কথা রাখেননি মন্ত্রীরা, আবার আন্দোলনে সম্পাদকরা
সম্পাদকদের সঙ্গে বৈঠকে আশ্বাস দেয়া হয়েছিল, ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনে উদ্বেগ নিয়ে মন্ত্রিসভায় হবে আলোচনা৷ কিন্তু আশ্বাস অনুযায়ী কাজ না হওয়ায় আবার আন্দোলনের ডাক দিয়েছে সম্পাদক পরিষদ৷
ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনের বিতর্কিত ৯টি ধারা সংশোধনের দাবিতে সোমবার ঢাকায় জাতীয় প্রেসক্লাবের সামনে সম্পাদক পরিষদ মানববন্ধন করবে৷ সকাল ১১টায় শুরু হবে এই মানববন্ধন৷ বিভিন্ন দৈনিকের সম্পাদকরাই শুধু অংশ নেবেন এতে৷
শনিবার এক সংবাদ সম্মেলনে লিখিত বক্তব্য পড়ে শোনান পরিষদের সদস্য ও দৈনিক ভোরের কাগজের সম্পাদক শ্যামল দত্ত৷ সম্পাদক পরিষদ মনে করে, ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনের মোট ৯টি ধারা স্বাধীন সাংবাদিকতা ও মতপ্রকাশের স্বাধীনতাকে ভীষণভাবে ক্ষতিগ্রস্ত করবে৷ তাই সম্পাদক পরিষদ কয়েক দিনের মধ্যে শুরু হতে যাওয়া বর্তমান সংসদের শেষ অধিবেশনেই এই ধারাগুলো সংশোধন চায়৷
সংবাদ সম্মেলনে সম্পাদক পরিষদের সাধারণ সম্পাদক ও ডেইলি স্টার সম্পাদক মাহফুজ আনাম বলেন, ‘‘আমরা আইনটি বাতিল চাইনি৷ কতগুলো বিশেষ ধারার আমূল পরিবর্তন চেয়েছি৷ এই পরিবর্তন সম্ভব৷ আমরা আশা করব, ওই ধারাগুলো সংশোধন করে আইনটি সংশোধন করা হবে৷”
আইনটি কার্যকর হওয়ার আগে থেকেই ধারাগুলো নিয়ে আপত্তি জানিয়ে আসছিলেন সাংবাদিকরা৷ এ নিয়ে তাদের সঙ্গে বিলটি সংসদে পাশ হওয়ার আগেও সংসদীয় কমিটির সঙ্গে একাধিকবার বেঠক হয়৷ সেসব বৈঠকেও সাংবাদিকদের উদ্বেগের কথা বিবেচনার আশ্বাস দেয়া হয়, কিন্তু তাতে কেনো ফল আসেনি৷
বিলটি সংশোধন ছাড়াই সংসদে পাশ হলে ২৯ সেপ্টেম্বর মানববন্ধনের ঘোষণা দেয় সম্পাদক পরিষদ৷ তখন তথ্যমন্ত্রী হাসানুল হক ইনু কর্মসূচি স্থগিত করে সম্পাদক পরিষদকে আলোচনায় অংশ নেওয়ার অনুরোধ জানান৷
এরপর তথ্যমন্ত্রীসহ সরকারের তিন মন্ত্রী ও প্রধানমন্ত্রীর একজন উপদেষ্টা সম্পাদক পরিষদের সঙ্গে আলোচনাও করেন৷ আলোচনায় তিন মন্ত্রীর পক্ষ থেকে প্রতিশ্রুতি দেয়া হয়েছিল, সম্পাদক পরিষদের উদ্বেগ মন্ত্রিসভার বৈঠকে তোলা হবে এবং মন্ত্রিসভার অনুমোদন পেলে এ নিয়ে আরও আলোচনা করা হবে৷ কিন্তু গত দুটি মন্ত্রিসভার বৈঠকে এ নিয়ে কোনো আলোচনা হয়নি৷ বরং, এরমধ্যে আইনটি রাষ্ট্রপতি অনুমোদন দেন এবং কার্যকরও হয়৷
আইনটি সংসদে পাশ হয় ১৯ সেপ্টেম্বর৷ এরপর রাষ্ট্রপতি ৮ অক্টোবর এই বিলে সম্মতি দিলে ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনটি কার্যকর হয়৷ এবং এরইমধ্যে এই আইনে মামলা দায়ের করাও শুরু হয়েছে৷
সম্পাদক পরিষদ মোট সাত দফা দাবি জানিয়েছে সরকারের কাছে-
