১৪ কোটি টাকা জরিমানার পরেও ফেরেনি রাজপথের শৃঙ্খলা

রাজধানী ঢাকায় যানবাহন চলাচলে গত ৫ আগস্ট থেকে দুই দফা ট্রাফিক অভিযান ও প্রচারণা চালিয়েছে ঢাকা মেট্রোপলিটান পুলিশ। ট্রাফিক পুলিশের এই অভিযানে নগরবাসীর কাছ থেকে জরিমানা আদায় করা হয়েছে প্রায় ১৪ কোটি টাকা। কোটি কোটি টাকা জরিমানা আদায় হলেও ন্যূনতম শৃঙ্খলা আসেনি যানবাহন চলাচলকারী ঢাকার ব্যস্ততম সড়কগুলোয়। আগের মতোই যেখানে-সেখানে বাস থামছে, নিয়ম অমান্য করে যাত্রীরা পারাপার হচ্ছেন রাস্তা। যত্রতত্র পসরা বসিয়ে দখল হচ্ছে ফুটপাত, পার্কিং চলছে নিয়ম না মেনেই।

নিরাপদ সড়কের দাবিতে শিক্ষার্থীদের আন্দোলনের পর সড়কে শৃঙ্খলা ফেরাতে গত ৫ আগস্ট থেকে ১৪ আগস্ট পর্যন্ত ট্রাফিক সপ্তাহ পালন করা হয়। সে সময় ১০ দিনে পাঁচ কোটি ১০ লাখ ৯৬ হাজার ২৭৭ টাকা জরিমানা আদায় করা হয় এবং বিভিন্ন অনিয়মের দায়ে ৮৮ হাজার ২৯৩টি ট্রাফিক মামলা হয়। সড়কে শৃঙ্খলা না ফেরায় আবারও ট্রাফিক অভিযানের ঘোষণা দেয় ঢাকা মেট্রোপলিটান পুলিশ। প্রথম দফায় অভিযানের ২০ দিন পর আবারও দ্বিতীয় দফায় ট্রাফিক অভিযানের ঘোষণা দেন ডিএমপি কমিশনার মো. আছাদুজ্জামান মিয়া। ৫ সেপ্টেম্বর থেকে শুরু হওয়া ট্রাফিক অভিযান চলে পুরো সেপ্টেম্বরজুড়ে।

দ্বিতীয় দফার অভিযানে পুলিশ জরিমানা আদায় করে প্রায় ৯ কোটি টাকা। ট্রাফিক মামলা হয়েছে দেড় লাখ। রেকারিং করা হয় ২০ হাজার গাড়ি। আর ডাম্পিংয়ে পাঠানো হয় এক হাজারের বেশি যানবাহন; কিন্তু মামলা ও জরিমানার পর সড়কগুলোয় কাঙ্ক্ষিত শৃঙ্খলা আসেনি।

ট্রাফিক পুলিশের অভিযান চলাকালে রাজধানীর বেশ কয়েকটি সড়ক সরেজমিনে যান এই প্রতিবেদক। সরেজমিনে রাজধানীর যাত্রাবাড়ী, গুলিস্তান, পল্টন, শাহবাগ, কারওয়ানবাজার মোড়, ফার্মগেট, মিরপুর, বাড্ডা, নিউ মার্কেট, সায়েন্সল্যাব মোড়, কুড়িল, উত্তরাসহ বিভিন্ন এলাকা ঘুরে দেখা যায়, সড়কে শৃঙ্খলা ফেরাতে ট্রাফিক পুলিশ চালক ও পথচারীদের মধ্যে সচেতনতামূলক ক্যাম্পেইন চালাচ্ছে। পুলিশের পাশাপাশি কাজ করছেন স্কাউটস ও স্বেচ্ছাসেবী বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানের কর্মীরাও। সবাই মিলে চেষ্টা করেছেন সড়কে শৃঙ্খলা ফেরাতে, কিন্তু অবস্থা হয়েছে আগের মতোই। একই সঙ্গে পথচারীদের নির্দিষ্ট জেব্রা ক্রসিং ও ফুট ওভারব্রিজ ব্যবহারের কথা বললেও বেশির ভাগ পথচারী তা মানছেন না। এতে শৃঙ্খলা ফেরাতে বেগ পেতে হয় ট্রাফিক পুলিশসহ সংশ্লিষ্টদের।

