১৫ই আগস্ট ও ভুলে যাওয়া একটি প্রতিবাদ || আকিদুল ইসলাম সাদী

আকিদুল ইসলাম সাদী : আগস্ট মাস। ১৯৭৫ সালে এই মাসের ১৫তারিখে ঘটেছিল ইতিহাসের কলঙ্কময় এক অধ্যায়। বাংলাদেশের স্থপতি বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান উক্ত দিনে স্ব-পরিবারে নিহত হন। এই ঘটনার পর দেশের মধ্যে জরুরি অবস্থা সৃষ্টি হয়। এমতাবস্থায় দেশের মানুষ হারিয়ে ফেলে এই ঘৃণিত অপরাধের প্রতিবাদের ভাষা। আওয়ামীলীগের অনেক বাঘা বাঘা নেতারাও তখন নিরবতা পালন করে। কিন্তু সেদিন চুপ থাকতে পারেন নি বঙ্গবন্ধুর সহচর এক মাওলানা। কঠিনভাবে তিনি এই ঘৃণিত অপরাধের প্রতিবাদ করেছিলেন। যেক’জন সাহসী সন্তান এই কারণে প্রাণ হারিয়েছিলেন, তিনি ছিলেন তাদের মধ্যে অন্যতম। এই প্রতিবাদকারী মাওলানা হলেন- একাত্তরের গেরিলা কমান্ডার মাওলানা সৈয়দ আহমদ। এই মহান বীর-ই ছিলেন “বঙ্গবন্ধু হত্যার” প্রথম প্রতিবাদকারী ও প্রথম শহিদ।

সৈয়দ আহমদ ১৯৬৫ সালে চট্টগ্রামের পুঁইছড়ি মাদরাসা থেকে মাওলানা পাশ করেন। এর ভিতরই তিনি স্কুল থেকে মেট্রিক পরীক্ষা দিয়ে পাশ করেন। অতঃপর ভর্তি হন চট্টগ্রাম সিটি কলেজে। (বর্তমান সরকারী সিটি বিশ্ববিদ্যালয় কলেজ) সেই সময় ছাত্রলীগের ঘাটি হিসেবে কলেজটি খুবই পরিচিত ছিলো। সেখান থেকেই শুরু হয় তার সংগ্রামী জীবন। ১৯৬৮ ও ৬৯- এর গণআন্দোলনে তিনি সুন্দরভাবে নেতৃত্ব প্রদান করেন। ১৯৭১ সালে মহান মুক্তিযুদ্ধে তিনি সক্রিয় অংশ গ্রহণ করেন। এই বীর মুক্তিযোদ্ধা চট্টগ্রামে নিজ এলাকায় মৌলভী সৈয়দ নামে ব্যাপক পরিচিত।

বঙ্গবন্ধুর বিশ্বস্ত ও আস্থাভাজন নেতাদের মধ্যে মাওলানা সৈয়দ ছিলেন অন্যতম। বঙ্গবন্ধু তাকে পুত্রসম স্নেহ করতেন। ভালোবেসে ডাকতেন ” আমার মাওলানা সাব ” বলে। চট্টগ্রামে সফরে গেলে তিনি মাওলানা সৈয়দকে সাথে রাখতেন। মাঝে মধ্য খবর দিয়ে তাকে ঢাকাতে আনতেন। তার বীরত্ব ও সাহসের ভূয়সী প্রশংসা করতেন। ৭১-এর সময় এই বীর মুক্তিযোদ্ধা গেরিলা কমান্ডারের দায়িত্ব পালন করেছিলেন।

এই ঘনিষ্ঠতার কারণে ১৯৭৫ সালের ১৫ ই আগস্ট বঙ্গবন্ধুর স্ব-পরিবারে নিহত হওয়ার ঘটমাকে তিনি স্বাভাবিকভাবে নিতে পারেন নি। ফলে তার হত্যার প্রতিবাদে মাওলানা সৈয়দ সশস্ত্র বিদ্রোহ ঘোষণা করেছিলেন। শুরু করেছিলেন গোপন মিশন। কয়েকটিতে সফল অপারেশনও পরিচালনা করেছিলেন। ৭৫-এর ৩-ই নভেম্বর খালেদ মোশাররফের নেতৃত্বে ঢাকার সমাবেশের অন্যতম উদ্যোক্তাদের একজন ছিলেন এই মাওলানা। ৭-ই নভেম্বর পাল্টা সামরিক অভ্যুত্থানের মধ্যে খালেদ মোশাররফ নিহত হলে মাওলানা সৈয়দ, এ, বি, এম মহিউদ্দিন চৌধুরীসহ পুরো দলটি ভারতে আশ্রয় গ্রহণ করেন।

১৯৭৬ সালের ৭-ই নভেম্বর দেশদ্রোহীতার অভিযোগে মাওলানা সৈয়দকে ১নং ও এ, বি, এম মহিউদ্দিন চৌধুরীকে ২নং আসামি করে মোট ১৬ জনে জনবিপ্লবী নেত-কর্মীর নামে মামলা দায়ের করা হয়। পরবর্তীতে ভারতের জাতীয় নির্বাচনে ইন্দ্রা গান্ধীর দল পরাজিত হলে ভারতীয় পুলিশ বাহিনী তাদেরকে আটক করে ময়মনসিংহ বর্ডার দিয়ে পুশব্যাক করে।বাংলাদেশে সিমান্তে প্রবেশের সাথে সাথে বাংলাদেশি পুলিশ তাদেরকে করে। নিয়ে যায় ঢাকা কেন্টনমেন্টের জায়েন্ট ইন্টারগেশন সেলে। সেখানে তাদের চলে অমানবিক নির্যাতন। ফলে ঐ বছরের ১১-ই আগস্টে এই মহান মুক্তিযোদ্ধা ও বঙ্গবন্ধু হত্যার প্রতিবাদকারী মাওলানা সৈয়দ আহমদকে বিনা বিচারে নির্মমভাবে হত্যা করা হয়।

অতঃপর তাকে নিয়ে যাওয়া হয়, তার গ্রামের বাড়ি চট্টগ্রামের বাঁশখালীতে। সেখানেই চিরনিদ্রায় শায়িত আছেন এই প্রতিবাদী মাওলানা।

তথ্যসূত্র : অধ্যাপক সিরাজুল ইসলাম চৌধুরীর একাত্তরের ডাইরী।
মুক্তিযোদ্ধা রবিউল হোসেন সম্পাদিত ‘বাংলাদেশ আমার সাধনার দেশ’।
ড: এ, আর, মল্লিকের মুক্তিযুদ্ধের সৃত্মিকথা।
ক্যাপ্টেন শমসের মুবিন চৌধুরীর একাত্তরের ডাইরী।
‘রণাঙ্গনে সূর্য সৈনিক’, সাখাওয়াত হোসনে মজনু।
বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধের দলিলপত্র, ৯ম খন্ড।
আলেম মুক্তিযোদ্ধার খোঁজে, শাকের হোসাইন শিবলী পৃষ্টা

লেখক : প্রবন্ধিক, ছড়াকার, গল্পকার, ঔপন্যাসিক