এক দশকেও ভোজ্যতেলে ভিটামিন ‘এ’ নিশ্চিত হয়নি
ভোজ্যতেলে ভিটামিন ‘এ’ মিশ্রণ বাধ্যতামূলক করা হয় ২০১৩ সালে। এ সংক্রান্ত একটি আইনও করে সরকার। সেই আইন অনুযায়ী, ভিটামিন ‘এ’ না মিশিয়ে কোনো ভোজ্যতেল বাজারজাতকরণের সুযোগ নেই কোম্পানিগুলোর। কিন্তু বাস্তবতা ভিন্ন। এখনো অনেক ভোজ্যতেল বিপণন হচ্ছে ভিটামিন ছাড়াই। আইন প্রণয়নের প্রায় এক দশক পরেও ৪৭ শতাংশ খোলা তেল ও ১৩ শতাংশ বোতলজাত তেলে মিলছে না ভিটামিনের উপস্থিতি (জানুয়ারি ২০১৮-জুলাই ২০২১ এর হিসাব)।
সব দিক বিবেচনায় গত ৩১ জুলাই থেকে বাজারে খোলা সয়াবিন ও আগামী ৩১ ডিসেম্বর থেকে খোলা পাম তেল বিক্রি নিষিদ্ধ করার ঘোষণা দিয়েছিল শিল্প মন্ত্রণালয়। কিন্তু জুলাই থেকেই বিশ্ববাজারে তেলের দামে ব্যাপক অস্থিরতা দেখা দেয়। এর প্রভাবে অস্থিতিশীল হয়ে ওঠে দেশে ভোজ্যতেলের বাজারও। সেজন্য এ সিদ্ধান্ত বাস্তবায়ন থমকে আছে। তবে উভয় তেলের ক্ষেত্রেই (পাম ও সয়াবিন) খোলা বিক্রি বন্ধ হচ্ছে আগামী ৩১ ডিসেম্বর।
২০১৩ সালে ভোজ্যতেলে ভিটামিন ‘এ’ সমৃদ্ধকরণ আইন পাস করে সরকার। এ আইন অনুযায়ী নির্ধারিত মাত্রায় ভোজ্যতেল ভিটামিন ‘এ’ সমৃদ্ধ করতে হবে। তেলে ভিটামিনের উপস্থিতি না থাকলে শাস্তির বিধানও আছে। ভোক্তার পুষ্টিমান উন্নয়নের বিষয়টি মাথায় রেখেই মানবস্বাস্থ্যের জন্য উপকারী ভিটামিন ‘এ’ মেশানোর উদ্যোগ নিয়েছিল সরকার।
স্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞরা বলছেন, দেহের জন্য প্রয়োজনীয় পুষ্টির চাহিদা পূরণ করতে হলে ভিটামিন প্রয়োজন। ভিটামিন শ্রেণিকরণে প্রথমটি ‘এ’। যার অভাবে দেখা দিতে পারে নানা ধরনের শারীরিক জটিলতা।
ঢাকার ফরাজী হাসপাতালের ক্লিনিক্যাল ডায়েটিশিয়ান ও পুষ্টিবিদ রুবাইয়া পারভীন রীতি বলেন, শিশুদের বেঁচে থাকা, তাদের স্বাভাবিক বৃদ্ধি ও দৃষ্টিশক্তির জন্য ভিটামিন ‘এ’ সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ উপাদান। ভিটামিন ‘এ’ শিশুদের চোখের স্বাভাবিক দৃষ্টিশক্তি ও শরীরের স্বাভাবিক বৃদ্ধিতে সহায়ক ভূমিকা পালন করে। উপরন্তু বিভিন্ন রোগের বিরুদ্ধে তৈরি করে প্রতিরোধ ক্ষমতা।
সন্তান প্রসবের পর মা যখন শিশুকে বুকের দুধ খাওয়ান তখন মা যে খাওয়া খান, সেখানে পুষ্টিকর খাবার থাকা গুরুত্বপূর্ণ। এই পুষ্টিকর খাবারের মধ্যে ভিটামিন ‘এ’ জাতীয় খাবারটা অবশ্যই থাকতে হবে। এছাড়া শিশুদের ভিটামিন ‘এ’ সরাসরি না দিয়ে খিচুড়ি কিংবা রান্নার সঙ্গে দেওয়া যেতে পারে। যেমন খিচুড়ির সঙ্গে গাজর কিংবা একটু তেল ব্যবহার করা যেতে পারে যেন শিশু খুব সহজে এটি গ্রহণ করতে পারে।’
