৮৬ বছরেও থেমে নেই ‘রিভলভার দাদি’

৮৬ বছর বয়সে এসেও পিস্তল হাতে নিয়ে সোজা দাঁড়াতে পারেন ‘চন্দ্র তোমার’। বৃদ্ধ এই বয়সেও তার লক্ষ্যভেদী দৃষ্টিশক্তির হেরফের ঘটেনি।

সাদা শার্ট, নীল স্কার্ট পরিহিত চন্দ্র তোমারের মাথা স্কার্ফে ঢাকা। লক্ষ্যে আঘাত হানতে পারেন প্রায় ১০ মিটার দূরে থেকে। একটু বিরতি নিয়ে টার্গেটের মাঝ বরাবর আঘাত হানেন তিনি।

ভারতের উত্তরপ্রদেশে বসবাস করেন চন্দ্র তোমার। গত কয়েক বছর এই রাজ্যে বেশ কয়েকটি অনার কিলিংয়ের (পারিবারিক সম্মান রক্ষায় হত্যা) ঘটনা ঘটেছে। ভারতে নারীদের জন্য সবচেয়ে বিপজ্জনক রাজ্যের তকমা ইতোমধ্যে জুড়ে গেছে উত্তরপ্রদেশের কপালে।

চন্দ্র তোমারের বয়স যখন ৬৫ বছর, তখন হঠাৎ করেই শ্যুটিংয়ের প্রতি আগ্রহী হয়ে উঠেন। শ্যুটিংয়ের জন্য ইতোমধ্যে দেশটিতে ‘রিভলভার দাদি’র খেতাব পেয়েছেন তিনি।

ভারতের অন্যান্য দাদিদের মতো তিনি প্রত্যেক দিন পরিবারের সদস্যদের জন্য রান্না, গবাদি পশুর লালন-পালন, গাভীর দুধ সংগ্রহ ও গরুর গোবর দিয়ে জ্বালানি তৈরি করেন।

প্রাত্যহিক এসব কাজ ছাড়াও এই দাদির ভারতে একটি পরিচয় আছে; সেটি হচ্ছে তিনি ভারতের সবচেয়ে বয়স্ক শ্যুটার। এমনকি তাকে বিশ্বের সবচেয়ে বয়স্ক শ্যুটার হিসেবেও মাঝে মধ্যে বলা হয়; যিনি শত শত তরুণ-তরুণীকে তার প্রিয় শ্যুটিং প্রশিক্ষণ দেন।

এমন বয়সে এসে মানুষ যখন নিজেকে সবকিছু থেকে গুটিয়ে নিয়ে অবসরে যান; চন্দ্র তোমার সেই বয়সে পৌঁছে তার নতুন পথচলা শুরু করেন। তিনি বলেন, আমার প্রতিবেশি এবং স্বজনরা যখন আমাকে শ্যুটিং করতে দেখেন; তখন অনেকেই বিদ্রুপ করেন। অন্যদিকে আমার সফলতা তাদের নতুন চিন্তার উদ্রেক করে।

শ্যুটিং রেঞ্জে যেদিন নাতনি শিফালি তোমারের সঙ্গে গিয়েছিলেন সেদিনের কথা এখনো স্মরণ করেন তিনি। জোহরি রাইফেল ক্লাবে শিফালি অনুশীলন করতো।

চন্দ্র তোমার বলেন, ‘১৯৯৯ সালের কথা। আমার নাতনি রাইফেল ক্লাবে একা একা যেতে ভয় পাচ্ছিল। তখন আমাকে তার সঙ্গে যাওয়ার অনুরোধ করে। আমি তাকে শ্যুটিং শিখতে বলেছিলাম। যাতে আমরা গর্ব করত পারি। সে আগ্রহী ছিল না। তাৎক্ষণিকভাবে আমি একটি পিস্তল হাতে তুলে নিয়ে লক্ষ্যে গুলি করেছিলাম।’

