কুড়িগ্রাম ও দিনাজপুরে ভয়াবহ বন্যায় ১৫ জনের মৃত্যু
কুড়িগ্রাম ও দিনাজপুরে বন্যা পরিস্থিতি ভয়াবহ রূপ ধারণ করছে। দুই জেলার ২৪টি উপজেলার প্রায় ৯ লাখ মানুষ পানিবন্দি হয়ে পড়েছেন। বন্যায় এ দুই জেলায় ১৫ জনের মৃত্যুর খবর পাওয়া গেছে।
এ দুই জেলার সবকটি নদীর পানি বিপদসীমার ওপর দিয়ে প্রবাহিত হচ্ছে।
বিভিন্ন স্থানে বন্যা নিয়ন্ত্রণ বাঁধ ভেঙে গেছে। বাঁধ রক্ষায় ও বানভাসী মানুষকে উদ্ধারের জন্য বাংলাদেশ সেনাবাহিনী ও বিজিবি মোতায়েন করা হয়েছে।
কুড়িগ্রাম
জেলার ৯টি উপজেলার ৫৭ ইউনিয়নের প্রায় চার লাখ মানুষ পানিবন্দি হয়ে পড়েছে। বন্যায় এ পর্যন্ত ছয়জনের মৃত্যুর খবর পাওয়া গেছে।
পানি অস্বাভাবিকহারে বৃদ্ধি পাওয়ায় রোববার বিকালে ধরলা নদীর পানি বিপদসীমার ১২৪ সেন্টিমিটার এবং চিলমারী পয়েন্টে ব্রহ্মপুত্র নদীর পানি ৩৯ সেন্টিমিটার উপর দিয়ে প্রবাহিত হচ্ছে।
কুড়িগ্রামের কাঠালবাড়ী, রাজারহাটের কালুয়া ও ফুলবাড়ীর গোড়কমণ্ডল এলাকায় বাঁধ ভেঙে যাওয়ায় বন্যা পরিস্থিতি ভয়াবহ রূপ ধারণ করেছে।
বিভিন্ন স্থানে সড়কের ওপর দিয়ে পানি প্রবাহিত হওয়ায় জেলার সঙ্গে সড়ক ও রেল যোগাযোগ ব্যবস্থা বন্ধ হয়ে গেছে।
এদিকে বন্যার কারণে পাঠদান কার্যক্রম বন্ধ ঘোষণা করা হয়েছে ৬০৮টি শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের। পানিতে ডুবে যাওয়ায় ৮৩টি কমিউনিটি ক্লিনিকের কার্যক্রম বন্ধ হয়ে গেছে। সদরের কাউয়াহাগা এলাকায় বিদ্যুতের টাওয়ার ভেঙে পড়ায় সকাল থেকে জেলায় বিদ্যুৎ সরবরাহ বন্ধ রয়েছে।
বন্যা পরিস্থিতি পর্যবেক্ষণ করতে সেনাবাহিনীর একটি বিশেষ টিম মাঠে নেমেছে। সার্বিক বন্যা পরিস্থিতি মোকাবেলায় জেলা প্রশাসক আবু ছালেহ মোহাম্মদ ফেরদৌস খানের সভাপতিত্বে সন্ধ্যা ৬টা পর্যন্ত ত্রাণ ও দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা কমিটির জরুরি সভা অনুষ্ঠিত হয়।
জেলা প্রশাসক আবু ছালেহ মোহাম্মদ ফেরদৌস খান জানান, বন্যা পরিস্থিতি মোকাবেলা ও ত্রাণ তৎপরতা সচল রাখতে সব ধরনের উদ্যোগ নেয়া হয়েছে। জেলার সরকারি ও বেসরকারি সকল বিভাগকে বন্যার্তদের পাশে থাকার নির্দেশ দেয়া হয়েছে।
তিনি জানান, দুর্যোগ মোকাবেলায় সেনাবাহিনী, বিজিবি ও আনসার বিভাগকে সার্বিক সহযোগিতার জন্য অনুরোধ জানানো হয়েছে। ইতিমধ্যে সেনাবাহিনীর একটি বিশেষ টিম বাঁধ সংষ্কারের কর্ম-পরিকল্পনা ও সার্বিক বন্যা পরিস্থিতি পর্যবেক্ষণ করতে মাঠে কাজ শুরু করেছে।
