১০ বছর বয়সী শিশুর শান্তিপূর্ণ প্রতিবাদের শাস্তি মৃত্যুদণ্ড?

আরবের দুর্নীতিপ্রবণ ও জনবিরোধী শাসকদের বিরুদ্ধে যখন বসন্তের ঢেউ খেলে গিয়েছিল, সে সময় সৌদি রাজতন্ত্রের বিরুদ্ধে সোচ্চার হয়েছিল ১০ বছর বয়সী এক শিশু। মুক্তিকামী ফিলিস্তিনি শিশুদের মতো গুলতি কিংবা ছুরিতে সশস্ত্র হয়েও নয়, অন্যান্য কয়েকজনের সঙ্গে নিরস্ত্র অবস্থায় সাইকেল নিয়ে অহিংস প্রতিবাদে নেমেছিল মুর্তাজা কুইরিরিস। মার্কিন সংবাদমাধ্যম সিএনএন সম্প্রতি তাদের এক বিশেষ অনুসন্ধানের মাধ্যমে জানতে সক্ষম হয়, সুদীর্ঘ নিপীড়ন ও নির্যাতনের মধ্য দিয়ে তার মিথ্যা স্বীকারোক্তি আদায় করা হয়েছে। সবশেষে শান্তিপূর্ণ সরকার বিরোধিতার শাস্তি হিসেবে ওই শিশুর মৃত্যুদণ্ডের সাজা ঘোষিত হয়েছে। যুক্তরাজ্যভিত্তিক মানবাধিকার সংস্থা অ্যামনেস্টি ইন্টারন্যাশনাল বলছে, তাকে ‘বিচারিক হত্যা’র বলি বানানোর অপেক্ষায় রয়েছে সৌদি কর্তৃপক্ষ। এই মৃত্যুদণ্ড ঠেকাতে তৎপর হয়েছে সংস্থাটি। সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম ভরে গেছে সৌদি কর্তৃপক্ষের বিরুদ্ধে নিন্দা আর প্রতিবাদে।

আরবের সর্বব্যাপী স্বৈরতান্ত্রিক ক্ষমতা, প্রবল জনবিরোধিতা আর ভয়াবহ দুর্নীতিগ্রস্ত রাজতন্ত্রের বিরুদ্ধে ২০১০ সালে শুরু হওয়া গণজাগরণকে পশ্চিমা সাংবাদিকরা নাম দিয়েছিলেন আরব বসন্ত (আরব স্প্রিং)। তিউনিসিয়ার এক শিক্ষিত মুদি দোকানি নিজের গায়ে আগুন ধরিয়ে যে সরকারবিরোধী আন্দোলনের সূত্রপাত করেছিলেন, সেই আগুনের উত্তাপ ছড়িয়ে পড়েছিল মিশর, সিরিয়া, ইয়েমেন, বাহরাইন, ইয়েমেন ও লিবিয়াসহ প্রায় সমগ্র আরব ভূখণ্ডে। এমনকী সৌদি আরবও বাদ যায়নি। ২০১১ সালে ‘আরব বসন্ত’র ঢেউ লেগেছিল সৌদি রাজতন্ত্রের জনবিরোধিতা ও তাদের নিপীড়ন-নির্যাতনের বিরুদ্ধে। গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠার দাবিতে সেসময় দেশজুড়ে যে গণবিক্ষোভের সূচনা হয়েছিল, তার অংশ হিসেবেই ১০ বছর বয়সী মুর্তাজা তার বন্ধু-বান্ধবদের নিয়ে সাইকেলে চড়ে প্রতিবাদে নেমেছিল। সে অপরাধেই পরবর্তীতে তাকে রাষ্ট্রদোহের অভিযোগে গ্রেফতার করে পুলিশ। সৌদি আরবের দাবি, তারা রাষ্ট্রবিরোধী স্লোগান দিয়েছিল।

