ইবির শিক্ষক নিয়োগে ২০ লাখ টাকা লেনদেনের অডিও ফাঁস
ইসলামী বিশ্ববিদ্যালয়ে (ইবি) শিক্ষক নিয়োগের জন্য এক প্রার্থীর সঙ্গে ২০ লাখ টাকার চুক্তি হয়। সেই টাকার অর্ধেক নগদ ও বাকিটা চেকে দেওয়া হয়। চাকরি না হওয়ায় সেই প্রার্থীকে অবশ্য টাকা ফেরত দেওয়া হয়।
এ নিয়ে তিনটি অডিও শনিবার ফাঁস হয়েছে। সেই অডিওগুলো এরই মধ্যে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে ভাইরাল হয়েছে। এই ঘটনায় রোববার বিশ্ববিদ্যালয় কর্তপক্ষ তিন সদস্যের একটি কমিটি গঠন করেছে। আগামী ১৫ দিনের মধ্যে ওই কমিটিকে প্রতিবেদন দিতে বলা হয়েছে।
জানা যায়, বাংলা বিভাগের সহযোগী অধ্যাপক ড. বাকী বিল্লাহ বিকুল ও ইংরেজি বিভাগের অধ্যাপক ড. শাহাদৎ হোসেন আজাদ চুক্তির সঙ্গে জড়িত ছিলেন। বিশ্ববিদ্যালয়ের ইসলামের ইতিহাস ও সংস্কৃতি বিভাগের এক প্রার্থীর সঙ্গে ওই বিভাগের সভাপতি অধ্যাপক ড. জাহাঙ্গীর হোসেনের সম্মতিতে নিয়োগ বাণিজ্য হয়েছে বলে অভিযোগ ওঠে।
ক্যাম্পাস সূত্রে জানা গেছে, ১৪ জুলাই শনিবার বিশ্ববিদ্যালয়ের ১০টি বিভাগে ৩৭ জন শিক্ষক নিয়োগে ২৪১তম সিন্ডিকেট চূড়ান্ত অনুমোদন দেয়। পরে প্রার্থী নিয়োগ নিয়ে অডিও রেকর্ড ফাঁস হয়ে যায়। নিয়োগ প্রত্যাশী প্রার্থী ১০ লাখ টাকা নগদ প্রদান এবং বাকি ১০ লাখ টাকার চেক প্রদান করেছেন। তবে ওই প্রার্থীর নিয়োগ নিশ্চিত না করতে পারায় টাকা ফেরত দেওয়া হয়েছে। ১৩ জুলাই রাতে ওই প্রার্থীর স্বামীকে ফোনে ডেকে নিয়ে টাকা ফেরত দিয়েছেন বলেও অডিওতে বলা হয়েছে।
এর আগেও ১২ থেকে ১৫ লাখ টাকায় ইবিতে নিয়োগ বাণিজ্যের অডিও রেকর্ড গণমাধ্যমে প্রকাশিত হয়েছিল। ওই অডিওতে ১২ লাখ টাকার লেনদেন হয়েছিল।
প্রার্থী ফারজানা আক্তারের স্বামী শাহরিয়ার রাজ মামুন বলেন, ‘চাকরির ৯৯ শতাংশ কনফার্ম করেছিল বলেই টাকা দিয়েছিলাম। আমার স্ত্রীর আর চাকরির বয়স নেই। আমি তাদের বিচার চাই।’
বাংলা বিভাগের সহযোগী অধ্যাপক ড. বাকী বিল্লাহ বিকুল বলেন, ‘এটা আমার বিরুদ্ধে ষড়যন্ত্র।’ রেকর্ডের বিষয়ে প্রশ্ন করা হলে তিনি বলেন, ‘বিষয়টি নিয়ে আমি বিব্রত।’
আরেক শিক্ষক অধ্যাপক ড. শাহাদাৎ হোসেন আজাদ বলেন,‘রাজনীতি করার কারণে বিভিন্ন লোকজনের সঙ্গে কথা বলতে হয়। তবে আমি কারো জন্য কখনও ভিসি স্যারের কাছে সুপারিশ করিনি।’
বিশ্ববিদ্যালয়ের ইতিহাস ও সংস্কৃতি বিভাগের সভাপতি অধ্যাপক ড. জাহাঙ্গীর হোসেন বলেন, ‘এ রকম কিছু প্রমাণিত হলে আমি চাকরি ছেড়ে দেব। আমি জানি না, ওই প্রার্থীর নিয়োগ হয়েছে কিনা। তবে আমি এমন ধরনের কোনো বিষয়ে জড়িত নই।’
এ বিষয়ে ইসলামী বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য অধ্যাপক ড. হারুন-অর- রশিদ আসকারী বলেন, ‘যদি এমন ধরনের কোনো চুক্তি তারা করে থাকে, সেটি কার্যকর হোক বা না হোক তাদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়া হবে। অসৎ এবং অশুভ চুক্তি করার জন্য অভিযোগ আকারে এলে আমরা অবশ্যই তদন্ত সাপেক্ষে বিচারের আওতায় আনব। আমি দুর্নীতির ব্যাপারে জিরো টলারেন্স জারি করেছি। সব দুর্নীতি, অনিয়ম বর্তমান প্রশাসন দূর করবেই।’
অডিও রেকর্ডের কিছু অংশ পাঠকদের জন্য হুবহু তুলে ধরা হলো :
ড. বাকী বিল্লাহ : মামুন ভাই আপনি আসতিছেন?