গত চব্বিশ ঘণ্টায় চারজনের মৃত্যুর সংবাদ পাওয়া গেছে। এর মধ্যে কুড়িগ্রাম সদরের খামার হলোখানায় সাপের কামড়ে অলিউর রহমানের স্ত্রী জ্যোস্না বেগম (২৫), পৌরসভার ভেলাকোপা এলাকার দুলু মিয়ার পূত্র বাবু (দেড় বছর) পানিতে ডুবে, ফুলবাড়ী সদর ইউনিয়নের প্রাণকৃঞ্চ গ্রামের খাতক মামুদের ছেলে লুৎফর রহমান (৩৫) মাছ মারতে গিয়ে পানিতে ডুবে এবং গোড়কমণ্ডল বস্তি গ্রামের মৃত: কাচু মামুদের ছেলে হযরত আলী (৫৫) আকস্মিক ঘরে পানি ঢোকায় আতংকে মারা যায়।
রাজারহাটের ছিনাই ইউনিয়নের প্রক্তন চেয়ারম্যান সাদেকুল হক নুরু জানান, কালুয়ারচর ওয়াপদা বাঁধ রাতে ভেঙে যাওয়ার সময় রিফাত (১০) ও লোকমানের স্ত্রী (৩২) পানির তোড়ে ভেসে গেছেন।
ফুলবাড়ী উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা দেবেন্দ্রনাথ উঁরাও জানান, ভয়াবহ বন্যায় উপজেলার লক্ষাধিক মানুষ পানিবন্দি হয়ে পড়েছে। ফুলবাড়ী উপজেলার সংযোগ সব সড়ক এখন পানির নিচে। ফলে যোগাযোগ ব্যবস্থা ভেঙে পরেছে। দুর্গত মানুষের মাঝে শুকনো খাবার সরবরাহ করা হচ্ছে। ফুলবাড়ী খাদ্য গুদাম চত্বরে পানি ঢুকে তিনশ’ মেট্রিকটন খাদ্যশস্য নষ্ট হওয়ার আশংকা করা হচ্ছে।
রাজারহাট উপজেলার কালুয়ারচর ওয়াপদা বাঁধের একশ’ মিটার এবং কুড়িগ্রাম সদরের কাঁঠালবাড়ীর বাংটুর ঘাট এলাকায় বাঁধের একশ’ মিটার ভেঙে পানি ঢোকায় কাঠালবাড়ী, ছিনাই, ঘড়িয়ালডাঙ্গা, হলোখানা ও রাজারহাট সদর প্লাবিত হয়েছে। কুড়িগ্রাম রংপুর মহাসড়কের একাধিক জায়গায় হাঁটু পরিমাণ পানি ওঠায় যোগাযোগ ব্যবস্থা বিচ্ছিন্ন হয়ে পড়েছে।
রৌমারী উপজেলা চেয়ারম্যান মজিবর রহমান বঙ্গবাসী জানান, বন্যায় ৫০টি গ্রাম প্লাবিত হয়েছে। পানিবন্দি হয়েছে পাঁচ হাজার পরিবার। ২৪ ঘণ্টায় ভিটেমাটি হারিয়ে গৃহহীন হয়েছে ৫৫টি পরিবার।
কুড়িগ্রাম জেলা প্রাথমিক শিক্ষা অফিসার স্বপন কুমার রায় চৌধুরী জানান, বন্যায় ৯ উপজেলায় ৪৪১টি বিদ্যালয়ে পানি ওঠায় পাঠদান কার্যক্রম বন্ধ হয়ে গেছে। এর মাঝে ১৫০টি শিক্ষা প্রতিষ্ঠান আশ্রয়কেন্দ্র হিসেবে ব্যবহৃত হচ্ছে। নদী ভাঙনের মুখে পড়েছে ১৮টি বিদ্যালয়।
জেলা মাধ্যমিক শিক্ষা অফিসার খন্দকার মো. আলাউদ্দিন আল আজাদ জানান, মাধ্যমিক বিদ্যালয় ও মাদ্রাসা মিলে জেলায় ১৬৭টি প্রতিষ্ঠানে পানি ওঠায় শিক্ষা কার্যক্রম অনির্দিষ্টকালের জন্য বন্ধ ঘোষণা করা হয়েছে।
কুড়িগ্রামের সিভিল সার্জন ডা. আমিনুল ইসলাম জানান, জেলায় ৮৭টি মেডিকেল টিম কাজ করছে। বন্যায় প্লাবিত হয়েছে ৫৭টি ইউনিয়ন। ২৪ ঘন্টায় ডায়রিয়ায় আক্রান্ত ১৭ জন। এছাড়া পানিতে ডুবে যাওয়ায় ৮৩টি কমিউনিটি ক্লিনিকের কার্যক্রম বন্ধ হয়ে গেছে।
দিনাজপুর