ইসরায়েলি রাষ্ট্রব্যবস্থায় ভারী ভারী অস্ত্রশস্ত্রে সজ্জিত সামরিক বাহিনীর বিরুদ্ধে গুলতি (ঢিল) আর ছুরি হাতে প্রায়শই নামতে দেখা যায় সেখানকার শিশু প্রতিবাদীদের। ওই শিশুদেরকে সন্ত্রাসী তমকা লাগিয়ে ‘বিচারিক সন্ত্রাস’ জারি রেখেছে সেখানকার জায়নবাদী সরকার। তবে ২০১১ সালে ১০ বছর বয়সে সৌদি শিশু মুর্তজা যখন প্রতিবাদে নেমেছিল, তখন তার হাতে কোনও গুলতি কিংবা ছুরি ছিল না। পায়ে একটি সাইকেল ছিল। সম্প্রচারমাধ্যম সিএনএন-এ প্রচারিত সামাজিক মাধ্যমের এক ভিডিওতে দেখা যায়. সৌদি আরবের পূর্বাঞ্চলের এক ধুলোমলিন রাস্তায় বাইসাইকেলে জড়ো হয়েছে একদল বালক। সাইকেলের পেডেলে পা রেখে প্রায় ৩০ বালকের ওই দলটিকে নেতৃত্ব দিচ্ছিল ১০ বছর বয়সী মুর্তাজা কুরেইরিস। মনে হচ্ছিল কোনও প্রতিযোগিতা করার জন্য জড়ো হয়েছে বালকের দল। সৌদি আরবের দাবি, তারা সে সময় সরকারবিরোধী শ্লোগান দিচ্ছিলো। ঘটনার দায়ে মুর্তজাকে আটককেন্দ্রে পাঠানো হয়েছিল।

২০১৪ সালের সেপ্টেম্বরে মুর্তাজাকে গ্রেফতার দেখায় সৌদি কর্মকর্তারা। সে সময় তার বিরুদ্ধে সন্ত্রাসবাদের অভিযোগ আনা হয়। মুর্তাজার বিরুদ্ধে অন্যান্য অভিযোগগুলো হচ্ছে: সরকারবিরোধী আন্দোলনে অংশ নেওয়া, আন্দোলন করতে গিয়ে নিহত হওয়া নিজ ভাইয়ের শেষকৃত্যে অংশ নেওয়া, ‘সন্ত্রাসী গোষ্ঠী’তে যোগ দেওয়া, পুলিশ স্টেশনে ককটেল নিক্ষেপ ও গুলি চালানো। ২০১৬ সালের নভেম্বরে বিধিবহির্ভূত আটক নিয়ে কাজ করা জাতিসংঘ দল জানায়, এমন একজনকে নির্জন কারাবাসে রাখা হয়েছে বলে তারা জানতে পেরেছেন মুর্তজার সঙ্গে যার হুবহু মিল রয়েছে। তাকে অনেক শারীরিক নির্যাতন করে আন্দোলনে সংশ্লিষ্টতার ব্যাপারে মিথ্যা স্বীকারোক্তি আদায় করা হয়েছে। ২০১৭ সালের মে মাসে তাকে প্রাপ্তবয়স্কদের কারাগার আল-মাবাবেখে স্থানান্তর করা হয়। তবে তখনও তার বয়স ছিলো ১৬ বছর। আটকাবস্থায় থাকার পুরোটা সময়জুড়ে তাকে কোনও আইনজীবীর সঙ্গে যোগাযোগ করতে দেওয়া হয়নি। ২০১৮ সালে তাকে বিশেষ আদালতের সামনে হাজির করার পর প্রথমবারের মতো আইনজীবীর সঙ্গে কথা বলার সুযোগ পায় মুর্তাজা। ২০০৮ সালে মানবাধিকার কর্মী ও আন্দোলনকারীদের দমনের জন্য এই বিশেষ আদালত গঠন করেছিল রাজতন্ত্রের শাসকরা।

মৃত্যুদণ্ডের সাজা ঘোষণার পর এখন পরবর্তী বিচারকার্যের মুখোমুখি হওয়ার অপেক্ষায়ে আছে মুর্তাজা। অথচ সৌদি আরব জাতিসংঘের সেই সদস্য দেশগুলোর একটি যারা সংস্থাটির শিশু অধিকার বিষয়ক সনদে স্বাক্ষর করেছে। সেই সনদ অনুযায়ী, ’১৮ বছর বয়সের নিচে কাউকে তার অপরাধের জন্য সর্বোচ্চ সাজা হিসেবে মৃত্যুদণ্ড কিংবা যাবজ্জীবন কারাদণ্ড দেওয়া যাবে না’। তবে এ ধরনের সাজা দেওয়ার ঘটনা সৌদি আরবের জন্য নতুন কিছু নয়। মুর্তাজা ছাড়াও ২০১২ সালে আটককৃত আলি আল নিমর, আব্দুল্লাহ আল জাহের এবং দাউদ আল মারহুন নামে তিন কিশোরকেও ১৮ বছর হওয়ার আগের অপরাধে মৃত্যুদণ্ড দেওয়া হচ্ছে। সিএনএন-এর প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, মুর্তাজার মৃত্যুদণ্ড আদতে সরকারের শিয়াবিরোধী দমন অভিযানের অংশ। ২০১৫ সালে সৌদি যুবরাজ মুহাম্মদ বিন সালমান এই শিয়াবিরোধী অভিযান জোরালো করেন, চলতে থাকে রাজনৈতিক প্রতিপক্ষকে উৎখাত। গত এপ্রিলে এক শিয়া মতানুসারীসহ দুই শিশুর মৃত্যুদণ্ড কার্যকর করে সৌদি আরব। শিয়া শিশু আব্দুল কারিমকে সরকার বিরোধী আন্দোলনে সংশ্লিষ্টতার অভিযোগে ১৬ বছর বয়সে আটক করা হয়েছিলো। একই দিনে তার সঙ্গে আরও ৪৬ জনের মৃত্যুদণ্ড কার্যকর করে সৌদি সরকার। তাদের বেশিরভাগই ছিলেন শিয়া সম্প্রদায়ের মানুষ। জাতিসংঘের মানবাধিকার পর্যবেক্ষকরা জানায়, সৌদি সরকার সন্ত্রাসবিরোধী অভিযানের নামে রাজনৈতিক আন্দোলন দাবিয়ে রাখতে চায়।