মামুনের স্ত্রী ফারজানা (চাকরিপ্রার্থী) : আসসালামু আলাইকুম স্যার।
ড. বাকী বিল্লাহ : হ্যাঁ, দেখ বাবু আমি…
মামুনের স্ত্রী : স্যার আমি তো আপনাদের কথা শুনে অনেকখানি একদম ডিপেন্ডেবল। যে কালকে আপনারা আমাকে এত করে বললেন, জাহাঙ্গীর স্যার যখন বলল, আপনাকে, আপনার মাধ্যমে টাকাটাও ডিল-ট্রিল করবে। আপনার কথা শুনে আমি একদম ২০ লাখ টাকাও হাতে ধরায় দিলাম। তুলে দিলাম। আশা করলাম। স্যার কেন এমনটা করল? জাহাঙ্গীর হোসেন স্যার।
ড. বাকী বিল্লাহ : এখন আমি তোমার স্যারের সাথে এতক্ষণ বসে থেকে কথা বললাম।
মামুনের স্ত্রী : স্যার তো সিগনেচার না করলে নিয়োগ হতো না। স্যার তো আমাকে বলতে পারত। আমাকে আরো অ্যামাউন্ট দেওয়া লাগত। আমি তাতেও রাজি ছিলাম।
ড. বাকী বিল্লাহ : না না, ওসব না, ওসব না। মনি, ওসব কোনো কিছুই না।
মামুনের স্ত্রী : তাহলে কেন আপনারা আমাকে কনফার্ম দিলেন? আমি রিটেনে ভালো করলাম। ভাইভাতেও ভালো করলাম। আমাকে সব আশ্বস্ত করে দিলেন। আর এখন শেষ মুহূর্তে এসে এমন করলেন আপনারা আমার সাথে?
ড. বাকী বিল্লাহ : এখন কুষ্টিয়া থেকে তোমাকে বলি, হয়ত অন্য কারও হয়েছে বা, যা হোক আমি তো বলতে পারব না।
মামুনের স্ত্রী : কুষ্টিয়ার ক্যান্ডিডেট তো আমিই ছিলাম স্যার।
ড. বাকী বিল্লাহ : হুম, আরে বাবা আরো ক্যান্ডিডেট আছে।
মামুনের স্ত্রী : নুসরাত ছিল। নুসরাতের কি হইছে?
ড. বাকী বিল্লাহ : সেটা বলতে পারছি না।
মামুনের স্ত্রী : স্যার কাইন্ডলি, আপনারা যদি একটু দেখতেন…
ড. বাকী বিল্লাহ : আরে বাবু।
মামুনের স্ত্রী : আমি আপনাদের কাছে কত আশা করেছিলাম।
ড. বাকী বিল্লাহ : না না, আমি তো জাহাঙ্গীর স্যারের সাথে এখনই উঠে এলাম। এখন এই জিনিসটা এখনই আবার। মামুন ভাই জিনিসটা বারবারই জানতে চাচ্ছে। আমি কিন্তু তাকে জানাচ্ছিলাম না। আমি তাকে পরে জানাব। কালকে সিন্ডিকেট হবে। সিন্ডিকেটের পরে জানাব। কিন্তু আগে জানিয়েই আমি আরো বিব্রত হলাম দেখছি।
মামুনের স্ত্রী : জ্বি স্যার, আপনি আমাকে কনফার্ম করলেন। তোমার এইটটি পার্সেন্ট হয়ে গেছে। তোমার কোনো অসুবিধা নেই। এর জন্য আপনি যখন যে শর্ত দিয়েছেন, টাকা দেওয়া বলেন, জাহাঙ্গীর স্যারের… কোনো সত্যতা যাচাইও করতে যায়নি। আপনাকে সঙ্গে সঙ্গে টাকাটা পে করে দিয়েছি। সব করে দিয়েছি স্যার।
ড. বাকী বিল্লাহ : সেটা নিয়ে তো আর সমস্যা নাই। আমরা তো কোনো মিস ইউস করিনি। জাহাঙ্গীর স্যার তো এটা মিস ইউস করেননি। তাই না? এখন সে না পারলে, আমি তো মাঝখানে থেকে মানুষের উপকার করে এখানে তো কোনো ইন্টারেস্ট নেই।
মামুনের স্ত্রী : জাহাঙ্গীর স্যার এটা করত না?
