কূলে পেটের দায়, জলে ডাকাতের ভয়, গলিত ১০ লাশ, নেপথ্যে কারা?
দরিয়া নগর কক্সবাজারের নাজিরারটেক উপকূলে ভাসমান ট্রলার থেকে ১০ মরদেহ উদ্ধারের পর থেকে এলাকায় নানা রহস্য দানা বেঁধেছে। দিন যতই ফুরাচ্ছে, ততই রহস্যের জট ঘনিভূত হতে শুরু করেছে। নিহতদের অনেকেই জেলে না হয়েও ঘটনার সময় কেন সাগরে গিয়েছিলেন, এসব প্রশ্নও বাতাসে উড়ছে।
ওদিকে, গলিত মরদেহ উদ্ধারের ঘটনায় পুলিশ ব্যুরো অফ ইনভেস্টিগেশন (পিবিআই) ও ক্রিমিনাল ইনভেস্টিগেশন ডিপার্টমেন্ট (সিআইডি)-র তদন্ত অব্যাহত রয়েছে। কি কারণে এমন হত্যাকাণ্ড, কেন এবং কারা ঘটিয়েছে, এ ঘটনার পেছনে কারা জড়িত তাদের খুঁজে বের করতে মরিয়া কক্সবাজারের পুলিশ। আলোচিত এ হত্যাকাণ্ডের তদন্তের শুরুতে সাগরে মাছ ধরা নিয়ে আধিপত্য বিস্তার, মাদকের চালান, জেলে ও ডাকাতদের মধ্যে বিরোধের বিষয়টিকে প্রাধান্য দেওয়া হচ্ছে।
পুলিশ বলছে, নিহত ১০ জনের মধ্যে দুইজনের বিরুদ্ধে মহেশখালী থানায় মামলা রয়েছে। এর মধ্যে নুরুল কবিরের নামে অস্ত্র ও ডাকাতি মামলা এবং শামসু মাঝির বিরুদ্ধে মাদক ও হত্যা মামলা রয়েছে। এছাড়াও নিহত অন্যান্যদের জেলে হিসেবে সাগরে মাছ ধরতে যাওয়ার তথ্যে বিভ্রাট রয়েছে।
জানতে চাইলে কুতুবদিয়া উপকূলে জলদস্যু দমনে অনেকটা সফল পুলিশ কর্মকর্তা কুতুবদিয়া থানার ৩৫তম সাবেক অফিসার ইনচার্জ মোহাম্মদ দিদারুল ফেরদৌস বলেন, ‘সমুদ্রে জলদস্যুতার ঘটনা অহরহ ঘটলেও ভুক্তভোগীরা মামলা মোকদ্দমা করতে চান না। কেননা তাদের ভয় আছে। সমুদ্রে তো আবার যেতে হবে। মামলা করতে গেলে সমুদ্রে যাওয়াই বন্ধ করে দিবে ডাকাতেরা। ফলে, অধিকাংশ ডাকাতি ঘটনার কোন মামলা নেই। অবাক করার বিষয় জলদস্যুতার শত শত ঘটনা ঘটলেও থানায় কোন মামলাই বলতে হয় না। হলেও খুবই নগন্য। জলের ঘটনায় কূলে থাকা স্থানীয় পুলিশকে এসব নিয়ে কাজ করতে গেলেও নানা বেগ পেতে হয়। তবে, আমি থাকাকালে জলদস্যুতা নিয়ে অসংখ্য কাজ করার সুযোগ হয়েছিলো।’
অভিজ্ঞ এই পুলিশ কর্মকর্তা আরও বলেন, ‘দস্যুদের বা তাদের পৃষ্টপোষকদের তালিকা করা হয়েছিলো। যেমন কেউ সরাসরি ডাকাতি করে, কেউ কেঊ ভাড়ায় অস্ত্র সাপ্লাই দেয়, কেঊ কেঊ লুট করা মাছ/জাল ক্রয় করে। কেঊ আছে দস্যুদের মামলা মোকদ্দমা দেখভালসহ রাজনৈতিক শেল্টার দেয় ইত্যাদি। আমিই প্রথম দস্যু বা সহযোগীদের তালিকা করেছিলাম। তাদের গ্রেফতারসহ তাদের দখল থেকে অসংখ্য অস্ত্র উদ্ধার করা হয়েছিল। অধিকাংশের বিরুদ্ধে মামলা মোকদ্দমা হয়েছিলো। পুলিশের অব্যাহত অভিযানের কারণে অন্তত ২ বছর জলদস্যুতা বন্ধ হয়ে গিয়েছিলো। শতাধিক জলদস্যু পরবর্তীতে আত্মসমর্পন করতে বাধ্য হয়েছিল। কিন্তু বর্তমানে নীরবে অসংখ্য জলদস্যুতার ঘটনা ঘটে গেলেও বিভিন্ন বাহিনীর (নৌ পুলিশ, কোস্টগার্ড, নৌ বাহিনী) তৎপরতা হয়তো কম থাকায়, দিনে দিনে ক্ষতিগ্রস্ত জেলেরা অসহিষ্ণু হয়ে পড়ে নিজেরাই আইন হাতে তুলে নিতে বাধ্য হয়ে যাচ্ছে না তো। সেটাও খেয়াল রাখা দরকার।’
