কাতার সংকট : এরদোয়ান কি সমাধান করতে পারবেন?
কাতারের সঙ্গে সৌদি নেতৃত্বাধীন জোটের বিরোধ নিরসনে উপসাগরীয় অঞ্চলে দুদিনের সফর শুরু করেছেন তুরস্কের প্রেসিডেন্ট রিসেপ তাইয়েপ এরদোয়ান। রোববার দুদিনের সফরে সৌদি আরব পৌঁছাবেন তিনি।
দুদিনের সফরের প্রথম দিন সৌদি আরবের জেদ্দায় বাদশাহ সালমান বিন আব্দুল আজিজ আল-সউদ ও যুবরাজ মোহাম্মদ বিন সালমান আল-সউদের সঙ্গে সাক্ষাৎ করবেন তিনি। পরে কাতারের সঙ্গে প্রতিবেশী দেশগুলোর সৃষ্ট সংকট সমাধানে মধ্যস্থতাকারী কুয়েতে যাবেন তিনি। সেখানে কুয়েতের আমির শেখ সাবাহ আল-আহমাদ আল-সাবাহর সঙ্গে বৈঠক করবেন তুরস্কের এ প্রেসিডেন্ট।
কিন্তু কাতারের সঙ্গে সৌদি জোটের চলমান সংকট সমাধানের প্রচেষ্টায় তুরস্কের প্রেসিডেন্ট রিসেপ তাইয়েপ এরদোয়ান কী সফল হতে পারবেন কিংবা তার সক্ষমতা কতটুকু?
প্রসঙ্গত, ইরানের সঙ্গে সুসম্পর্ক বজায় রাখা, মিসরের নিষিদ্ধ রাজনৈতিক সংগঠন মুসলিম ব্রাদারহুড ও ফিলিস্তিনি স্বাধীনতাকামী সশস্ত্র সংগঠন হামাসসহ আল-কায়েদা ও বিভিন্ন জঙ্গি সংগঠনকে সমর্থন, অর্থায়ন ও সহায়তার অভিযোগে গত ৫ জুন কাতারের সঙ্গে কূটনৈতিক সম্পর্ক ছিন্ন করে সৌদি জোট।
কূটনৈতিক সম্পর্ক ছিন্নের পর কাতারের সঙ্গে সব ধরনের ফ্লাইট বাতিল করে আকাশ, সমুদ্র ও স্থলপথ বন্ধ করে দেয় সৌদি আরব, সংযুক্ত আরব আমিরাত, বাহরাইন এবং মিসর। মাত্র ১৪ দিনের সময় বেঁধে দিয়ে এই চার দেশ থেকে কাতারি নাগরিকদের নিজ দেশে ফেরত যাওয়ার নির্দেশ দেয়া হয়। একই সময়ের মধ্যে কাতার থেকে নিজেদের দেশের নাগরিকদের ফিরে আসার নির্দেশও আসে।
গত ২২ জুন সংকট নিরসনে কাতারের প্রভাবশালী সংবাদমাধ্যম আল-জাজিরা বন্ধ করাসহ ১৩টি শর্ত দিয়ে দোহাকে ১০দিনের আল্টিমেটাম দেয় সৌদি জোট। তবে শর্ত মানতে অস্বীকৃতি জানিয়েছে দোহা। পরে সম্পর্ক স্বাভাবিক করতে আবারও শর্ত শিথিল করে ছয়টি মূলনীতি জুড়ে দেয়া হয় কাতারকে। সেসবও মানতে অস্বীকৃতি জানায় কাতার।
সংকট শুরুর পর থেকেই মধ্যস্থতাকারীর ভূমিকায় এগিয়ে এসেছে কুয়েত। চলতি মাসের দ্বিতীয় সপ্তাহে মার্কিন পররাষ্ট্রমন্ত্রী রেক্স টিলারসন চারদিনের সফরে মধ্যপ্রাচ্যে গিয়ে উপসাগরীয় সংকট নিরসনের চেষ্টা করেন। কাতারের পররাষ্ট্রমন্ত্রীর সঙ্গে আলোচনার পর যৌথভাবে বিবৃতিও দেন তিনি।
এরপর সংকট নিরসনে সৌদি আরবে সফরের পর পুনরায় কাতারে যান তিনি। সংকট নিরসনের আরেক দফা চেষ্টাতেও চোখে পড়ার মত তেমন দেখা যায়নি। এবার কাতারের সংকট নিরসনে তুরস্কের প্রেসিডেন্ট এরদোয়ানের ভূমিকা রাখার সম্ভাবনা খুবই কম।
কেননা মধ্যপ্রাচ্যের এ সংকট শুরুর পর পরই অন্যতম মিত্র কাতারের পক্ষে অবস্থান নিয়েছে তুরস্ক। এছাড়া দেশটি সৌদি আরবের বিপক্ষে অবস্থান নেবে না বলে ধারণা করা হচ্ছে।
