ইরাক-ইরান শক্তিশালী ভূমিকম্পে নিহতের সংখ্যা বেড়ে ৪৫০
ইরাক-ইরান সীমান্তে ৭.৩ উচ্চমাত্রার শক্তিশালী ভূমিকম্পে এখন পর্যন্ত ৪৫০ জন মারা গেছেন। রবিবারে আঘাত হানা ভূমিকম্পের একদিন পেরিয়ে গেলেও হতাহতের সংখ্যা বেড়েই চলেছে।
এ ব্যাপারে ইরানের রাষ্ট্রীয় টিভি চ্যানেল জানায়, এখন পর্যন্ত নিহতের সংখ্যা বেড়ে ৪৫০ তে এসে দাঁড়িয়েছে। আহত হয়ছেন আরও ৭ হাজার জন। এখনো অনেক লোক নিখোঁজ রয়েছে। অনুসন্ধানী দল উদ্ধার এখনো তৎপড়তা চালিয়ে যাচ্ছে। এদিকে উভয় দেশে সাত হাজারের বেশি মানুষ আহত হয়েছে। এ ছাড়া বহু মানুষ ধ্বংসস্তূপের নিচে আটকা পড়েছে। হতাহতের সংখ্যা বাড়তে পারে। ঘরবাড়িগুলো মারাত্মক ক্ষতিগ্রস্ত হওয়ায় তীব্র শীতে গৃহহীন হয়ে পড়েছে হাজার হাজার মানুষ। পরাঘাতের আশঙ্কায় প্রায় ৭০ হাজার মানুষ রাস্তা ও আশপাশের পার্কে অবস্থান নিয়েছে। ভূমিকম্পটি যখন আঘাত হানে, তখন অনেক মানুষই রাতের খাবার খাচ্ছিল।
ইরানের পশ্চিমাঞ্চলীয় প্রদেশ কেরমানশাহ ও ইরাকের উত্তরাঞ্চলীয় কুর্দি জনগোষ্ঠী অধ্যুষিত সুলাইমানিয়া প্রদেশে স্থানীয় সময় রবিবার রাত ৯টা ২১ মিনিটে ভূমিকম্পটি আঘাত হানে। ইরাকের রাজধানী বাগদাদসহ দেশটির বিভিন্ন অঞ্চল এবং ইরানের অন্তত ১৪টি প্রদেশেও এ ভূকম্পন অনুভূত হয়। এটি মাটির নিচে ২৩ দশমিক ২ কিলোমিটর গভীর পর্যন্ত আঘাত করে। ফলে ভূমিকম্পটি পার্শ্ববর্তী দেশ কুয়েত, ইসরায়েল ও তুরস্কেও অনুভূত হয়। ইরানের ভূকম্পনবিদ্যা কেন্দ্র জানিয়েছে, মূল ভূমিকম্পটির পর তাঁরা ১১৮টি পরাঘাত (আফটার শক) রেকর্ড করেছেন। এ ছাড়া কয়েক ঘণ্টার ব্যবধানে পৃথক দুটি শক্তিশালী ভূমিকম্প আঘাত হানে জাপান ও মধ্য আমেরিকার দেশ কোস্টারিকায়।
যুক্তরাষ্ট্রের ভূতাত্ত্বিক জরিপ সংস্থা (ইউএসজিএস) জানিয়েছে, ইরান-ইরাকের সীমান্তবর্তী ভূমিকম্পটির মাত্রা ছিল রিখটার স্কেলে ৭ দশমিক ৩। তবে ইরানের আবহাওয়া বিভাগ বলেছে, এর মাত্রা ছিল ৬ দশমিক ৫। ভূমিকম্পটির উৎপত্তিস্থল ছিল কুর্দিস্তান অঞ্চলের সুলাইমানিয়া প্রদেশের পেঞ্জভিনে। উৎপত্তিস্থলটি দুই দেশের প্রধান সীমান্তরেখার একেবারেই কাছে এবং কুর্দিস্তানের হালাবজা শহর থেকে ৩০ কিলোমিটার দক্ষিণ-পূর্বে। ইউএসজিএস জানায়, উৎপত্তিস্থলের ১০০ কিলোমিটারের (৬০ মাইল) মধ্যে প্রায় এক কোটি ৮০ লাখ মানুষের বসবাস রয়েছে।
