১৫ মিনিটে কলেরা নির্ণয় করে বাংলাদেশি ‘কলকিট’

বেসরকারি ওষুধ প্রস্তুতকারী প্রতিষ্ঠান ইনসেপ্টা ফার্মাসিউটিক্যালসের সহায়তায় আইসিডিডিআর,বির বিজ্ঞানীরা কম দামে ও মাত্র ১৫ মিনিটে কলেরা নির্ণয়ের যন্ত্র আবিষ্কার করেছেন৷ এর নাম ‘কলকিট’৷ এটি একটি ডিপস্টিক পদ্ধতি৷

এরইমধ্যে এটি বাণিজ্যিকভাবে উৎপাদনের অনুমতি মিলেছে৷ এর দাম পড়বে তিন ডলার বা ১৮০ টাকা৷ বর্তমানে একটি নমুনা পরীক্ষায় খরচ হয় ৮ ডলার বা ৬৪০ টাকা৷

কলকিট-এর বাণিজ্যিক উৎপাদন শুরু হলে কলেরা নির্ণয় সহজ হবে এবং তা অনেক কম খরচে করা সম্ভব হবে৷ কলেরা জরিপও হবে অনেক সাশ্রয়ী৷ একই সঙ্গে আমদানি করা কলেরা নির্ণয় যন্ত্রের ওপর নির্ভরতা কমবে এবং বাংলাদেশে উৎপাদিত কলকিট বিদেশেও রপ্তানি করা যাবে৷

এরইমধ্যে আইসিডিডিআর,বি এবং রোগতত্ত্ব, রোগ নিয়ন্ত্রণ ও গবেষণা ইনস্টিটিউট (আইইডিসিআর)-এর যৌথ ব্যবস্থাপনায় ইনসেপ্টা’র উৎপাদিত কলকিট বাংলাদেশের ২২টি কলেরা জরিপ সাইটে ব্যবহৃত হচ্ছে৷

আইসিডিডিআর,বি’র এক সংবাদ বিজ্ঞপ্তিতে জানানো হয়েছে, এটি একটি ইমিউনোক্রোমাটোগ্রাফিক ডিপস্টিক পরীক্ষা পদ্ধতি, যা মলের নমুনাযুক্ত টিউবের মধ্যে ডুবালে সর্বোচ্চ ১৫ মিনিটের মধ্যে যথাযথ ফলাফল দেখায় এবং তা খালি চোখে রঙিন ব্যান্ডে দেখা যায়৷কলকিটের গবেষণাগার ও মাঠ পর্যায়ের পরীক্ষা-সংক্রান্ত একটি নিবন্ধ সম্প্রতি বিজ্ঞানভিত্তিক জার্নাল ‘প্লস নেগলেক্টেড ট্রপিক্যাল ডিজিজেস’এ প্রকাশিত হয়েছে৷ এতে দেখা যায়, মাঠ পর্যায়ে ‘ভিব্রিও কলেরি’ নির্ণয়ের ক্ষেত্রে কলকিটের সংবেদনশীলতা ও নির্দিষ্টতা বিদেশি কলেরা নির্ণয়ের পদ্ধতি ‘ব়্যাপিড ডায়গনস্টিক টেস্ট’ বা আরডিটি-র অনুরূপ৷ গবেষণায় ৭,৭২০ জন রোগীর মলের নমুনা পরীক্ষা করা হয়, যেখানে দেখা গেছে, কলকিটের সংবেদনশীলতা শতকরা ৭৬ ভাগ ও নির্দিষ্টতা শতকরা ৯০ ভাগ এবং অন্যান্য প্রচলিত আরডিটি-র ক্ষেত্রে এগুলো ছিল যথাক্রমে শতকরা ৭২ ও ৮৬.৮ ভাগ৷

কলেরা নির্ণয়ের ক্ষেত্রে একটি মানসম্পন্ন পদ্ধতি হলো, গবেষণাগারে মল কালচার পরীক্ষার মাধ্যমে রোগ নিশ্চিত করা৷

কলেরা জীবাণু খুব দ্রুত ছড়িয়ে অল্প সময়ের মধ্যেই মহামারির আকার ধারণ করতে পারে৷ তাই দ্রুততম সময়ে সঠিকভাবে রোগ চিহ্নিত করা দরকার৷ ডিপস্টিক পরীক্ষা পদ্ধতি তেমনই একটি পদ্ধতি৷

কলকিট আবিষ্কারের ফলে মহামারিপ্রবণ এলাকা ও আশপাশের স্বাস্থ্যসেবা কেন্দ্রগুলোতে দ্রুত রোগের প্রাদুর্ভাব শনাক্তকরণ, রোগের মৌসুমভিত্তিক ব্যাপকতা পর্যবেক্ষণ এবং প্রাথমিক স্বাস্থ্যসেবা পর্যায়ে কলেরা জরিপের ক্ষেত্রেও এটি ব্যবহারের ব্যাপক সম্ভাবনা রয়েছে৷