মার্কিন পররাষ্ট্রমন্ত্রী রেক্স টিলারসন ক্ষমতাবান রাষ্ট্রের পররাষ্ট্রমন্ত্রী হয়েও তেমন একটা ফল বয়ে নিয়ে আসতে পারেননি। তাছাড়া কাতারের প্রতি তার আন্তরিকতাও ছিল। অনেকেই ধারণা করেছিলেন, রেক্স টিলাসনের পক্ষে হয়তো অবরোধ থামানো সম্ভব হবে; কিন্তু শেষ পর্যন্ত তা আর আলোর মুখ দেখেনি। সেক্ষেত্রে টিলারসনের হেরে যাওয়া বিষয়ে এরদোয়ানের সফল হওয়ার সম্ভাবনা কতটুকু তা নিয়ে প্রশ্ন রয়েছে।
দোহার সঙ্গে প্রতিবেশি দেশগুলোর কূটনৈতিক সম্পর্কচ্ছেদের পর থেকে গত ১২ জুলাই পর্যন্ত কাতারে পণ্যবাহী ১৯৭টি কার্গো বিমান পাঠিয়েছে তুরস্ক। কাতারি নাগরিকদের দৈনন্দিন চাহিদা পূরণে তুরস্কের পণ্যবাহী কার্গো ছাড়াও ১৬টি ট্রাক ও একটি জাহাজ দোহায় পাঠানো হয়। অন্যদিকে কাতারের সঙ্গে কূটনৈতিক সম্পর্ক ছিন্ন নিয়ে বিভিন্ন সময়ে সৌদি জোটের কড়া সমালোচনা করেছেন তিনি। এতে করে কাতার ইস্যুতে সৌদি জোটের অপ্রিয় হয়ে বসে আছেন তিনি।
কাতারের সঙ্গে সৌদি জোটের অবরোধের অন্যতম কারণ হল, ইরানের সঙ্গে সম্পর্কের উন্নতি। সৌদি জোট চায় না সম্পদশালী কাতারের সম্পর্ক তাদের সঙ্গে ছাড়া অন্য কারও সঙ্গে ভাল হোক। অথচ সাম্প্রতিক বছরগুলোতে কাতারের সঙ্গে তুরস্কের সম্পর্কেরও উন্নতি হয়েছে। সেকারণে তুরস্ককেও সেভাবে সুনজরে দেখে না সৌদি জোট।
কাতারের সঙ্গে ২০১৫ সালে সামরিক চুক্তিতে স্বাক্ষর করে দুই দেশ। কাতারে সামরিক ঘাঁটিও রয়েছে তুরস্কের। আবার তুরস্কের সঙ্গে কাতারও ভাল সম্পর্ক বজায় রেখে চলে।
এরদোয়ানের বিরুদ্ধে তুরস্কের সেনা সদস্যদের একাংশের অভ্যুত্থানের ব্যর্থ চেষ্টার সময় প্রথম রাষ্ট্রপ্রধান হিসেবে সংহতি প্রকাশ করেছিলেন কাতারের আমির শেখ তামিম বিন হামাদ আল-থানি। এরদোয়ানের নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে কাতারের বিশেষ বাহিনীর ১৫০ সদস্যের একটি ইউনিট তুরস্কে পাঠানো হয়েছিল। এই দুই দেশের সরকারের আদর্শও প্রায় একই রকম।
মুসলিম ব্রাদারহুড ও হামাসকে জঙ্গি সংগঠন মনে করে না কাতার, তুরস্ক উভয় দেশই। সেই দিক বিবেচনায় কাতার-তুরস্ক দৃষ্টিভঙ্গি আলাদা হওয়ার কথা নয়। একইভাবে ইরানের সঙ্গে তুরস্কের সম্পর্ক গাঢ়। সৌদি জোটের চেয়ে ইরানকেই বেশি ক্ষমতাশালী মনে করে তুরস্ক। কাতারের আমির শেখ তামিম বিন হামাদ আল থানি, রুশ প্রেসিডেন্ট ভ্লাদিমির পুতিন, কুয়েতের আমির শেখ জাবের আল আহমাদ আল সাবাহ এবং সৌদি বাদশাহ সালমান বিন আবদুল আজিজ আল সউদের সঙ্গে সংকটের শুরুতেই ফোনে কথা বলেন এরদোয়ান।
এরদোয়ান সংকট নিরসনে আলোচনায় বসার ওপরও জোর দিয়েছিলেন। আঞ্চলিক শান্তি ও স্থিতিশীলতা বজায় রাখতে এবং উত্তেজনা প্রশমনে কূটনৈতিক উদ্যোগ নিতে সব পক্ষকে আহ্বান জানান তিনি। কিন্তু তাতে কাজের কাজ কিছুই হয়নি। তারপরও উপসাগরীয় অঞ্চলে সৃষ্ট সংকট সমাধানে এরদোয়ানের উদ্যোগ প্রশংসার দাবি রাখে। এখন সময় বলে দেবে কতটুকু সফল হতে পারবেন তুরস্কের এই প্রেসিডেন্ট।
এই রকম সংবাদ আরো পেতে হলে এই লেখার উপরে ক্লিক করে আমাদের ফেসবুক ফ্যান পেইজে লাইক দিয়ে সংযুক্ত থাকুন। সংবাদটি সম্পর্কে মন্তব্য করতে হলে এই পেইজের নীচে মন্তব্য করার জন্য ঘর পাবেন