ঢাকার শাহবাগ মোড়ে দায়িত্ব পালনকারী রোভার স্কাউটস সদস্য ইমতিয়াজ মাহমুদ বলেন, ‘আমরা অক্লান্ত পরিশ্রম করেছি। পথচারী অনেকেই আছেন, যাঁরা তাড়াহুড়ার অজুহাতে নিয়ম না মেনে যেখান-সেখান দিয়ে রাস্তা পারাপার হতে চান। আমরা তাঁদের বাধা দিয়েছি, বুঝিয়েছি। সমস্যা হলো কেউ ফুট ওভারব্রিজে উঠতে চান না।’ ঢাকার মোহাম্মদপুরের বাসিন্দা মো. শহিদুল ইসলাম বলেন, ‘নিরাপদ সড়কের দাবিতে আন্দোলন হলো। পুলিশও তৎপর হলো, কিন্তু কাজের কাজ কিছুই হলো না। আগে নিয়ম না মেনে গাড়ি চালানোর কারণে যেমন ভোগান্তি হয়েছিল, এবারও তেমন ভোগান্তি দেখা দিয়েছে। যার যার অবস্থান থেকে আইন না মানলে তো পরিস্থিতির উন্নতি হবে না। আজিমপুর থেকে উত্তরা রুটে চলাচলকারী ভিআইপি পরিবহনের চালক ইদ্রিস আলী বলেন, ‘আমি সাত বছর ধরে গাড়ি চালাচ্ছি। গাড়ি চালানোর সময় চেষ্টা করি নিয়ম মেনে চলার।’ তিনি ক্ষোভ প্রকাশ করে বলেন, ‘অনেক চালক আছেন ন্যূনতম ড্রাইভিং নিয়ম মানার প্রবণতা নেই তাঁদের মধ্যে। এ ছাড়া ট্রাফিক রুলস সম্পর্কেও তাঁরা জানেন না। তাঁরাও গাড়ি চালাচ্ছেন ঢাকার সড়কে, তাঁদেরও লাইসেন্স আছে। মোট কথা পরিস্থিতির উন্নতি হওয়া দরকার। না হলে সড়কে শৃঙ্খলা ফিরে আসবে না।’ গণপরিবহন বিশেষজ্ঞরা বলছেন, যেসব সমস্যার কারণে সড়কে এমন বিশৃঙ্খলা, সেসব সমস্যার সমাধান না করে শুধু জরিমানা আদায়ের মাধ্যমে শাস্তি দিয়ে শৃঙ্খলা ফেরানো সম্ভব নয়। এভাবে হয়তো সাময়িকভাবে শৃঙ্খলা ফিরে আসবে; কিন্তু পরিস্থিতির কোনো স্থায়ী উন্নতি হবে না।

গণপরিবহন বিশেষজ্ঞ ও বুয়েটের পুরকৌশল বিভাগের অধ্যাপক ড. শামছুল হক বলেন, ‘সমস্যার সমাধান না করে চালক বা সাধারণ মানুষকে জরিমানার মাধ্যমে শাস্তি দেওয়া অযৌক্তিক। যেসব কারণে সড়কে বিশৃঙ্খলা দেখা দিয়েছে তার সমাধান না করে যত যা-ই করা হোক না কেন, সড়কে বিশৃঙ্খলা থেকেই যাবে।’ তিনি আরো বলেন, ‘এটা সত্যিকার অর্থে যদি কার্যকর করতে হয়, তাহলে অবকাঠামোর উন্নয়ন করতে হবে, বিশেষ করে গণপরিবহন, ফুটপাত ও সিগন্যাল, পার্কিং ও গাড়ির সংখ্যা নিয়ন্ত্রণ না করে যদি সমস্যা রেখে শাসন করতে যাওয়া হয়, তাহলে কিন্তু নিয়ন্ত্রণ হবে না। ক্যান্টনমেন্টের দিকে তাকালে বোঝা যায়, ওরা শাসন করে; কিন্তু পরিবেশটা আগে নিশ্চিত করেছে। সেখানে ফুটপাতে কেউ বসে না, কোনো রিকশা প্রধান সড়কে আসে না। সেখানে রিকশার সংখ্যাগুলো নিয়ন্ত্রণে আছে। নানা সমস্যা রেখে শুধু দু-একটি সমস্যার সমাধান করতে চাইলে সমস্যা রয়েই যাবে। ফুটপাত অবমুক্ত রাখব না, পথচারীদের নিরাপদে চলাচলের জায়গা দেব না, রাস্তা পারাপারে সিগন্যালের ব্যবস্থা করব না, শুধু আইনের প্রয়োগ ঘটিয়ে সমস্যার সমাধান করতে চাইব—সেটা তো সম্ভব নয়। সবার আগে দরকার সিস্টেম পরিবর্তন, দরকার অবকাঠামোগত পরিবর্তন।’

জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের নগর ও অঞ্চল পরিকল্পনা বিভাগের অধ্যাপক ড. আকতার মাহমুদ বলেন, ‘ঢাকার অন্যান্য এলাকার তুলনায় গুলশানে গণপরিবহন সুন্দর নিয়মে চলছে। নিয়ন্ত্রিত মাত্রায় অভিজাত এই এলাকায় রিকশা চলছে। এর জন্য লাখ লাখ টাকা খরচের দরকার পড়েনি। শুধু দরকার পড়েছে একটা পরিকল্পিত উদ্যোগ।’ তিনি আরো বলেন, ‘আমাদের নগর উন্নয়ন পরিকল্পনায় নানা অসংগতি আছে, অনেক পরিকল্পনায় গাফিলতি আছে, নানা অনিয়ম আছে। নগর উন্নয়নে যা-ই করি না কেন, যথাযথ পরিকল্পনা করেই তা করা উচিত। সব কিছু পথচারী ও চালকদের ওপর চাপিয়ে দিয়ে আইন মানানো যায় না। জরিমানা কিংবা মামলা দিয়ে এসব নিয়ন্ত্রণ করা সম্ভব নয়। এগুলোর জন্য অবকাঠামোগত সমাধান আগে প্রয়োজন।’

ট্রাফিক সপ্তাহের মাধ্যমে জরিমানা আদায় ও সড়কে শৃঙ্খলা ফেরানোর কাজে ট্রাফিক পুলিশ কতটা সফল, জানতে চাইলে ডিএমপির উপকমিশনার (মিডিয়া) মাসুদুর রহমান বলেন, ‘নগরবাসী কিংবা যানবাহন চালকের মধ্যে ট্রাফিক নিয়ম না মানার যে প্রবণতা সেটি বহু দিনের। দু-একটি অভিযানে তো পুরো পরিস্থিতির আমূল পরিবর্তন ঘটানো সম্ভব নয়। আমরা আশাবাদী, একদিন না একদিন ঢাকার সড়কগুলোয় শৃঙ্খলা ফিরে আসবে। তবে সময় লাগবে।’