কলকাতায় হিন্দু-মুসলমানদের নিয়ে ব্যতিক্রমধর্মী আয়োজন!
অমিতাভ ভট্টশালী, কলকাতা থেকে : বহু শতক ধরে পাশাপাশি থাকলেও কলকাতার হিন্দু আর মুসলমান – একে অপরকে কতটা চেনেন? হিন্দুদের নীলষষ্ঠীর উপোষ আর মুসলমানদের মাগরিবের নামাজ কখন হয় সেটা কী প্রতিবেশী অন্য ধর্মের মানুষ জানেন?
গবেষকরা বলছেন – না। একে অপরকে সেভাবে চেনেনই না হিন্দু বা মুসলমানরা। কেন প্রতিবেশী দুই ধর্মের মানুষ একে অপরের কাছে অচেনা? তারই কারণ খুঁজতে, একে অপরের কাছে পরিচিত করতেই কলকাতায় শুরু হয়েছে ‘নো ইওর নেইবার’ বা ‘আপনার প্রতিবেশীকে জানুন’ শিরোনামে একটি নাগরিক কর্মসূচী।
শুক্রবার সন্ধ্যায় সেরকমই এক সভা বসেছিল দক্ষিণ কলকাতার একটি হিন্দুপ্রধান অঞ্চলে। একদল হিন্দু-মুসলমান নারী পুরুষ আলোচনা করছিলেন, হিন্দুদের পুজোতে মুসলমানরা কতটা দূর অবধি যেতে পারেন আর মসজিদে কেন নারীদের প্রবেশাধিকার নেই – এসব নিয়ে।
এক মুসলিম নারী বলছিলেন, তিনি হিজাব পরে ট্রেনে যাতায়াত করার সময়ে সহযাত্রীদের কীরকম প্রতিক্রিয়া হয়, আবার সেই তিনিই যখন টি শার্ট-প্যান্ট পরে ট্রেনে ওঠেন, তখন প্রতিক্রিয়াটা কীরকম বদলে যায়।
কোন অজ্ঞতার কারণে ‘হ্যাপি মহরম’ লিখে একে অপরকে মেসেজ পাঠান, উঠেছিল সেই প্রসঙ্গও। অন্য ধর্মাবলম্বী প্রতিবেশীকে জানার, চেনার ওই কার্যক্রমে যোগ দেওয়া এই হিন্দু মুসলমানরা শিক্ষিত, পেশাজীবী, অবসরপ্রাপ্ত এবং ছাত্র-ছাত্রী।
সভায় আসা কয়েকজনের কাছে জানতে চেয়েছিলাম, অন্য ধর্মের বিষয় তারা কতটা জানেন? এক গৃহশিক্ষক শুভ্র দত্ত বলছিলেন, “ছোটবেলায় যে গ্রামে বড় হয়েছি তার অর্ধেক হিন্দু বাকিটা মুসলমান। আমাদের স্কুলের পাশেই মসজিদ ছিল। পরে যে হোস্টেলে থেকেছি, সেখানেও মুসলমানরা ছিল। আমাদের বাড়ির দূর্গাপুজোর সময়ে যেমন মুসলমানদের বাড়িতে মিষ্টি যেত, আবার ঈদের সময়ে রান্না না করা শুকনো সেমাই আসত ওদের বাড়িগুলো থেকে”।
“তবে মুসলমানরা বাড়িতে এলে সেই ঘরটা গোবর দিয়ে নিকনো হত, এটাও রীতি ছিল বাড়িতে”। গবেষক নিলোফার নিশাদের স্কুল থেকে আরম্ভ করে কলেজ-বিশ্ববিদ্যালয় পর্যন্ত বেশীরভাগ বন্ধু-বান্ধবই হিন্দু ধর্মাবলম্বী।
তিনি বলছেন, “কিছু কিছু জানি। যেমন হিন্দুদের নীলষষ্ঠী আর শিবরাত্রির উপোষ। আবার সকালের নামাজকে ফজরের নামাজ, সন্ধেরটাকে মগরিবের নামাজ বলে – বাকিগুলো জানি না। আসলে আমি সম্পূর্ণ নাস্তিক না হলেও কোনও ধর্মের মধ্যেই বেশী ঢুকতে চাই নি কখনও। একবার ওর মধ্যে ঢুকে গেলে বের হওয়া কঠিন”।
হিন্দু গৃহবধূ মালা বিশ্বাস ধর্মাচরণ করেন। বাড়িতে নারায়ণ পুজো হয়। আবার তার মুসলিম বন্ধু-বান্ধবও আছে। তার কাছে প্রশ্ন ছিল, মুসলিমরা কতবার নামাজ পড়েন দিনে?
মিসেস বিশ্বাসের জবাব, “সকালে ও সন্ধেবেলায় আর শুক্রবারে নামাজ হয় জানি। দিনে বোধহয় তিনবার নামাজ পড়েন ওরা। আমার ভুলও হতে পারে”।
শুক্রবারের আলোচনায় এই প্রসঙ্গও উঠেছিল যে জুম্মার নামাজের সময়ে কলকাতার রাস্তায় যেভাবে নামাজ পড়া হয়, তার থেকে তৈরি হয় যানজট, আটকে পড়েন বহু মানুষ।
“ওই জটে আটকে থাকা অনেকেই রাস্তায় নামাজ পড়া নিয়ে কটু মন্তব্য করেন। অনেক নামাজি তিন-চারতলা মসজিদের ওপরের দিকে উঠতে চান না, তাই রাস্তায় নামাজ পড়তে বসে পড়েন। তা নিয়ে মুসলিম সমাজও সচেতন।,” বলছিলেন মুসলিম সম্প্রদায়ের একজন।
জন্মসূত্রে হিন্দু একজন জবাবে বলছিলেন, “এরকম যানজট আর ভিড় তো দূর্গাপুজোর সময়েও হয়। তখন তো কেউ খারাপ মন্তব্য করি না!”