সেদিনই প্রথম পিস্তল হাতে নিয়ে প্রথমবারের মতো গুলি করেছিলেন তোমার এবং সেই গুলি গিয়ে লক্ষ্যে আঘাত হানে। ‘এটা দেখার পর আমার এই আবেগকে লালন করার অনুরোধ জানান কোচ।’

এর পরের দিনগুলো ছিল অন্যরকম। প্রত্যেকদিন তিনি অপেক্ষা করতেন তার স্বামী এবং বাবার ঘুমিয়ে পড়ার জন্য। তারা ঘুমিয়ে পড়লে তিনি বাড়ি থেকে সোজা চলে যেতেন ক্লাবে এবং সেখানে শ্যুটিংয়ের চর্চা করতেন।

শরীরের ভারসাম্য রক্ষার দক্ষতা বাড়ানোর জন্য তিনি এক হাতে পিস্তল ও অন্যহাতে পানিভর্তি জগ নিয়ে দীর্ঘ সময় ধরে দাঁড়িয়ে থাকতেন।

তার এই নতুন শখের ব্যাপারে জানতে পারলে পরিবারের সদস্যরা ক্ষুব্ধ হবেন এমন ভয়ে গোপনে গোপনে চালিয়ে যান শ্যুটিং। চন্দ্র তোমার বলেন, ‘যে গ্রামে মেয়েদের স্কুল অথবা কর্মক্ষেত্রে যাওয়ার অনুমতি নেই; সেই গ্রামের এক বয়স্ক নারী একটি পিস্তল হাতে তার আবেগকে লালন করছেন, এটা ছিল বেশ অদ্ভুত এবং হাস্যকর।

একদিন বাড়িতে হকারের দিয়ে যাওয়া স্থানীয় একটি দৈনিক নিজের ছবি দেখে আশ্চর্য বনে যান চন্দ্র তোমার। পত্রিকা থেকে দ্রুত তার ছবিটা কেটে ফেলেন; যাতে তার স্বামী অথবা বাবা দেখতে না পান। কিন্তু বেশি দিন নিজের পরিচয় আর লুকিয়ে রাখতে পারেননি তোমার।

পাঁচ সন্তান ও ১৫ নাতি-নাতনি রয়েছে চন্দ্র তোমারের। অশীতিপর এই শ্যুটার বলেন, ‘গণমাধ্যম যখন আমাকে নিয়ে বার বার লিখেতে শুরু করলো এবং আমি পুরস্কার পেতে শুরু করলাম। তখন প্রত্যেকই আমার সম্পর্কে খোঁজ খবর নিতে আসতো। এজন্য তারা খুশি এবং গর্ব অনুভব করতো।’

তার এই সফলতায় অনুপ্রেরণা পেতে শুরু প্রতিবেশি ও আত্মীয়-স্বজনরা। তার এই সাফল্যগাঁথা যখন ছড়িয়ে পড়ে তখন অনেক তরুণ-তরুণীর অনুরোধ উপেক্ষা করতে পারেননি চন্দ্র তোমার। এই তরুণ-তরুণীদের শ্যুটিং প্রশিক্ষণ দেয়া শুরু করেন।

‘আমার গ্রামেই একটি শ্যুটিং রেঞ্জ চালু করি; যেখানে আমি বিনামূল্যে ছেলে-মেয়েদের প্রশিক্ষণ দেই। শ্যুটিং শেখার জন্য পাশের গ্রাম থেকেও তরুণরা এখানে আসে।’

তোমারের ননদও প্রভাবিত হয় তার এই কাজে। যার বয়স তার চেয়েও বেশি। উত্তরপ্রদেশে শত শত তরুণ-তরুণীকে প্রশিক্ষণ দেয়ার পাশাপাশি তার ভাতিজি সীমা ও নাতনি শিফিলা-সহ পরিবারের ৯ সদস্যকেও শিখিয়েছেন শ্যুটিং।

এর মধ্যে সীমা ২০১০ সালে শটগান চ্যাম্পিয়নশিপে ভারতের প্রথম নারী হিসেবে পদক জিতেছে। এছাড়া নাতনি শিফালি হাঙ্গেরি এবং জার্মানিতে অনুষ্ঠিত আন্তর্জাতিক প্রতিযোগিতায় অংশ নিয়েছে।