ভূমিকম্পটির কারণে সবচেয়ে বেশি মানুষ নিহত হয়েছে ইরানের পশ্চিমাঞ্চলীয় কেরমানশাহ প্রদেশে। শুধু এ প্রদেশে আহতের সংখ্যা প্রায় ছয় হাজার। ইরানের একটি সাহায্য সংস্থা জানিয়েছে, ভূমিকম্পের পর অন্তত ৭০ হাজার মানুষ আশ্রয়হীন হয়ে পড়ে।
সরকারি কর্মকর্তারা জানিয়েছেন, ইরানের সীমান্তবর্তী দুর্গম এলাকাগুলোতে অনুসন্ধান ও উদ্ধার অভিযান পুরোপুরি শুরু হলে মৃত্যুর সংখ্যা বাড়তে পারে। ইরানের রাষ্ট্রীয় টেলিভিশনে বলা হয়েছে, ভূমিকম্পে সীমান্তবর্তী গ্রামগুলোতে মাটির ইটের তৈরি ঘরবাড়িগুলো মারাত্মকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। উদ্ধারকর্মীরা ধসে পড়া ভবনের নিচ থেকে হতাহতদের বের করে আনার কাজ চালিয়ে যাচ্ছে। ভয়াবহ এ ঘটনায় ইরানের সর্বোচ্চ নেতা আয়াতুল্লাহ আলী খামেনি গভীর শোক ও সমবেদনা জানিয়েছেন এবং সরকারের সব সংস্থাকে ক্ষতিগ্রস্তদের পাশে দাঁড়ানোর নির্দেশ দিয়েছেন। ভূমিকম্পে ক্ষতিগ্রস্ত দুটি দেশের সীমান্ত এলাকাগুলোর বিদ্যুৎ সংযোগ বিচ্ছিন্ন হয়ে পড়ে।
রবিবার রাতের ভূমিকম্পটিতে ইরাকে মারা যায় অন্তত সাতজন। রাজধানী বাগদাদে ভূমিকম্প হওয়ার সঙ্গে সঙ্গে আতঙ্কে ঘরবাড়ি ছেড়ে রাস্তায় বেরিয়ে পড়ে লাখ লাখ মানুষ। মারাত্মকভাবে আতঙ্ক ছড়িয়ে পড়ে যুদ্ধ ও বোমা হামলার তিক্ত অভিজ্ঞতার শিকার এই শহরের মানুষের মধ্যে।
বাগদাদের মাজিদা আমির নামে তিন সন্তানের এক জননী রয়টার্সকে বলেন, ‘আমি আমার বাচ্চাদের সঙ্গে বসে রাতের খাবার খাচ্ছিলাম। হঠাৎ মনে হলো, ভবনটি বাতাসের মধ্যে নাচতেছে। আমি প্রথমে ভেবেছিলাম, এটি বড় ধরনের কোনো বোমা হবে। কিন্তু পরে আমি চারদিক থেকেই ভূমিকম্প বলে চিৎকার শুনতে পেলাম। ’
ভূমিকম্পে ইরাকে সবচেয়ে বেশি মানুষ হতাহত হয়েছে কুর্দিস্তানের সুলাইমানিয়া প্রদেশের সারপোল-ই জাহাব শহর। এ শহরটি সীমান্ত থেকে মাত্র ১৫ কিলোমিটার দূরে। কুর্দি আধাস্বায়ত্তশাসিত সরকারের জরুরি সেবা সংস্থার প্রধান পির হোসাইন কুলিভান্দ বলেন, শহরটির প্রধান হাসপাতালটি মারাত্মকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। আহত হয়ে হাসপাতাল ছাড়তে বাধ্য হয় রোগীরা।