ড. বাকী বিল্লাহ: পারত কিনা সেটা আমার জানা নেই। রাতে ব্যস্ত হয়ে গেছেন। সরি বলেছেন উনি। এখন কি করব বল? কিছু করার নেই বাবু। মামুন ভাইকে, আমি তো বসে আছি। উনি আসলে আমি তো উনাকে পৌঁছে দিয়ে…
মামুনের স্ত্রী : আচ্ছা আপনি উনার (স্বামী) সাথে কথা বলেন।
এবার স্বামীর সঙ্গে কথা বলার জন্য ফোন এগিয়ে দেন তাঁর স্ত্রী।
ড. বাকী বিল্লাহ: হ্যাঁ।
ফারজানার স্বামী : হ্যালো…।
ড. বাকী বিল্লাহ : হ্যাঁ, মামুন ভাই ভয় পাচ্ছেন কেন? কুষ্টিয়ার ছেলে। আপনি আসেন। আমি তো আপনাকে নিজে পৌঁছে দেব। কি মুশকিল রে ভাই…মানুষের উপকার করতে গিয়ে আমি নিজেই তো একটা বিব্রতকর অবস্থার মধ্যে পড়েছি।
তদন্ত কমিটি গঠন
এদিকে শিক্ষক নিয়োগ বাণিজ্যের অডিও ফাঁসের ঘটনায় তিন সদস্য বিশিষ্ট তদন্ত কমিটি গঠন করেছে কর্তৃপক্ষ। রোববার বিকেলে উপাচার্য অধ্যাপক ড. হারুন-উর-রশিদ আসকারী এ কমিটি গঠন করেন।
রেজিস্ট্রার দপ্তর সূত্র জানায়, বিশ্ববিদ্যালয়ের ইসলামের ইতিহাস ও সংস্কৃতি বিভাগের শিক্ষক নিয়োগ বোর্ডের প্রার্থী ফারজানা আক্তার এবং তাঁর স্বামী শাহরিয়ার আল মামুনের সঙ্গে বিশ্ববিদ্যালয়ের বাংলা বিভাগের সহযোগী অধ্যাপক ড. বাকী বিল্লাহ এবং ইংরেজি বিভাগের অধ্যাপক ড. শাহাদৎ হোসেন আজাদের মধ্যেকার সংলাপের অডিও ফাঁসের অভিযোগ তদন্ত কমিটি গঠন করা হয়েছে।
কমিটিতে বিশ্ববিদ্যালয়ের ইনফরমেশন অ্যান্ড কমিউনিকেশন ইঞ্জিনিয়ারিং বিভাগের অধ্যাপক ড. মাহবুবুর রহমানকে আহ্বায়ক করা হয়েছে।
এ ছাড়াও কমিটিতে ছাত্র উপদেষ্টা ও বায়োটেকনোলজি অ্যান্ড জেনেটিক ইঞ্জিনিয়ারিং বিভাগের অধ্যাপক ড. রেজওয়ানুল ইসলাম, ইংরেজি বিভাগের অধ্যাপক ড. আক্তারুল ইসলাম জিল্লুকে সদস্য করা হয়েছে।
আগামী ১৫ কার্য দিবসের মধ্যে তদন্ত প্রতিবেদন প্রশাসনের কাছে জমা দিতে বলা হয়েছে।
ইবির ভারপ্রাপ্ত রেজিস্টার এস এম আবদুল লতিফ বলেন,‘নিয়োগ বাণিজ্যের অডিও ফাঁসের অভিযোগ খতিয়ে দেখতে তিন সদস্য বিশিষ্ট তদন্ত কমিটি গঠন করা হয়েছে। তদন্ত প্রতিবেদন পেলে যথাযথ ব্যবস্থা গ্রহণ করবে কর্তৃপক্ষ।’
এই রকম সংবাদ আরো পেতে হলে এই লেখার উপরে ক্লিক করে আমাদের ফেসবুক ফ্যান পেইজে লাইক দিয়ে সংযুক্ত থাকুন। সংবাদটি সম্পর্কে মন্তব্য করতে হলে এই পেইজের নীচে মন্তব্য করার জন্য ঘর পাবেন