভাবে মেনে নিতে পারছেন না।

সন্দেহ নেই, জাতীয় ক্রিকেট দলে যাঁদের নেওয়া হয়েছিল, তাঁরা প্রায় সবাই হালের পারফরমার। ঘরোয়া ক্রিকেটে পারফরম্যান্স দিয়েই এঁরা সবাই নজর কেড়েছেন। কিন্তু প্রশ্নটা হচ্ছে, বাংলাদেশ দলে হঠাৎ কী এমন বিপর্যয় দেখা দিয়েছিল যে একসঙ্গে ছয় তরুণের অভিষেক ঘটাতে হবে! পুকুরের মাছকে নদীতে নিয়ে ফেললে যা হয়, লঙ্কানদের বিপক্ষে দুটি টি-টোয়েন্টি ম্যাচে এই তরুণদের পারফরম্যান্সে সেই ব্যাপারটিই ফুটে উঠল প্রবলভাবেই।

নির্বাচকদের এই অস্থিরতা হঠাৎ করেই মনে করিয়ে দিচ্ছে টেস্ট মর্যাদা পাওয়ার শুরুর দিনগুলোর কথা। দলে ‘নতুন রক্ত’ সঞ্চালনের এক অদম্য নেশা পেয়ে বসেছিল সে সময়ের নির্বাচকদের। দলে কোন খেলোয়াড় ঢুকছেন আর কে বেরিয়ে যাচ্ছেন—এই হিসাব রাখতেই হিমশিম খেতেন ক্রিকেটপ্রেমীরা। প্রতি ম্যাচেই নতুন নতুন ক্রিকেটারের অভিষেক ঘটত। যাঁদের অভিষেক হতো, আন্তর্জাতিক ক্রিকেটের কঠিন মঞ্চে নিজেদের মেলে ধরতে ব্যর্থ হলেই তাঁদের দেখিয়ে দেওয়া হতো বেরিয়ে যাওয়ার রাস্তা। টেস্ট যুগের প্রাথমিক দিনগুলোয় এমন অনেক ক্রিকেটারেরই জাতীয় দলের জার্সিতে খেলার অভিজ্ঞতা হয়েছিল, যাঁরা পরবর্তী সময়ে হারিয়ে গেছেন। আজ টেস্ট মর্যাদা পাওয়ার ১৮ বছরের মাথায় এসে সেই একই চিত্র বাংলাদেশ দলে। এক ত্রিদেশীয় সিরিজ, শ্রীলঙ্কার বিপক্ষে টেস্ট সিরিজ আর টি-টোয়েন্টি সিরিজে বাংলাদেশ দলে কতজন খেলোয়াড়কে নেওয়া হলো আর বাদ দেওয়া হলো সেই হিসাব হাতে রাখতে গেলে নিশ্চিত করেই হোঁচট খাবেন ক্রিকেটপ্রেমীরা। প্রশ্ন হচ্ছে, জাতীয় দলের জায়গাগুলো হঠাৎ করেই ‘মিউজিক্যাল চেয়ার’ হয়ে ওঠার কারণটা কী!

২০১৫ বিশ্বকাপের আগে-পরে সৌম্য সরকার, সাব্বির রহমান, তাসকিন আহমেদ ও মোস্তাফিজুর রহমানদের আবির্ভাব বদলে দিয়েছিল বাংলাদেশ দলের চেহারা। মাশরাফি বিন মুর্তজা, সাকিব আল হাসান, মুশফিকুর রহিম, তামিম ইকবাল ও মাহমুদউল্লাহর মতো অভিজ্ঞদের কেন্দ্র করে সৌম্য-সাব্বিরদের মতো ক্রিকেটাররা আশার সঞ্চার করেছিলেন বাংলাদেশের ক্রিকেটে। জাতীয় ক্রিকেট দলের ‘পাইপলাইনে’ যথেষ্ট ভালো খেলোয়াড় আছেন—এমন ধারণাও তৃপ্তি ছড়িয়ে যাচ্ছিল। কিন্তু সৌম্য-সাব্বির-তাসকিন-মোস্তাফিজরা যখন ‘মধুচন্দ্রিমা সময়’ পেরিয়ে ধীরে ধীরে ফিকে হতে শুরু করেছেন, তখনই সমস্যাটা সামনে চলে এল। এঁদের পরে কে?

এঁদের পরে যাঁরা আছেন, তাঁদের সবাইকেই শ্রীলঙ্কার বিপক্ষে ওয়ানডে সিরিজে পরখ করে জাতীয় দলে নিয়ে এলেন নির্বাচকেরা। এঁরা জাতীয় দলের জার্সি গায়ে দিলেন একেবারেই অপ্রস্তুত অবস্থায়। ঘরোয়া আর বয়সভিত্তিক ক্রিকেটে কয়েকটি পারফরম্যান্সই এই নতুনদের সম্বল। কিন্তু এত কম সম্বল নিয়ে জাতীয় দলে ঢুকে গেলে কী হয়, অতীতে তার উদাহরণ তো ভূরি ভূরিই আছে বাংলাদেশের ক্রিকেটে। এই যে প্রথম টি-টোয়েন্টিতে চারজন ক্রিকেটারের অভিষেক হলো; দ্বিতীয় ম্যাচেই আবার বাদ দিয়ে দেওয়া হলো দুজনকে, এতে কার লাভ হলো, সেটা ঠিক বোঝা যাচ্ছে না। নতুন একজনকে দলে নেওয়ার পর তাঁকে থিতু হতে না দিয়ে বাদ দিয়ে দেওয়া কোনোভাবেই শুভ ফল বয়ে নিয়ে আসতে পারে না। নির্বাচকেরা এটা কেন বুঝতে পারছেন না, সেটা বোঝা যাচ্ছে না।