কুর্দি পাহাড়ি এলাকায় অনেক ঘড়বাড়ি ইটের কাদায় পরিণত হয়েছে। সেখানে উদ্ধারকাজ চালানো ঝুঁকিপূর্ণ হয়ে উঠেছে। কুলিভান্দ বলেন, ভূমিধসের কারণে উদ্ধার তৎপরতায় বিঘ্ন ঘটছে। কুর্দিস্তানে সারপোল-ই জাহাব শহরে সবচেয়ে বেশি হতাহত হলেও ধ্বংসযজ্ঞের দিক থেকে সবচেয়ে বেশি ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে কুর্দির দারবানদিখান শহর। এ প্রসঙ্গে কুর্দি আঞ্চলিক সরকারের স্বাস্থ্যমন্ত্রী রেখওয়াত হামা রাশিদ বলেন, পরিস্থিতি খুবই গুরুতর। ইরাকের কেন্দ্রীয় সরকারের স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয় বলেছে, ভূমিকম্পে ক্ষতিগ্রস্ত কুর্দি অঞ্চলে ৩২১ মানুষ আহত হয়েছে। এরই মধ্যে তুরস্ক সেখানে সাহায্য পাঠিয়েছে।
আঞ্চলিক রাজধানী ইরবিলে বিবিসির রামি রুহায়েব বলেন, ভূমিকম্প চলাকালে এক মিনিটেরও বেশি সময় ধরে ঝাঁকুনি অনুভূত হয়। এটা কী তা বুঝতে আমার কয়েক সেকেন্ড লাগে। আমি নিশ্চিত ছিলাম না, এটা ছোটখাটো কোনো ঝাঁকুনি নাকি আমার কল্পনা। কিন্তু আমার ভবনটি যখন এ মাথা থেকে ও মাথা পর্যন্ত দোলা শুরু করল, তখন আমার ভুল ভাঙতে দেরি হয়নি।
ইরানে কেন ঘন ঘন ভূমিকম্প : এর আগে ইরানে ২০০৩ সালে ৬ দশমিক ৬ মাত্রার ভূমিকম্পে ২৬ মানুষের মৃত্যু হয়েছিল। ওই ভূমিকম্পে ইরানের দক্ষিণ-পূর্বের ঐতিহাসিক বাম শহর ধ্বংসস্তূপে পরিণত হয়। এ ছাড়া ২০১২ সালের পর ইরানে এটাই সবচেয়ে বড় প্রাণঘাতী ভূমিকম্প। তবে ২০১৭ সালের এটি ইরানের ৭ বা তার চেয়ে বেশি মাত্রার ষষ্ঠ ভূমিকম্প। ভূতত্ত্ববিদরা বলছেন, অ্যারাবিয়া ও ইউরোশিয়া টেকটোনিক প্লেট দুটোর মধ্যে সংঘর্ষের কারণে ঘন ঘন সেখানে ভূমিকম্প হয়।
একই দিন জাপান ও কোস্টারিকায় আরো দুই ভূমিকম্প : ইরান-ইরাকে ভূমিকম্পের কয়েক ঘণ্টা পরই জাপানে ৫ দশমিক ৮ মাত্রার ভূমিকম্প অনুভূত হয়। জাপানের প্রশান্ত মহাসাগরীয় উপকূল ক্যামিয়াশ শহরের দক্ষিণ-পূর্বে ভূমিকম্পটি আঘাত হানে। তবে বড় ধরনের ক্ষয়ক্ষতির খবর পাওয়া যায়নি। অন্যদিকে কোস্টারিকায় জাপানের কিছু আগে ৬ দশমিক ৫ মাত্রার ভূমিকম্প আঘাত হানে। দেশটির গণনিরাপত্তাবিষয়ক মন্ত্রণালয় জানিয়েছে, এতে দুই ব্যক্তি গুরুতরভাবে আহত হয়েছে। এই ভূমিকম্পের কয়েক মিনিট পর পরাঘাত হিসেবে ৫ দশমিক ২ মাত্রার আরেকটি ভূমিকম্প হয়।
এই রকম সংবাদ আরো পেতে হলে এই লেখার উপরে ক্লিক করে আমাদের ফেসবুক ফ্যান পেইজে লাইক দিয়ে সংযুক্ত থাকুন। সংবাদটি সম্পর্কে মন্তব্য করতে হলে এই পেইজের নীচে মন্তব্য করার জন্য ঘর পাবেন