কুমারী পূজার প্রচলন
কুমারী পূজা শারদীয়া দুর্গাপূজার এক বর্ণাঢ্য পর্ব। দুর্গাপূজার মহাষ্টমীর দিন কুমরীপূজা উৎযাপন করা হয়।কুমারী পূজা সম্পর্কে সাধারণের মধ্যে বেশ কৌতূহল দেখা যায়। বালিকা প্রতিমায় মহামায়ার পূজা ঈশ্বরের মাতৃভাবে আরাধনার ফলিতরূপ বলা যায়।
নারী জগদ্ধাত্রীর অংশবিশেষ। সমগ্র বিশ্বে তিনি মহামায়া রূপে প্রকাশিতা। প্রত্যেক নারীকে মাতৃভাবে ভাবনা মহামায়ার শ্রেষ্ঠ উপাসনা এবং নারী মর্যাদার সর্বোচ্চ বিধান।
কুমারী হলো দেবী দুর্গার পার্থিব প্রতিনিধি।সব নারীর মধ্যেই আছে দেবী দুর্গার শক্তি। তাই নারী পূজনীয়- এ দৃষ্টিকোণ থেকে কোনো কুমারীকে দেবীর আসনে বসিয়ে কুমারী পূজা করা হয়। এ যেন কুমারীরূপে বিশ্বের নারীশক্তি, বিশ্ব মাতৃশক্তির প্রতি গভীর শ্রদ্ধা নিবেদন। দুর্গাপূজা ছাড়াও কালীপূজা, জগদ্ধাত্রী পূজা এবং অন্নপূর্ণা পূজা উপলক্ষে এবং কামাখ্যাসহ বিভিন্ন শক্তিক্ষেত্রেও কুমারী পূজার প্রচলন রয়েছে।
কুরুক্ষেত্রের যুদ্ধের প্রাক্কালে ভগবান শ্রীকৃষ্ণের নির্দেশনায় মহাবীর অর্জুন দেবী দুর্গার স্তব করেছিলেন। মহাভারতে অর্জুন কুমারী পূজাও করেছিলেন বলে জানা যায়। কালের অতলে দুর্গাপূজায় কুমারীপূজা হারিয়ে গেলেও স্বামী বিবেকানন্দ মাতৃজাতির মর্যাদা প্রতিষ্ঠায় ১৯০১ সালে বেলুড় মঠে কুমারী পূজা পুনঃপ্রচলন করেন। এর পেছনে স্বামীজির মহৎ উদ্দেশ্য ছিল। তখনকার সমাজ নারীকে যথাযথ মর্যাদা দিত না। যার কারণে সমাজে নারীর অবস্থান ছিল খুব দুর্বল।
স্বামীজি অনুভব করেছিলেন, দেশ তথা জাতির উন্নতিকল্পে নারী-পুরুষ উভয়েরই অংশগ্রহণ করা একান্ত জরুরি। আর সেই কারণে নারী যাতে তার যথাযথ মর্যাদা পায় -তার জন্যই নারীকে পূজা করা। ভারতবর্ষের সন্ন্যাসীরা সাধন পথের বাধা হিসেবে বিবেচনা করে নারী জাতিকে দূরে সরিয়ে রেখেছিলেন। স্বামী বিবেকানন্দ কিন্তু অত্যন্ত সচেতনভাবে নারী জাতির কথা চিন্তা করেছেন, কারণ যদি নারী এবং পুরুষ উভয়েই জীবনে সমানভাবে এগিয়ে না যায়, তবে দেশ বা জাতির সর্বাঙ্গীণ উন্নয়ন সম্ভব নয়। কুমারী পূজা একটি ভিন্ন প্রক্রিয়া হলেও এটি আধ্যাত্মিক উপলব্ধির ওপর প্রতিষ্ঠিত।
কুমারী কথার সাধারণ অর্থ কন্যা। দেবী পুরাণ মতে, কুমারী দেবীরই প্রতীক। কুমারী পূজার উৎস সন্ধান করতে গিয়ে বৃহদ্ধর্ম পুরাণে উল্লেখ পাওয়া যায়, দেবতাদের স্তবে প্রসন্ন হয়ে দেবী চণ্ডিকা কুমারী কন্যারূপে দেবতাদের সামনে দেখা দিয়েছিলেন। দেবী পুরাণে বিস্তারিত এ বিষয়ে উল্লেখ আছে। তবে অনেকে মনে করেন, দুর্গাপূজায় কুমারী পূজা সংযুক্ত হয়েছে তান্ত্রিক সাধনামতে।