তিনি আরও বলেন, ‘শিশু ভিটামিন ‘এ’ জাতীয় খাবার থেকে বঞ্চিত হলে তাদের শরীরে নানা ধরনের রোগ বালাই দেখা দিতে পারে। যেমন রাতকানা, চোখের সমস্যা কিংবা চোখের জ্যোতি কমে যেতে পারে। ভিটামিন ‘এ’ ক্যানসার প্রতিরোধে অনেক বড় ভূমিকা পালন করে। তেলের সঙ্গে ভিটামিন সাপ্লিমেন্ট বা সংযোজিত করা খাবার শিশুদের ভিটামিন ‘এ’র অভাব পূরণ করতে সহায়তা করে।
ভোজ্যতেলে ভিটামিন মেশানো হচ্ছে কি না সেটা তদারকির দায়িত্ব বাংলাদেশ স্ট্যান্ডার্ডস অ্যান্ড টেস্টিং ইনস্টিটিউশনের (বিএসটিআই)। বিএসটিআই আইনেও ভোজ্যতেলের জন্য ভিটামিন মেশানো বাধ্যতামূলক। সেজন্য কোনো কোম্পানি তেল পরিশোধন, আমদানি অথবা সরবরাহ করতে চাইলে সে ভোজ্যতেল পরীক্ষা করে ভিটামিন ‘এ’ সমৃদ্ধ ভোজ্যতেল বিক্রির লাইসেন্স দেয় সংস্থাটি। এ পর্যন্ত ১১৭টি প্রতিষ্ঠান এ লাইসেন্স পেয়েছে।
অন্যদিকে নিয়মিত সার্ভিলেন্সের অংশ হিসেবে প্রতি মাসে দেশের বিভিন্ন এলাকা থেকে ৭৫টি নমুনা সংগ্রহ করে পরীক্ষা করা হয়। এর মধ্যে কোনো কোম্পানি বা প্রতিষ্ঠানের তেলে ভিটামিনের মাত্রা কম-বেশি থাকলে সে প্রতিষ্ঠানকে শোকজ করার পাশাপাশি আইনত ব্যবস্থা নেওয়ার বিধান রয়েছে।
বাংলাদেশে ভিটামিন ‘এ’ সমৃদ্ধকরণের মাত্রা ডব্লিউএইচও, এফএও এবং ন্যাশনাল একাডেমি অব সায়েন্সের মাধ্যমে করা গবেষণা অনুযায়ী ১৫ থেকে ৩০ পিপিএম নির্ধারিত। বিএসটিআইয়ের পাশাপাশি স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয় থেকেও আইনটিকে ২০১৬ সালের ৩ এপ্রিল ‘মোবাইল কোর্ট আইন, ২০০৯’-এর তফসিলভুক্ত করা হয়েছে। যদিও দেশে ভিটামিন না মেশানোর কারণে কোনো প্রতিষ্ঠানকে জরিমানা অথবা আইনের আওতায় আনতে দেখা যায় না খুব একটা।
এ বিষয়ে বিএসটিআইয়ের উপ-পরিচালক (সিএম) রিয়াজুল হক বলেন, ‘বোতলজাত তেলে ভিটামিনের মাত্রা ঠিকঠাক পাওয়া যায়। প্রায় ৯৯ শতাংশ ঠিক থাকে। দু-একটা সমস্যা থাকলে তাদের শোকজ করা হয়। তবে সমস্যা হয় ড্রামের খোলা তেলে। সেগুলোতে সমস্যা হলেও ধরা যায় না। কারণ তাদের উৎপাদনকারীর নাম-ঠিকানা থাকে না। এজন্য খোলা তেল বিক্রি বন্ধ হচ্ছে। এরপর আর এ সমস্যা খুব বেশি থাকবে না।
দেশে ভোজ্যতেলের ৬৫ শতাংশই বিক্রি হয় খোলা বা লুজ আকারে। এসব ভোজ্যতেলে ভেজালের প্রমাণ রয়েছে বাংলাদেশ নিরাপদ খাদ্য কর্তৃপক্ষের (বিএফএসএ) কাছে। রয়েছে বোতলজাত তেলেও ভিটামিনের ঘাটতির তথ্য।