১. সংবাদমাধ্যমের স্বাধীনতা ও বাকস্বাধীনতা সুরক্ষার জন্য ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনের ৮, ২১, ২৫, ২৮, ২৯, ৩১, ৩২, ৪৩ ও ৫৩ ধারা অবশ্যই যথাযথভাবে সংশোধন করতে হবে৷
২. এসব সংশোধনী বর্তমান সংসদের শেষ অধিবেশনেই করতে হবে৷
৩. পুলিশ বা অন্য কোনো সংস্থার মাধ্যমে কোনো সংবাদমাধ্যম প্রতিষ্ঠানে তল্লাশি চালানোর ক্ষেত্রে তাদের শুধু নির্দিষ্ট বিষয়বস্তু আটকে দেওয়ার অনুমতি দেওয়া যাবে, কিন্তু কোনো কম্পিউটার ব্যবস্থা (নেটওয়ার্ক) বন্ধ করার অনুমতি দেওয়া যাবে না৷ তারা শুধু তখনই প্রকাশের বিষয়বস্তু আটকাতে পারবে, যখন সংশ্লিষ্ট সংবাদ প্রতিষ্ঠানের সম্পাদকের সঙ্গে আলোচনা করে কেন ওই বিষয়বস্তু আটকে দেওয়া উচিত, সে বিষয়ে যৌক্তিকতা প্রমাণ করতে পারবে৷
৪. কোনো সংবাদমাধ্যম প্রতিষ্ঠানের কোনো কমপিউটার ব্যবস্থা আটকে দেয়া বা জব্দ করার ক্ষেত্রে অবশ্যই উচ্চ আদালতের আগাম নির্দেশ নিতে হবে৷
৫. সংবাদমাধ্যমের পেশাজীবীদের সাংবাদিকতার দায়িত্বের সঙ্গে সংশ্লিষ্ট অপরাধের ক্ষেত্রে প্রথমেই আদালতে হাজির হওয়ার জন্য তাঁদের বিরুদ্ধে সমন জারি করতে হবে (যেমনটা বর্তমান আইনে আছে) এবং সংবাদমাধ্যমের পেশাজীবীদের কোনো অবস্থাতেই পরোয়ানা ছাড়া ও যথাযথ আইনি প্রক্রিয়া অনুসরণ ছাড়া আটক বা গ্রেপ্তার করা যাবে না৷
৬. সংবাদমাধ্যমের পেশাজীবীর দ্বারা সংঘটিত অপরাধের ক্ষেত্রে তাঁর বিরুদ্ধে মামলা দায়েরের গ্রহণযোগ্যতা আছে কি না, তার প্রাথমিক তদন্ত প্রেস কাউন্সিলের মাধ্যমে করা উচিত৷ এই লক্ষ্যে প্রেস কাউন্সিলকে যথাযথভাবে শক্তিশালী করা যেতে পারে৷
৭. এই সরকারের পাস করা তথ্য অধিকার আইনকে দ্ব্যর্থহীনভাবে ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনের ওপর প্রাধান্য দেওয়া উচিত৷ ওই আইনে নাগরিক ও সংবাদমাধ্যমের জন্য যেসব স্বাধীনতা ও অধিকার নিশ্চিত করা হয়েছে, সেগুলোর সুরক্ষা অত্যাবশ্যক৷
ভোরের কাগজ সম্পাদক শ্যামল দত্ত ডয়চে ভেলেকে বলেন, ‘‘তথ্যমন্ত্রী আমাদের ফোন দিয়ে বলেছিলেন, আপানারা মানববন্ধন কর্মসূচি স্থগিত করেন, আমরা বিষয়টি নিয়ে আলোচনা করবো৷ আমাদের সঙ্গে তাঁরা আলোচনা করলেন এবং সিদ্ধান্ত নিলেন যে আমাদের যে উদ্বেগের বিষয়গুলো, সেগুলো তারা কেবিনেট মিটিং-এ জানাবেন৷ কিন্তু দুর্ভাগ্যের বিষয় যে এরই মধ্যে কেবিনেটের দু’টি মিটিং হয়ে গেছে৷ সেখানে তারা বিষয়গুলো উত্থাপন করেননি৷ এমনকি তাঁরা কেন করেননি, সেটুকু জানানোর সৌজন্যতাও তাঁরা দেখাননি৷ এরমধ্যে আমরা দেখলাম মহামান্য রাষ্ট্রপতি বিলে সম্মতিও দিয়ে দিলেন৷ আর আগামীতেও যে তাঁরা বিষয়টি কেবিনেটে উত্থাপন করবেন, তাও আমাদের জানাননি৷ এই পরিস্থিতিতে আমরা আমাদের স্থগিত কর্মসূচি পালনের সিদ্ধান্ত নিয়েছি সোমবার সকাল ১১টায় প্রেসক্লাবের সামনে৷ একই কর্মসূচিতে শুধু সম্পাদকরাই অংশ নেবেন৷”