দিনাজপুরে বন্যা পরিস্থিতি ভয়াবহ রূপ ধারণ করছে। জেলার সবকটি নদীর পানি বিপদসীমার উপর দিয়ে প্রবাহিত হচ্ছে। ভেঙে গেছে দিনাজপুর শহর রক্ষা বাঁধসহ বেশ কয়েকটি নদীর বাঁধ। বন্যাজনিত কারনে জেলায় রোববার একই পরিবারের তিন শিশুসহ ৯ জনের মৃত্যু হয়েছে।
বাঁধ রক্ষায় ও বানভাসী মানুষকে উদ্ধারের জন্য মোতায়েন করা হয়েছে বাংলাদেশ সেনাবাহিনী ও বিজিবিকে। বাড়িঘর ডুবে গিয়ে গৃহহীন হয়ে পড়েছে জেলার প্রায় পাঁচ লাখ মানুষ।
দিনাজপুরের কাহারোল উপজেলায় বন্যার পানিতে ডুবে একই পরিবারের তিন শিশুসহ চারজনের মৃত্যু হয়েছে। এছাড়া জেলায় বন্যাজনিত কারণে পানিতে ডুবে, সর্প দংশনে এবং বিদ্যুৎস্পৃষ্ট হয়ে আরও পাঁচজনের মৃত্যু হয়েছে। এ নিয়ে দিনাজপুরে বন্যাজনিত কারণে মৃতের সংখ্যা দাঁড়ালো ৯ জনে।
কাহারোল থানার ওসি মো. মনসুর আলী সরকার জানান, রোববার বিকাল সাড়ে ৩টার দিকে কাহারোল উপজেলার ঈশ্বরগ্রাম হতে কলার ভেলায় চড়ে পাশ্ববর্তী বিরল উপজেলার হাসিলা গ্রামে নিজ বাড়িতে তিন সন্তান ও প্রতিবেশির এক সন্তানকে নিয়ে আসছিলো আবদুর রহমানের স্ত্রী সোনাভান বেগম। এ সময় কলার ভেলা উল্টে পানিতে পড়ে আবদুর রহমানের মেয়ে চুমকি (১৩), ছেলে শহিদ আলী (১০) ও সিয়াদ (৭) এবং প্রতিবেশি সাঈদ হোসেনের ছেলে সিহাদ (৭) মারা গেছে।
এছাড়া বন্যায় দিনাজপুরে আরও পাঁচজনের মৃত্যু হয়েছে। তারা হলেন- দিনাজপুর শহরের দক্ষিণ বালুবাড়ী এলাকার আবদুল হাকিমের ছেলে সাইফুল ইসলাম (৪৫), বালুবাড়ী ঢিবিপাড়া এলাকার এনামুল হকের ছেলে মেহেদী হাসান (১৫), সদর উপজেলার মির্জাপুর এলাকার আবদুল গফফারের ছেলে আবু নাইম (১৩), বিরল উপজেলার মালঝাড় এলাকার বাবলু রায়ের স্ত্রী দিপালী রায় (৩২) ও সদর উপজেলার দরবারপুর গ্রামের মেহের আলীর ছেলে চাঁন মিয়া (৫৫)।
ভারী বর্ষণ ও উজান থেকে নেমে আসা ঢলে দিনাজপুর জেলায় শনিবার থেকে শুরু হয় বন্যা। ইতিমধ্যেই দিনাজপুরের ১৩টি উপজেলা বন্যায় প্লাবিত হয়েছে। এর মধ্যে দিনাজপুর সদর, বিরল, কাহারোল, বীরগঞ্জ, খানসামা, চিরিরবন্দর ও পার্বতীপুর উপজেলা বেশি ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে।
পানিবন্দি ও গৃহহীন মানুষ আশ্রয় নিয়েছে বিভিন্ন শিক্ষা প্রতিষ্ঠান ও বাঁধ এলাকায়। জেলার দুই হাজার ৯৩০টি শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের অধিকাংশই বানভাসী মানুষের আশ্রয় কেন্দ্রে পরিনত হয়েছে। এসব শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে বন্ধ রয়েছে শিক্ষা কার্যক্রম।
