হাজার বছর ধরে আশুরা পালন করছেন এই হিন্দু ব্রাহ্মণরা

সাম্প্রদায়িকতা ভারতজুড়েই মাথা চাড়া দিচ্ছে। তার মধ্যেই সেখানে শুক্রবার পালিত হচ্ছে মহরম। সকাল থেকে দফায় দফায় শোক মিছিল বেরিয়েছে দেশটির বিভিন্ন প্রান্তে। তাতে সামিল হয়েছেন মুসলিম সম্প্রদায়ের মানুষ। কিন্তু ভারতেই এক শ্রেণির হিন্দু ব্রাহ্মণ রয়েছেন, যারা প্রতি বছর আশুরা পালন করেন।

আনন্দবাজার পত্রিকার প্রতিবেদনে বলা হয়, শুধু ভ্রাতৃত্ব ও সৌহার্দ্য বজায় রাখতেই বছরের পর বছর ধরে এই রীতি বজায় রেখে আসছেন তারা। আশুরা পালনকারী এই হিন্দু ব্রাহ্মণদের ‘মহিয়াল’ ব্রাহ্মণ বলা হয়। যদিও ‘হুসেইনি ব্রাহ্মণ’ বলে নিজেদের পরিচয় দিতে পছন্দ করেন তারা।

শুধু আশুরার মিছিলেই যোগ দেন না তারা। মহরমের মাসে বিয়েসহ সবরকম সামাজিক অনুষ্ঠানও বন্ধ রাখেন। এরা কোনো প্রত্যন্ত গ্রামেও থাকেন না। বরং এই রীতিতে বিশ্বাসীদের মধ্যে রয়েছেন বেশ কিছু বিখ্যাত ‘শহুরে’ মানুষ। হুসেইনি ব্রাহ্মণ হিসেবেই নিজেদের পরিচয় দেন তারা। এদের মধ্যে উল্লেখযোগ্য হলেন- প্রয়াত অভিনেতা ও প্রাক্তন সাংসদ সুনীল দত্ত, উর্দু সাহিত্যিক কাশ্মীরি লাল জাকির, সাবির দত্ত এবং নন্দকিশোর বিক্রম।

দেশভাগের আগে মূলত সিন্ধু ও লাহৌর প্রদেশেই হুসেইনি ব্রাহ্মণদের বাস ছিল। পরবর্তীকালে পুণে, দিল্লি, ইলাহাবাদ এবং রাজস্থানের পুষ্করে ছড়িয়ে পড়েন তারা। তবে তাদের উত্থান জানতে হলে প্রায় ১৩০০ বছর পিছিয়ে যেতে হয়। ৬৮০ খ্রিস্টাব্দে লাহৌর থেকে আরব দেশে পাড়ি দেন রাহিব দত্ত নামের এক ব্যক্তি। সেখানে ইমাম হুসেইনের সংস্পর্শে আসেন তিনি। হুসেইনের ব্যক্তিত্বে প্রভাবিত হয়ে তার অনুগামী হয়ে যান রাহিব। কারবালার যুদ্ধ শুরু হলে ইমাম হুসেইনের হয়ে ইয়াজিদদের বিরুদ্ধে লড়াইয়ে সামিল হন। নিজের সাত পুত্রকেও তাতে সামিল করেন।

যুদ্ধ শেষে জীবিত ফিরে আসেন রাহিব দত্ত। কিন্তু মৃত্যু হয় তার সাত পুত্রের। এমন আনুগত্য দেখে শিষ্যকে ‘সুলতান’ উপাধি দেন ইমাম হুসেইন এবং দেশে ফিরে যেতে বলেন। গুরুর কথা মতো ভারতে ফিরে আসেন রাহিব দত্ত। ইমাম হুসেইন ও কারবালার বৃত্তান্ত শোনান নিজের এলাকার মানুষদের। তাতে আকৃষ্ট হয়ে রাহিবের অনুগামী হয়ে পড়েন অনেকে। ইমাম হুসেইনের সঙ্গে রাহিব দত্তের ঘনিষ্ঠ সম্পর্কের কথা মাথায় রেখে হুসেইনি ব্রাহ্মণ বলে নিজেদের পরিচয় দিতে শুরু করেন তারা। তবে তাদের কেউই পুরোপুরি ইসলাম গ্রহণ করেননি।

কিন্তু, এ নিয়েও নানা মত রয়েছে। রাহিব দত্তের অস্তিত্বের কথা মেনে নিয়েছেন ইতিহাসবিদরা। তবে কারবালার যুদ্ধে তার ভূমিকা নিশ্চিত করা যায়নি। কেউ কেউ দাবি করেছেন, সেই সময় লাহৌরের রাজা ছিলেন কোনো এক চন্দ্রগুপ্ত। রাহিব দত্ত তার রাজসভায় কর্মরত ছিলেন। আবার অনেকের দাবি, চন্দ্রগুপ্তের আমলে দুই গুরুত্বপূর্ণ ব্রাহ্মণের হদিশ মিলেছে। তাদের মধ্যে একজন রাহিব দত্ত হতে পারেন। জামা কাপড়ের ব্যবসা করতে সেই সময় তার মতো অনেকেরই ইরাকে যাতায়াত ছিল। কারবালা যুদ্ধ শুরু হলে ইমাম হুসেইনের হয়ে যুদ্ধে অংশ নেন তারা।

তবে শুধু হুসেইনি ব্রাহ্মণরা নন, যুগ যুগ ধরে হিন্দুদের একাংশের মধ্যে মহরম পালনের রীতির উল্লেখ রয়েছে। লখনউয়ের বিভিন্ন ইমামবাড়ার নকশা এবং হুসেইন ইমামের আত্মবলিদান নিয়ে রচিত একাধিক কবিতায়ও তার উল্লেখ রয়েছে। যার মধ্যে গুরুত্বপূর্ণ, হিন্দু কবি চুন্নুলাল দিলজিরের লেখা কবিতা। হুসেইন ইমামকে নিয়ে প্রায় ৭০ হাজার পংক্তি লিখেছেন তিনি। তাতে হিন্দুদের মধ্যে আশুরা পালনের উল্লেখ রয়েছে।