খাগড়াছড়িতে শুরু ‘বৈসাবি’ উৎসব, বিজুর ফুল ভাসাতে গিয়ে পানিতে ডুবে শিশুর মৃত্যু
খাগড়াছড়ি পার্বত্য জেলা ”নদীতে ফুল ভাসানো নয়-বেদি সাজিয়ে ফুল দিয়ে ফুল বিঝু পালন করুন” শ্লোগানে চেঙ্গী নদীতে ফুল ভাসানোর মধ্য দিয়ে জেলা ব্যাপী শুরু হয়েছে প্রাণের উৎসব ‘বৈসাবি’র ”পাত্তরু-তুরু” চাকমাদের ফুল ”বিঝু” উৎসব।
মঙ্গলবার(১২ই এপ্রিল) ভোরে চেঙ্গী, ফেনী ও মাইনী নদীতে ফুল ভাসানোর মধ্য দিয়ে জেলা ৯টি উপজেলাতে শুরু হয়েছে পাহাড়ি জনগোষ্ঠীর ঐতিহ্যবাহী প্রধান সামাজিক ও প্রাণের উৎসব ‘বৈসাবি’। ফুল বিঝুকে কেন্দ্র করে সকাল থেকে নদীর পাড়াগুলো হাজারো তরুণ-তরুণীর মিলন মেলায় পরিণত হয়। বৃহত্তর খবং পুড়িয়া বিঝু উদযাপন কমিটি আহবায়ক সতীশ চাকমা(১নং ওয়ার্ড কাউন্সিলর) সভাপতিত্বে প্রধান অতিথি হিসেবে উপস্থিত ছিলেন নির্মলেন্ধু চৌধুরী মেয়র খাগড়াছড়ি পৌরসভা। অতিথি হিসেবে উপস্থিত ছিলেন জেলা আওয়ামীলীগের সহ-সভাপতি কল্যান মিত্র বড়–য়া, সমাজসেবক ধীমান খীসা। বৈসাবি উৎসব উপভোগ করতে বিপুল সংখ্যক পর্যটক এখন খাগড়াছড়িতে।
পাহাড়ি সম্প্রদায়ের তরুণ-তরুণী, কিশোরী-ছোট ছোট ছেলে-মেয়েরা হয়-হল্লা করে ফুল তুলে গঙ্গা দেবীর উদ্দেশ্যে নদী-খালে ভাসিয়ে পুরাতন বছরের গøাানি মুছে নতুন বছরের শুভ কামনায় নিজেদের পবিত্রতা কামনা করে। এছাড়া ফুল দিয়ে ঘরের প্রতিটি দরজার মাঝখানে মালা গেঁথে সাজানো হয়।
জানা যায়, খাগড়াছড়ি: পার্বত্য চট্টগ্রামের পাহাড়িদের প্রধান সামাজিক ও ধর্মীয় উৎসব ‘বৈসাবি’ শুরু হয়েছে। নদীতে গঙ্গা দেবীর উদ্দেশে ফুল পূজা করে চাকমারা ‘ফুল বিজু’ উদযাপন করেছেন। ভোরে খাগড়াছড়ি সদরের খবংপুজ্যা এলাকা দিয়ে চেঙ্গী নদীতে ফুল দিতে শতশত চাকমা শিশু-কিশোর, তরুণ-তরুণী, বিভিন্ন বয়সী নারী-পুরুষ ভিড় জমান। সূর্যোদয়ের আগেই চাকমারা দলে দলে নদীর তীরে সমবেত হন। কেউ একাকি আবার অনেকে সারিবদ্ধ হয়ে নদীতে নানা রংয়ের ফুল উৎসর্গ করেন। যেন রঙিন হয়ে ওঠে চেঙ্গী নদী। এছাড়া শহর, শহরতলীর বিভিন্ন খাল ও প্রাকৃতিক ছড়াও ফুলে ফুলে ভরে যায়। ছোট্ট শিশুরা নদীতে আনন্দ-উল্লাস করে নতুন বছরকে আহŸান জানায়। এর আগে তারা ফুল সংগ্রহ করেন।
মংগলবার(১২ই এপ্রিল) চাকমা সম্প্রদায় ফুল বিজু পালন করছে। বুধবার মূল বিঝু আর পরের দিন পহেলা বৈশাখ বা গজ্জাপয্যা পালন করবে। এ সময় ঘরে ঘরে চলবে অতিথি আপ্যায়ন। একই সাথে ত্রিপুরা সম্প্রদায়ের হারিবৈসু,বিযুমা, বিচিকাতাল। ফুল বিজু, মূলবিজু ও বিচিকাতাল নামে নিজস্ব বৈশিষ্টতায় এ উৎসবে আনন্দের আমেজ ছড়ায়। ত্রিপুরা ভাষায় এ উৎসবকে বৈসু ও চাকমা ভাষায় বিজু বলা হয়।