দিনাজপুর সহকারী জেলা প্রাথমিক শিক্ষা কর্মকর্তা মো. সাইফুজ্জামান জানান, শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে ছুটি ঘোষণা করা না হলেও বন্যাদুর্গত এলাকায় বানভাসী মানুষ শিক্ষা প্রতিষ্ঠানগুলোতে আশ্রয় নেয়ায় সেগুলোতে শিক্ষা কার্যক্রম বন্ধ রয়েছে।
পানি উন্নয়ন বোর্ড সূত্রে জানা গেছে, জেলার সব নদীর পানি বিপদ সীমার উপর দিয়ে প্রবাহিত হচ্ছে। শহরের তুঁতবাগান এলাকায় দিনাজপুর শহর রক্ষা বাধের ৫০ মিটার ভেঙে গেছে। এছাড়াও দিনাজপুর জেলার বিভিন্ন স্থানে নদীর বাধ ভেঙে বিস্তীর্ণ এলাকা প্লাবিত হয়েছে।
পানি উন্নয়ন বোর্ডের নির্বাহী প্রকৌশলী ফয়জুর রহমান জানান, পুনর্ভবা নদীর পানি বিপদসীমার দশমিক ৭৮ সেন্টিমিটার এবং আত্রাই নদীর পানি দশমিক ৫০ সেন্টিমিটার উপর দিয়ে প্রবাহিত হচ্ছে। এছাড়াও সবকটি নদীর পানি বিপদসীমার উপর দিয়ে প্রবাহিত হচ্ছে বলে জানান তিনি।
দিনাজপুর শহর রক্ষা বাঁধ ভেঙ্গে যাওয়ায় সেই বাঁধ সংস্কারে বিজিবি সদস্যদের মোতায়েন করা হয়। বিজিবি ব্যর্থ হওয়ায় দুপুরে বাঁধ সংস্কার ও বানভাসী মানুষকে উদ্ধারে মোতায়েন করা হয় সেনাবাহিনী।
রোববার দুপুর থেকে মেজর তৌহিদের নেতৃত্বে সেনাবাহিনীর ৬৬ পদাতিক ডিভিশনের ৫২ সদস্য বাঁধ সংস্কার ও বানভাসী মানুষকে উদ্ধারের কাজ শুরু করেছেন।
বন্যার কারণে দিনাজপুরের অধিকাংশ সড়ক ও মহাসড়ক পানির নীচে তলিয়ে যাওয়ায় দিনাজপুর জেলার সঙ্গে বিভিন্ন উপজেলার সড়ক যোগাযোগ বন্ধ রয়েছে। হিলি স্থল বন্দর পানিতে তলিয়ে যাওয়ায় শনিবার থেকে বন্ধ রয়েছে আমদানি-রফতানি কার্যক্রম।
বন্যায় ভেঙে গেছে জেলার হাজার হাজার ঘরবাড়ি। পানির নিচে তলিয়ে গেছে জেলার প্রায় দুই লাখ হেক্টর জমির ফসল।
দিনাজপুর আঞ্চলিক আবহাওয়া অফিসের ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা তোফাজ্জুর রহমান জানান, গত ২৪ ঘণ্টায় দিনাজপুরে ২৯৬ মিলিমিটার বৃষ্টিপাত রেকর্ড করেছে আবহাওয়া অফিস।
দিনাজপুর জেলা প্রশাসক মীর খায়রুল আলম জানিয়েছেন, জেলা প্রশাসনের পক্ষ থেকে ইতিমধ্যেই এক লাখ ১০ হাজার টাকা ও ৬৭ মেট্রিকটন চাল বন্যাদুর্গতদের মাঝে বিতরণ করা হয়েছে। এছাড়াও বন্যার্তদের জন্য ৫০ লাখ টাকা ও তিনশ’ মেট্রিক টন চাল বরাদ্দ চেয়ে ত্রাণ মন্ত্রণালয়ে চিঠি পাঠানো হয়েছে।
জাতীয় সংসদের হুইপ ইকবালুর রহিম রোববার দিনাজপুর সদর উপজেলার বিভিন্ন স্থানে বন্যার্তদের মাঝে খাবারসহ ত্রাণ সামগ্রী বিতরণ করেছেন।
এই রকম সংবাদ আরো পেতে হলে এই লেখার উপরে ক্লিক করে আমাদের ফেসবুক ফ্যান পেইজে লাইক দিয়ে সংযুক্ত থাকুন। সংবাদটি সম্পর্কে মন্তব্য করতে হলে এই পেইজের নীচে মন্তব্য করার জন্য ঘর পাবেন