বিএসটিআইয়ের বিগত সাড়ে তিন বছরের (জানুয়ারি ২০১৮ থেকে জুলাই ২০২১) ভিটামিন পরীক্ষার তথ্য বিশ্লেষণ করে বিএফএসএ বলছে, এসময় ৫২০টি পিইটি বোতল ভোজ্যতেল পরীক্ষা করে ভিটামিনের মাত্রা ঠিক পাওয়া গেছে ৪৫৭টিতে। অর্থাৎ, ১৩ শতাংশ বোতলে ভিটামিন সঠিক মাত্রায় ছিল না।
তবে উদ্বেগজনক তথ্য হচ্ছে, এসময় ৩৯৩টি খোলা তেলের নমুনা পরীক্ষা করে দেখা গেছে, এর মধ্যে ২০৭টি নমুনায় ভিটামিন রয়েছে। নেই ১৮৬টিতে। অর্থাৎ, ৪৭ দশমিক ৩৩ শতাংশ তেলে ভিটামিন ‘এ’র উপস্থিতি যথাযথ মাত্রায় ছিল না।
এ বিষয়ে বিএফএসএর সদস্য (খাদ্য শিল্প ও উৎপাদন) অধ্যাপক ড. মো. আব্দুল আলীম বলেন, খোলা তেলে যে ভিটামিন মেশানো হচ্ছে না সেটাও নয়। এসব খোলা বিক্রির কারণে আলো ও সূর্যের তাপে ভিটামিন রিডাকশন হচ্ছে। সেজন্য ক্রেতারা যখন কিনছেন তারা ভিটামিন পাচ্ছেন না। ফলে বোতলজাত তেল সেক্ষেত্রে ভালো থাকছে না।
তিনি বলেন, খোলা তেল এখন বড় সমস্যা। শুধু ভিটামিনের বিষয় নয়, সয়াবিন ও পাম তেল আলাদা নামে বিক্রি হলেও শুধু সয়াবিন বা শুধু পাম তেল হিসেবে কোনো তেল পরীক্ষায় মিলছে না। সবই সয়াবিন ও পাম তেলের মিশ্রণ। এগুলোতে ভিটামিনের মতো ফ্যাট (ফ্যাটি অ্যাসিড) ও মানের সমস্যা মিলছে।
ড. মো. আব্দুল আলীম বলেন, বর্তমানের তেলের বাজারে অস্থিরতার কারণে এসব নিয়ন্ত্রণে অভিযান চালানো হচ্ছে না। তাহলে বাজার আরও অস্থিতিশীল হয়ে উঠবে। বিষয়গুলো শিথিল রয়েছে।
এদিকে এ বিষয়ে তেল পরিশোধন ও বাজারজাতকারী এক প্রতিষ্ঠানের ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তা নাম প্রকাশ না করার শর্তে বলেন, মিল থেকে সব তেলে ভিটামিন মিশিয়ে বাজারজাত করা হয়। তবে পাইকারি বাজারে এসে পাম ও সয়াবিনের মিশ্রণে সেটা খাঁটি থাকে না। খাতুনগঞ্জ ও মৌলভীবাজারের যেসব ব্যবসায়ী ড্রামে তেল কেনাবেচা করেন তারাই এই ভেজালের জন্য দায়ী। পাশাপাশি অনেক কোম্পানি বাল্ক আকারে তেল কিনে পুনরায় তাদের ব্র্যান্ডের নামে নতুন মোড়কে তেল বাজারজাত করছে, তাদের তেলে সমস্যা রয়েছে। কিছু আমদানিকারকও ভিটামিন ছাড়া তেল আমদানি করছেন নামে-বেনামে।
জানা যায়, দেশে প্রতি বছর প্রায় ২২ লাখ টন ভোজ্যতেলের চাহিদা রয়েছে। এই তেলের ৯৫ শতাংশই আমদানিনির্ভর। অপরিশোধিত তেল এবং অয়েল সিড আমদানি হয় মূলত আর্জেন্টিনা, ব্রাজিল, মালয়েশিয়া ও ইন্দোনেশিয়া থেকে, যা হাতেগোনা কয়েকটি কোম্পানি পরিশোধন করে বাজারে সরবরাহ করে।
এই রকম সংবাদ আরো পেতে হলে এই লেখার উপরে ক্লিক করে আমাদের ফেসবুক ফ্যান পেইজে লাইক দিয়ে সংযুক্ত থাকুন। সংবাদটি সম্পর্কে মন্তব্য করতে হলে এই পেইজের নীচে মন্তব্য করার জন্য ঘর পাবেন