তিনি বলেন, ‘‘আমাদের সঙ্গে আইন, তথ্য ও তথ্য যোগাযোগ প্রযুক্তি মন্ত্রী এই তিনজন মন্ত্রী ছাড়াও প্রধানমন্ত্রীর তথ্য উপদেষ্টা ইকবাল সোবহান চৌধুরীও বসেছিলেন৷ তাঁরা সুনির্দিষ্টভাবে ডায়ালগের কথা বলেছিন৷ কিন্তু পরে আর তা দেখলাম না৷”
সংবাদ-এর ভারপ্রাপ্ত সম্পাদক খন্দকার মুনিরুজ্জামান ডয়চে ভেলেকে বলেন, ‘‘মন্ত্রীরা যখন মন্ত্রিসভার বৈঠকে আমাদেও দাবিগুলো তুলে ধরার কথা বলেন, তখন সম্পাদক পরিষদের সাধারণ সম্পাদক, ডেইলি স্টার সম্পাদ মাহফুজ আনাম জানতে চান এর আগে যদি রাষ্ট্রপতি বিলে সম্পতি দিয়ে ফেলেন তাহলে কী হবে৷ জবাবে তখন আইনমন্ত্রী বলেছিলেন, এটা কোনো সমস্যা নয়, রাষ্ট্রপতি সম্মতি দিলে এটা আইনে পরিণত হলেও এটা সরকার যদি চায় তাহলে সংশোধন করা যাবে৷”
তিনি বলেন, ‘‘আরো বলা হল, আমাদের সঙ্গে আরেকটা বৈঠক হবে৷ কিন্তু এরমধ্যে আমরা দেখলাম আইনে রাষ্ট্রপতি সম্মতি দিয়েছেন৷ আইনটি কার্যকর হয়ে গেল৷ আমাদের সঙ্গে মন্ত্রীরা তাঁদের দেয়া কথা রাখেননি৷”
তিনি বলেন, ‘‘আমরা আইনটির বিরুদ্ধে নয়৷ আইনের প্রয়োজন আছে৷ কিন্তু আইনের যেসব ধারা স্বাধীন ও অনুসন্ধানী সাংবাদিকতা ও মত প্রকাশের স্বাধীনতার বিরুদ্ধে তার সংশোধন চাই৷”
ডিজিটাল আইনের ৩২ ধারা নিয়ে সাংবাদিকদের সবচেয়ে বেশি আপত্তি৷ এতে বলা হয়েছে, ‘‘যদি কোনো ব্যক্তি ‘দাপ্তরিক গোপনীয়তা আইন-১৯২৩’ এর আওতাভুক্ত কোনো অপরাধ কম্পিউটার, ডিজিটাল ডিভাইস, কম্পিউটার নেটওয়ার্ক, ডিজিটাল নেটওয়ার্ক বা অন্য কোনো ডিজিটাল মাধ্যমে সংঘটিত করে বা করতে সহায়তা করে, তাহলে তিনি সর্বোচ্চ ১৪ বছরের কারাদণ্ড বা ২৫ লাখ টাকা জরিমানা বা উভয় দণ্ডে দণ্ডি হবেন৷”
এই আইনের অধীনে সংঘটিত অপরাধের জন্য পুলিশকে বিনা পরোয়ানায় তল্লাশি, জব্দ ও গ্রেপ্তারের ক্ষমতা দেওয়া হয়েছে৷
সম্পাদক পরিষদের সংবাদ সম্মেলনে উপস্থিত ছিলেন- মানবজমিন পত্রিকার প্রধান সম্পাদক মতিউর রহমান চৌধুরী, নিউএজ সম্পাদক নূরুল কবীর, প্রথম আলো সম্পাদক মতিউর রহমান, ডেইলি স্টার সম্পাদক মাহফুজ আনাম, কালের কণ্ঠ সম্পাদক ইমদাদুল হক মিলন, ভোরের কাগজ সম্পাদক শ্যামল দত্ত, নয়াদিগন্ত সম্পাদক আলমগীর মহিউদ্দীন, সংবাদের ভারপ্রাপ্ত সম্পাদক খন্দকার মুনিরুজ্জামান, করতোয়া সম্পাদক মো. মোজাম্মেল হক, ইনকিলাব সম্পাদক এ এম এম বাহাউদ্দীন, যুগান্তরের ভারপ্রাপ্ত সম্পাদক সাইফুল আলম, বণিক বার্তা সম্পাদক দেওয়ান হানিফ মাহমুদ, ঢাকা ট্রিবিউন সম্পাদক জাফর সোবহান, সমকালের ভারপ্রাপ্ত সম্পাদক মুস্তাফিজ শফি, দ্য ইনডিপেনডেন্ট সম্পাদক এম শামসুর রহমান, ফিন্যান্সিয়াল এক্সপ্রেসের ভারপ্রাপ্ত সম্পাদক শহীদুজ্জামান খান, বাংলাদেশ প্রতিদিন সম্পাদক নঈম নিজাম প্রমুখ৷
-ডয়চে ভেলে
এই রকম সংবাদ আরো পেতে হলে এই লেখার উপরে ক্লিক করে আমাদের ফেসবুক ফ্যান পেইজে লাইক দিয়ে সংযুক্ত থাকুন। সংবাদটি সম্পর্কে মন্তব্য করতে হলে এই পেইজের নীচে মন্তব্য করার জন্য ঘর পাবেন