কক্সবাজারের অতিরিক্ত পুলিশ সুপার মো. রফিকুল ইসলাম বলেন, ‘একসঙ্গে ১০ জনের মরদেহ উদ্ধারের ঘটনাটি স্পর্শকাতর। এ জন্য পুলিশ গুরুত্বসহকারে তদন্ত করছে। বিশেষ করে এই আলোচিত এ হত্যাকাণ্ডের তদন্তের শুরুতে সাগরে মাছ ধরা নিয়ে আধিপত্য বিস্তার, মাদকের চালান নিয়ে সংঘর্ষ, জেলে ও ডাকাতদের মধ্যে বিরোধ সংঘর্ষের বিষয়টিকে প্রাধান্য দেওয়া হচ্ছে। তদন্ত প্রতিবেদন পেলে বিষয়টি একদম পরিষ্কার হয়ে যাবে।’
কক্সবাজারের পুলিশ সুপার মো. মাহফুজুল ইসলাম বলেন, ‘কে অপরাধী, কে নিরপরাধ এসব দেখার জন্য আইন রয়েছে। আইন নিজের হাতে তুলে নেওয়ার মত ক্ষমতা কারও নেই। ঘটনাটি সংঘটিত হওয়ার পর থেকে পিবিআই ও সিআইডি তদন্ত করছে। তদন্ত প্রতিবেদন হাতে এলে বিষয়টি পরিষ্কার হয়ে যাবে।’
মাহফুজুল ইসলাম আরও বলেন, ‘ময়নাতদন্তের প্রতিবেদন অনুযায়ী নিহতদের কারও শরীরে গুলি বা অন্যকোনো আঘাতের চিহ্ন পাওয়া যায়নি। ফলে এদের হাত-পা বেঁধে হিমঘরে আটকে হত্যার বিষয়টি অনেকটা পরিষ্কার। আদালতের আদেশে মামলার এজাহারভুক্ত ১ নম্বর আসামি মাতারবাড়ির এলাকার ট্রলার মালিক বাইট্টা কামাল ও ৪ নম্বর আসামি ট্রলার মাঝি করিম শিকদার রিমান্ডে রয়েছেন। এদের কাছ থেকে পাওয়া তথ্য যাচাই-বাছাই চলছে। এর সূত্র ধরে চলছে তদন্ত।’
প্রশ্ন দেখা দিয়েছে, সামশুল আলম ওরফে সামশু মাঝি। ভাসমান ট্রলারটির মালিক ও নিহতদের মধ্যে একজন। মহেশখালী উপজেলার হোয়ানক ইউনিয়নের হরিয়ারছড়া এলাকার ছনখোলা পাড়ার বাসিন্দা তিনি। পেশায় জেলে হলেও সাগরে মাছ ধরায় তিনি অনিয়মিত। কিন্তু, ওইদিন কেন সাগরে মাছ ধরতে গেলেন, সে প্রশ্নের উত্তর খুঁজছেন প্রশাসনের পাশাপাশি স্থানীয়রাও। ১০ মরদেহের একজন ওসমান গনি। কক্সবাজার জেলা হাসপাতাল মর্গে ছেলে ওসমান গণির মৃতদেহ শনাক্তের পর বাবা মুসা আলী কেন? মৃতদেহ গ্রহণ করতে যাননি। সেটাও নজরে এসেছে অনেকের।
এর আগে গত রবিবার সকালে সাগরে ভাসমান অবস্থায় ট্রলারটি দেখে রশি দিয়ে টেনে মহেশখালীর সোনাদিয়া চ্যানেলে নিয়ে আসেন স্থানীয় জেলেরা। খবর পেয়ে দুপুর ২টার দিকে ঘটনাস্থলে গিয়ে ১০ জনের লাশ উদ্ধার করে পুলিশ ও ফায়ার সার্ভিস। সন্ধ্যায় সদর হাসপাতালের মর্গে এসে স্বজনরা ১০ জনের লাশ শনাক্ত করেন।
এদের মধ্যে চারজন মহেশখালীর ও অন্য দুইজন চকরিয়া উপজেলার। বাকি চার লাশ সদর হাসপাতালের হিমাগারে রাখা হয়েছে। কারণ লাশগুলো এতই বিকৃত হয়েছে যে, কে কার স্বজন তা নিশ্চিত করা কঠিন। এ জন্য সেগুলোর ডিএনএ নমুনা সংগ্রহ করে ঢাকায় সিআইডির হেডকোয়ার্টার্সে পাঠানো হয়েছে। পরিচয় নিশ্চিত হওয়ার পর লাশ হস্তান্তর করা হবে।
এ ঘটনায় কক্সবাজার সদর মডেল থানায় নিহত সামশু মাঝির স্ত্রী রোকেয়া আক্তার বাদী হয়ে একটি মামলা দায়ের করেছেন। মামলায় পুলিশ ও র্যাব এখন পর্যন্ত পাঁচজনকে গ্রেপ্তার করেছে। তাদের মধ্যে আদালতের আদেশে দুই আসামি পাঁচ দিন করে রিমান্ডে রয়েছে। একই সঙ্গে মঙ্গলবার রাতে মহেশখালী উপজেলার কুতুবজোমের খাল থেকে উদ্ধার হওয়া মানুষের কংকালটি নিখোঁজ জেলেদের মধ্যে একজনের বলে ধারণা করছেন পুলিশ।
এই রকম সংবাদ আরো পেতে হলে এই লেখার উপরে ক্লিক করে আমাদের ফেসবুক ফ্যান পেইজে লাইক দিয়ে সংযুক্ত থাকুন। সংবাদটি সম্পর্কে মন্তব্য করতে হলে এই পেইজের নীচে মন্তব্য করার জন্য ঘর পাবেন