সিএনএন প্রকাশিত বিশেষ অনুসন্ধানী প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, মুর্তজার বিচারে তার বিরুদ্ধে মৃত্যুদণ্ডের সবচেয়ে ভয়াবহ প্রক্রিয়া অনুসরণ করা হতে পারে। তাকে ক্রুশবিদ্ধ কিংবা শিরোশ্ছেদ করা হতে পারে। অথচ তার বিরুদ্ধে কোনও খুনের অভিযোগ নেই। প্রসিকিউটরদের দাবি অনুযায়ী, দেশটির ইসলামি শরীয়াহ আইন মোতাবেক, ‘রাষ্ট্রদোহের বীজবপন’ সবচেয়ে বড় অপরাধ বলে বিবেচিত হয়। দেশটির স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের তথ্য অনুযায়ী ২০১৮ সালে সৌদি আরব ১৩৯ জনের মৃত্যুদণ্ড কার্যকর করেছে। তাদের মধ্যে ৫৪ জনের বিরুদ্ধে কোনও সহিংসতার অভিযোগ নেই। বেশিরভাগেরই শিরোশ্ছেদ করা হয়েছে। কখনও কখনও তা জনসমক্ষেই। অ্যামনেস্টি ইন্টারন্যাশনালের মধ্যপ্রাচ্য বিষয়ক গবেষণা পরিচালক লিন মালুফ বলেন, ‘কোনও সন্দেহ নেই যে সৌদি আরব নিজেদের জনগণের ওপর যেকোনও মাত্রায় চড়াও হতে পারে। এমনকি শিশু অবস্থায় আটককৃতদের মৃত্যুদণ্ড দিতেও তারা সদাসর্বদা প্রস্তুত।’

১০ বছর বয়সে আটক সৌদি কিশোর মুর্তাজা কুরেইসের মৃত্যুদণ্ডের ঘোষণার বিপরীতে নিন্দায় ছেয়ে গেছে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমগুলো। টুইটারে সৌদি আরবের এই সিদ্ধান্তের সমালোচনা করছেন তারকা, বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষক, অ্যাকটিভিস্টসহ বিশ্বের বিভিন্ন শ্রেণীপেশার মানুষ। সৌদি আরবে মুর্তজাই সর্বকনিষ্ঠ রাজনৈতিক বন্দি। যু্ক্তরাষ্ট্রের মিয়ামি বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক রুলা জেব্রায়েল এক টুইটে বলেন, ‘১০ বছর বয়সে আটক শিশুকে এখন মৃত্যুদণ্ড দিতে চাইছে সৌদি আরব। দেশটির সর্বকনিষ্ঠ রাজনৈতিক বন্দি সে।’ মাহমুদ মুরসালিন নামে এক জন টুইট করেন, ‘কথিত অপরাধের সময় মুর্তাজার বয়স ছিলো মাত্র ১০ বছর। গ্রেফতারের সময় ছিলো ১৩ বছর। তাকে কীভাবে মৃত্যুদণ্ড দেওয়া হয়? আমার প্রশ্ন ইসলাম কি এটা সমর্থন করে?’ এছড়া এই মৃত্যুদণ্ড বাতিলের দাবিতে অনলাইনে পিটিশন খুলেছেন অনেকে। চেঞ্জ ডট ওআরজিতে খোলা ওই পিটিশনে স্বাক্ষর করেছেন অনেকে। সেই লিংক টুইট করেও সবাইকে এগিয়ে আসার আহ্বান জানানো হচ্ছে।