তোমারের অনেক নারী শিক্ষার্থী ভারতীয় সেনাবাহিনীতে চাকরি পেয়েছে। প্রবীণ এই শ্যুটার বলেন, তার লক্ষ্য হচ্ছে নারীর ক্ষমতায়ন এবং তারা যাতে নিজেদের নিরাপদ মনে করেন; সেই বোধ তৈরি করা।

উত্তরপ্রদেশের মতো একটি জায়গা যেখানে নারীদের বিরুদ্ধে হরহামেশাই অপরাধ সংঘটন হয়। তোমার বলেন, আত্মরক্ষাই সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ।

তিনি পুলিশের এক কর্মকর্তার সঙ্গে এক প্রতিযোগিতায় অংশ নিয়েছিলেন। সেই দিনের কথা স্মরণ করে চন্দ্র তোমার বলেন, খেলাধুলার পাশাপাশি জীবনের অন্যান্য ক্ষেত্রেও নারী-পুরুষের সমান সুযোগ থাকা উচিত বলে মনে করেন চন্দ্র তোমার।

শ্যুটিং রেঞ্জে প্রশিক্ষণ নেয়ার মাত্র দুই বছর পর ওই পুলিশ কর্মকর্তাকে প্রতিযোগিতায় হারিয়ে দিয়েছিলেন তিনি। হেরে যাওয়ার পর পুলিশের ওই কর্মকর্তা তোমারের পাশে দাঁড়িয়ে ছবি তোলার প্রস্তাব প্রত্যাখ্যান করেছিলেন; লজ্জায়।

সামনে তোমার নিজ গ্রামে একটি হোস্টেল করতে চান; যাতে অন্যান্য রাজ্য থেকে লোকজন তার ক্লাবে প্রশিক্ষণ নিতে এসে সেখানে থাকতে পারে।

‘সম্প্রতি আমি রাজস্থান থেকে অজ্ঞাত একজনের ফোন কল পেয়েছিলাম। শ্যুটিংয়ের প্রশিক্ষণ নিতে আমাকে ফোন করেছিলেন এক নারী। কিন্তু আমি যখন তাকে বলেছি রাজস্থানে যেতে পারবো না; তখন সে হতাশ হয়ে পড়ে।’

চন্দ্র তোমার বলেন, এখানে একটি হোস্টেল করতে পারলে ওই নারীর মতো অন্যান্যরাও এখানে অবস্থান করে প্রশিক্ষণ নিতে পারবে।

১০ মিটার পস্তিল শ্যুটিংয়ে ৩০টিরও বেশি পদক জিতেছেন অশীতিপর এই নারী। সম্প্রতি তার এই কীর্তি ঘটা করে উদযাপন করেছেন উত্তরপ্রদেশের মুখ্যমন্ত্রী যোগী আদিত্যনাথ।

মাঝে মাঝে তাকে এখন টেলিভিশনের পর্দায় দেখা যায়। বলিউডের বিখ্যাত বেশ কয়েকজন তারকা ইতোমধ্যে চন্দ্র তোমারের সঙ্গে তার বাড়িতে দেখা করেছেন। অসাধ্য সাধনের এক পরিবেশে যেখানে নারীদের ফাঁদে আটকে রাখা হয়; সেই সাংস্কৃতিক ধরাবাঁধা ঐতিহ্যের বিরুদ্ধে লড়াইয়ে এখন চন্দ্র তোমারের নাম স্মরণ করা হয়। সম্ভবত এটাই তার সবচেয়ে বড় অর্জন।

যখন তার গ্রামের কোনো তরুণীর বিয়েতে যৌতুক দাবি করে বরপক্ষ; তখন নারীরা কী করতে পারে তার উজ্জ্বল দৃষ্টান্ত হিসেবে তোমারের নাম বলা হয় এবং নিমিষেই বাতিল হয়ে যায় যৌতুকের দাবি।

-আলজাজিরা অবলম্বনে সাইফুজ্জামান সুমন