যোগিনীতন্ত্রের বর্ণনানুসারে কুমারী পূজার প্রচলন হলো এভাবে- ব্রহ্মার শাপে মহাতেজা বিষ্ণুর দেহে একবার পাপসঞ্চার হয়েছিল। সর্বজ্ঞ বিষ্ণু সেই পাপে পীড়িত হয়ে হিমাচল সন্নিধানে গমনপূর্বক তপস্যায় প্রবৃত্ত হলেন এবং সেই পাপের ক্ষয়কারী মহাকালী অষ্টাক্ষরী মহাবিদ্যা দশ হাজার বছর পর্যন্ত জপ করেছিলেন। বিষ্ণুর তপস্যায় মহাকালী খুশি হন। দেবীর সন্তোষমাত্রেই বিষ্ণুর পাপ স্খলন হয়ে হৃদয়পদ্ম থেকে সহসা কোলা নামক মহাসুরের আবির্ভাব হয়। সেই কোলাসুর ইন্দ্রাদি দেবগণ পরাজিত করে অখিল ভূমণ্ডল, বিষ্ণুর বৈকুণ্ঠ এবং ব্রহ্মার কমলাসন প্রভৃতি দখল করে নেয়। তখন পরাজিত বিষ্ণু ও দেবগণ ‘রক্ষ ’ ‘রক্ষ’ বাক্যে ভক্তিবিনম্রচিত্তে দেবীর স্তব শুরু করেন। বিষ্ণু ও আদি দেবগণের স্তবে সন্তুষ্ট হয়ে দেবী বলেন, “হে বিষ্ণু! আমি কুমারীরূপ ধারণপূর্বক কোলানগরী গমন করে কোলাসুরকে সবান্ধবে হত্যা করিব।” অতঃপর তিনি কোলাসুরকে বধ করলেন- সেই থেকে দেব-গন্ধর্ব, কিন্নর-কিন্নরী, দেবপত্নীগণ সবাই সমবেত হয়ে কুসুম-চন্দন-ভারে কুমারীর অর্চনা করে আসছেন। এই হলো যোগিনীতন্ত্র অনুসারে কুমারী পূজার উদ্ভব ও বিকাশ।
বর্ণনানুসারে কুমারী পূজায় কোনো জাতি, ধর্ম বা বর্ণভেদ নেই। দেবীজ্ঞানে যে কোনো কুমারীই পূজনীয়। তবে সাধারণত ব্রাহ্মণ কুমারী কন্যার পূজাই সর্বত্র প্রচলিত। তবে অন্য জাতির কন্যাকেও কুমারীরূপে পূজা করতে বাধা নেই। অবশ্যই অব্রাহ্মণ কন্যায়ও অতি উত্তম কুমারী পূজা হবে। কুমারী মানেই সর্ববিদ্যা স্বরূপা।
দুর্গাপূজায় কুমারী পূজার দিন সকালে পূজার জন্য নির্দিষ্ট কুমারীকে স্নান করিয়ে নতুন কাপড় পরানো হয় এবং ফুলের গহনা ও নানাবিধ অলংকারে তাকে সাজানো হয়। পা ধুয়ে পরানো হয় আলতা, কপালে এঁকে দেওয়া হয় সিঁদুরের তিলক, হাতে দেওয়া হয় মনোরম ফুল।
কুমারীকে মণ্ডপে সুসজ্জিত আসনে বসিয়ে তার পায়ের কাছে রাখা হয় বেলপাতা, ফুল, জল, নৈবেদ্য ও পূজার নানাবিধ উপাচার। তারপর কুমারীর ধ্যান করতে হয়। প্রতিমায় দেবীর পূজাতে আংশিক ফল হয়, কিন্তু কুমারীতে দেবীর প্রকাশ উপলব্ধি করে তার পূজায় পরিপূর্ণ ফল পাওয়া যায়।
তন্ত্র অনুসারে এক থেকে ষোল বছর পর্যন্ত বালিকাদের কুমারী পূজার জন্য নির্বাচিত করা যায়। এক এক বয়সের কুমারীর এক এক নাম রয়েছে। এক বছর বয়সী কন্যার নাম- সন্ধ্যা, এভাবে দুই বছরের কন্যার নাম- সরস্বতী।
কুমারীর পূজা নয়। কুমারীতে পূজা। কুমারীতে ভগবতীর পূজা। এটি একাধারে ঈশ্বরের উপাসনা, মানব বন্দনা, আর নারীর মর্যাদা। নারীর সম্মান, মানুষের জয়গান আর ঈশ্বর আরাধনাই কুমারী পূজায় অন্তর্নিহিত।
এই রকম সংবাদ আরো পেতে হলে এই লেখার উপরে ক্লিক করে আমাদের ফেসবুক ফ্যান পেইজে লাইক দিয়ে সংযুক্ত থাকুন। সংবাদটি সম্পর্কে মন্তব্য করতে হলে এই পেইজের নীচে মন্তব্য করার জন্য ঘর পাবেন