কলেরা একটি অতি প্রাচীন রোগ৷ বিশ্বব্যাপী ১০০ কোটিরও বেশি মানুষ এই রোগের ঝুঁকির মধ্যে রয়েছে, যার সিংহভাগ রয়েছে দক্ষিণ এশিয়ায়৷ বাংলাদেশে প্রায় সাড়ে ৬ কোটি মানুষ কলেরার ঝুঁকিতে রয়েছে৷ এই রোগটির জন্য প্রধানত ‘ভিব্রিও কলেরি’ নামের একটি জীবাণু দায়ী৷

তিন বছর গবেষণার পর এই দ্রুত রোগ নির্ণয় পরীক্ষা পদ্ধতি উদ্ভাবন সম্ভব হয়েছে৷ আইসিডিডিআর,বি’র সংক্রামক রোগ বিভাগের বিজ্ঞানী ড. ফেরদৌসী কাদরী কলকিট তৈরির কাজে নেতৃত্ব দিয়েছেন৷ তিনি বলেন, ‘‘ঐতিহাসিকভাবে দেখা যায় যে, এই অঞ্চল থেকেই বিশ্বের সাতটি মহামারির সবগুলোর বিস্তার ঘটেছে৷ কলেরা রোগের দ্রুত শনাক্তকরণের ওপর এ রোগের ব্যবস্থাপনা নির্ভর করে৷ বর্তমানে কলেরা শনাক্তকরণের উদ্দেশ্যে গবেষণাগারে মলের কালচার পরীক্ষার পাশাপাশি আমদানিকৃত দ্রুত রোগনির্ণয় কিট ব্যবহৃত হচ্ছে৷’’

তিনি বলেন, ‘‘এখন বাংলাদেশে স্থানীয়ভাবে উৎপন্ন একটি আরডিটি কলকিট রয়েছে, যা দেশের আমদানি নির্ভরতা হ্রাস করবে এবং ভবিষ্যতে কলেরার ঝুঁকিতে থাকা দেশগুলোয় রপ্তানির সুযোগ তৈরি করবে৷ এর মধ্য দিয়ে প্রাচীন এই রোগের মোকাবিলা এখন স্থানীয়ভাবে উৎপাদিত কলেরা প্রতিরোধ উপকরণের মাধ্যমে সম্ভব হবে৷’’

বাংলাদেশে কলেরার ২২টি সার্ভিলেন্স এলাকা রয়েছে৷ এর মধ্যে রোহিঙ্গা ক্যাম্প সবচেয়ে বড় সার্ভিলেন্স এলাকা৷ ওই এলাকায় এখন বিদেশ থেকে আমদানি করা যন্ত্রপাতি ব্যবহার করা হয়৷ কলকিট বাণিজ্যিকভাবে উৎপাদন শুরু হলে রোহিঙ্গা ক্যাম্পে এটি ব্যবহার করা যাবে৷ ফলে সার্ভিলেন্সের খরচ অনেক কমে যাবে৷

আইসিডিডিআর,বি’র মিডিয়া ম্যানেজার তারিফ হাসান জানান, ‘‘কলকিট আবিষ্কারের ঘটনা বাংলাদেশে আরো একটি কারণে যুগান্তকারী৷ আর তা হলো বেসরকারি পর্যায় থেকে এখানে বিনিয়োগ পাওয়া যায়না৷ কিন্তু এক্ষেত্রে ইনসেপ্টা এগিয়ে এসেছে৷ তারা কলেরার ভ্যাকসিন গবেষণায়ও বিনিয়োগ করেছে৷ কলকিটের দাম এখনো চূড়ান্ত হয়নি৷ তিন ডলার দাম হওয়ার কথা রয়েছে৷ সেটা চূড়ান্ত হলেই বাণিজ্যিকভাবে উৎপাদন শুরু হবে৷’’

তিনি জানান, ‘‘আইসিডিডিআর,বি এরইমধ্যে কলেরার ভ্যাকসিনও আবিষ্কার করেছে৷ ডায়রিয়ার জন্য বহুল প্রশংসিত ওরস্যালাইনও আইসিডিডিআর,বি’র আবিষ্কার, যা ডায়রিয়ার মৃত্যু উল্লেখযোগ্যহারে কমিয়ে এনেছে৷ এছাড়া টাইফয়েডের উইডাল টেস্টের চেয়ে আরো বেশি সঠিক পরীক্ষা পদ্ধতি আবিষ্কারের পথে রয়েছে৷’’-ডয়চে ভেলে