অবসরপ্রাপ্ত সরকারী কর্মী অমর কুমার ঘোষ বলছিলেন, “আমার নিজের জমি বিক্রি করতে চেয়েছিলাম একজন মুসলমানকে। সেটা জানতে পেরে পাড়ার লোক আমাকে ঘিরে ধরে এমন হেনস্থা করে যে বাধ্য হই সেই দলিল পাল্টে ফেলতে। তবে আমি এখন যে ফ্ল্যাটে থাকি, পাশেরটাই একজন মুসলমানের। রাস্তায় দেখা হলে কথা বলি, কিন্তু ওদের বাড়িতে যাওয়া বা একসঙ্গে খাওয়া দাওয়া এখনও করা হয়ে ওঠে নি”।
এক ধর্মের মানুষ যে অন্য ধর্মের মানুষ সম্পর্কে অজ্ঞ, সেটা কোনও সাম্প্রতিক ঘটনা নয়, বলছিলেন প্রেসিডেন্সি বিশ্ববিদ্যালয়ের সমাজতত্ত্বের প্রাক্তন বিভাগীয় প্রধান শমিত কর।
“অনেকে মনে করেন ১৯৪৬ এর দাঙ্গার পর থেকেই দুই সম্প্রদায়ের মধ্যে এই পাঁচিল উঠে গেছে। কিন্তু আমি তা মনে করি না। ১৭৯৩ সালে যখন চিরস্থায়ী বন্দোবস্ত প্রথা চালু করল ব্রিটিশরা, এর শুরু তখন থেকেই। কারণ ওই নতুন জমিদারী ব্যবস্থার সম্পূর্ণ লাভটা উঠিয়েছিলেন বাঙালী হিন্দুরা।
দুটো সম্পূর্ণ আলাদা, কিন্তু সমান্তরাল সামাজিক পৃথিবী তৈরি হয়ে গেল দুই ধর্মের মানুষের মধ্যে। অনেকেই মনে করেন না যে একে অপরকে জানার বা চেনার প্রয়োজন আছে। কিন্তু এটা শহর বা গ্রামের সার্বিক চিত্র না। বহু জায়গা আছে পশ্চিমবঙ্গে, যেখানে মানুষ ভাবেই না যে এ হিন্দু এ মুসলমান”, বলছিলেন অধ্যাপক কর।
গবেষকরা মনে করছেন এই একে অপরকে না জানা, না চেনার কারণেই তৈরি হয় অবিশ্বাস। “এত বড় দুটো সম্প্রদায় এত বছর ধরে পাশাপাশি রয়েছে, কিন্তু একে অপরকে চেনে না, অন্যের বিষয়ে উদাসীন। এর ফলেই কিন্তু সহজে বিভাজন তৈরি করে দেওয়া যায়। এটাকেই আমরা বদলাতে চাইছি – চেনা জানার মাধ্যমে, বন্ধুত্বের মাধ্যমে,” বলছিলেন প্রতীচী ইন্সটিটিউটের গবেষক সাবির আহমেদ।
দীর্ঘদিন ধরে রাজনৈতিক দলগুলো অন্তত প্রকাশ্যে সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতির কথা প্রচার করে আসছে। কিন্তু এখন নাগরিক সমাজকে দুই ধর্মের মানুষদের মধ্যে সম্প্রীতি তৈরির কাজে নামতে হয়েছে – এর অর্থ কী এই যে রাজনৈতিক দলগুলি ব্যর্থ?
অনুষ্ঠানটির এক উদ্যোক্তা সুমন সেনগুপ্ত বলছেন, “কিছুটা ব্যর্থ তো বটেই। আসলে ওপর ওপর সম্প্রীতির কথা বলে কিছু হবে না। মানুষ অন্তর থেকে সাম্প্রদায়িক। অজানার কারণেই তারা আজ সাম্প্রদায়িক”।
‘নো ইওর নেইবার’ কার্যক্রমে এক ধর্মের মানুষ অন্যের ধর্ম সম্পর্কে কতটা জানলেন বা ভুল বোঝাবুঝিগুলো কতটা দূর হল, সেটা এখনই বোঝার কোনও উপায় নেই। এটাও বোঝা সম্ভব নয় যে একেবারে তৃণমূল স্তরের নাগরিক সমাজের এধরণের উদ্যোগ কতটা ফলপ্রসূ হবে।
কিন্তু অনুষ্ঠানটিতে হাজির সকলে একটা কথা স্বীকার করলেন, যে একে অপরকে জানার, চেনার কাজটা শুরু করা খুব দরকার ছিল। – বিবিসি বাংলা।
এই রকম সংবাদ আরো পেতে হলে এই লেখার উপরে ক্লিক করে আমাদের ফেসবুক ফ্যান পেইজে লাইক দিয়ে সংযুক্ত থাকুন। সংবাদটি সম্পর্কে মন্তব্য করতে হলে এই পেইজের নীচে মন্তব্য করার জন্য ঘর পাবেন