যে চারজন নতুন ক্রিকেটারের অভিষেক হলো সম্প্রতি, তাদের মধ্যে আফিফ হোসেনের নামটি বিশেষ করেই নিতে হয়। খুব বেশি দিন নয় তাঁর আবির্ভাব। ১৮ বছর বয়সী এই অলরাউন্ডার এবারের অনূর্ধ্ব-১৯ বিশ্বকাপে দুর্দান্ত পারফরম করেছেন। ব্যাটে-বলে তাঁর অসাধারণ পারফরম্যান্স, তাঁকে ‘ভবিষ্যতের সাকিব’ তকমাও এনে দিয়েছে। আফিফ যখন নিজেকে আরও শাণিত করে নিতে প্রস্তুত হচ্ছে, ঠিক তখনই তাঁকে টি-টোয়েন্টিতে জাতীয় দলে ডাকা হলো। অভিষেকও হয়ে গেল তাঁর। কিন্তু দ্বিতীয় ম্যাচেই সে বাদ। যে খেলোয়াড়টিকে আমরা ‘ভবিষ্যতের সাকিব’ বলছি, তাঁকে এক ম্যাচ খেলিয়েই বসিয়ে দেওয়া—নির্বাচকেরা কেন এত অস্থিরতায় ভুগবেন? নির্বাচকদের অস্থিরতার নমুনাটা একটা উদাহরণ দিয়েই স্পষ্ট করা যায়। গত এক মাসে বাংলাদেশের হয়ে খেলেছেন মোট ২৮ জন ক্রিকেটার। যদিও দেশের হয়ে এক বছরে ৩১ ক্রিকেটারের খেলার অতীত রেকর্ড আছে। কিন্তু একটা নির্দিষ্ট সিরিজেই ২৮ জনকে খেলিয়ে দেওয়াটা বেশ বাড়াবাড়িই হয়ে গেছে।

নির্বাচকদের এই অস্থিরতার মূল কারণ জাতীয় দলের বাইরে আমাদের যে ক্রিকেটাররা আছেন, তাঁরা কখনোই আন্তর্জাতিক ক্রিকেটের জন্য প্রস্তুত অবস্থায় থাকেন না। আমাদের ‘এ’ দল আছে, আছে হাই পারফরম্যান্স দল। অনূর্ধ্ব-১৯ দলেরও নিয়মিত অস্তিত্ব আছে। কিন্তু আন্তর্জাতিক ক্রিকেটের জন্য প্রস্তুত ক্রিকেটারের সংখ্যা এই দলে কয়জন আছে, সেটা একটা প্রশ্ন। আন্তর্জাতিক ক্রিকেটের জন্য ক্রিকেটারদের প্রস্তুত করে গড়ে তুলতে যে ‘এ’ দলটা খুব জরুরি, সেটির কার্যক্রমই তো মাঝখানে দীর্ঘদিন বন্ধ ছিল। হাই পারফরম্যান্স দলেরও কিছু শোনা যায়নি। এই তো কিছুদিন আগে হাই পারফরম্যান্স দল ইংল্যান্ড ও অস্ট্রেলিয়া সফর করেছে, ‘এ’ দল খেলেছে আয়ারল্যান্ডের বিপক্ষে—তারপরেও মাঝখানের সময়টা আমাদের ক্রিকেটে কিন্তু একটা শূন্যতা তৈরি করে দিয়েছে। যেটা সমস্যা তৈরি করছে এখন।

অতিমাত্রায় ফলনির্ভর কৌশল আমাদের ক্রিকেটের দীর্ঘমেয়াদি ক্ষতির কারণ হয়ে দাঁড়াচ্ছে। আমরা ঘরোয়া ক্রিকেটে মনোযোগী নই, আমাদের ফ্র্যাঞ্চাইজি, বিভাগীয় দল, ক্লাব কোনোটিই মনোযোগী নয় নতুন খেলোয়াড় সৃষ্টিতে। প্রথম শ্রেণির ক্রিকেটে সেই পুরোনো মুখগুলোই ঘুরিয়ে-ফিরিয়ে পারফরম করে। অনেক আশা নিয়ে বিপিএল আয়োজিত হলেও সেখানেও বিদেশি ক্রিকেটারদের দাপট। নতুন করে সাকিব-মুশফিক-তামিম-মাহমুদউল্লাহদের তৈরি করতে না পারলে এ দেশের ক্রিকেটের ভবিষ্যৎ যে বন্ধুর, সেটা এই সিরিজ চোখে আঙুল দিয়েই দেখিয়ে দিয়েছে।

দেশের ক্রিকেট-সংশ্লিষ্টরা পুরো বিষয়টিকে সতর্কবার্তা হিসেবেই নিন।