অপর দিকে বুধবার(১৩ই এপ্রিল) খাগড়াছড়িতে মারমা সম্প্রদায় সাংগ্রাই উৎসবে ঐতিহ্যবাহী ”রিইলং পোয়ে” বা জলকেলি উৎসব বা পানি খেলা ও বৃহষ্পতিবার(১৪এপ্রিল) জেলা প্রশাসনে উদ্যোগে হবে ১লা বৈশাখ বাংলা বর্ষবরণের র্যালী আয়োজন করেছ। ত্রিপুরা, মারমা ও চাকমা এই তিন সম্প্রদায়ের উৎসবের নাম একত্র করে বৈসাবি শব্দটির উৎপত্তি।
পাশিপাশি তঞ্চঙ্গ্যা,বম, খিয়াং, লুসাই, পাংখোয়া, ম্রো,খুমি,আসাম, চাক ও রাখাইনসহ ১৩টি ক্ষুদ্র-নৃ-জনগোষ্ঠী তাদের ভাষা-সংস্কুতি ও অবস্থানকে বৈচিত্রময় করে তুলতে প্রতি বছর চৈত্রের শেষ দিন থেকে ‘বৈসাবি’ উৎসব পালন করে থাকে।
বৈসাবি উৎসবের মধ্য দিয়ে পাহাড়ী-বাঙ্গালীর মধ্যে শান্তি-সম্প্রীতি ও ঐক্য আরো সু-দৃঢ় হোক এই প্রত্যাশা সকলের।
এদিকে খাগড়াছড়ি শহরের চেঙ্গী নদীতে বিজুর ফুল ভাসাতে গিয়ে পানিতে ডুবে এক শিশুর মৃত্যু হয়েছে। তার নাম অভিদান চাকমা ওরফে মন(১৪)। সে খাগড়াছড়ি পৌর শহরে উত্তর খবং পুড়িয়া বিনোদ বিহারি চাকমার ছেলে। এ শিশুর মৃত্যুতে পরিবারে বৈসাবির উৎসবের পরিবর্তে শোকের ছায়া নেমে এসেছে।
প্রত্যক্ষদর্শীরা জানায়, মঙ্গলবার(১২ই এপ্রিল) সকাল ৭টায় অভিদান চাকমা ওরফে মুন নদীকে ফুল ভাসাতে বন্ধুদের সাথে চেঙ্গী নদীতে নামে। কিন্তু নদীতে বিপুল সংখ্যক মানুষের ভীরে অভিদান চাকমা ওরফে মুন পানিতে ডুবে গেলেও কেউ টের পায়নি। এক পর্যায়ে নদীতে নামা জনৈত পায়ে লাগলে অভিদান চাকমা ওরফে মুন পানির নিচ থেকে উপরে তুলে নিয়ে আসা হয়।
পরে তাকে খাগড়াছড়ি আধুনিক জেলা সদর হাসপাতালে নেওয়া হলে কর্তব্যরত চিকিৎসক তাকে মৃত ঘোষনা করেন। বিষয়টি নিশ্চিত করেছেন, খাগড়াছড়ি সদর থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা মোহাম্মদ রশীদ।
অন্যদিকে দীঘিনালা উপজেলায় মাইনী নদীতে ফুল ভাসানোর মধ্য দিয়ে বৈসাবি উৎসব শুরু হয়েছে। গঙ্গাদেবীকে ফুল উৎস্বর্গ করে পাহাড়ে শুরু হয়েছে ক্ষুদ্র-নৃ-গোষ্ঠীদের বৈসাবি’ উৎসবের প্রথম দিন অর্থাৎ ‘ফুলবিজু। মঙ্গলবার(১২ই এপ্রিল) সকাল ৭টায় দীঘিনালার মাইনী ব্রিজ এলাকায় নদীতে ফুল ভাসানোর মাধ্যমে পুরাতন বছরকে বিদায় ও নতুন বছকে স্বাগতম জানাতে ভীড় করেছে চাকমা সম্প্রদায়ের দর্শনার্থীরা। নদীতে ফুল ভাসানো ছাড়াও দীঘিনালার হটিকালচার সেন্টার সংলগ্ন এলাকায় নানা ধরনের ঐতিহ্যবাহী খেলার আয়োজন করা হয়েছে।
এ ছাড়াও সকালে নতুন বছরকে সমৃদ্ধিকে ভাসিয়েছেন দীঘিনালা উপজেলা প্রশাসনের নির্বাহী কর্মকর্তা(ইউএনও) ফাহমিদা মুস্তফা, সাবেক উপজেলা চেয়ারম্যান নব কমল চাকমা, কবাখালি ইউপি চেয়ারম্যান নলেজ চাকমা জ্ঞান, বোয়ালখালী ইউপি চেয়ারম্যান চয়ন বিকাশ চাকমা, উপজেলা রিসোর্স সেন্টারের ইনস্ট্রাক্টর মাইন উদ্দিনসহ উপজেলার সুশিল সমাজের নেত্রীবৃন্দরা। এরপর বৈসাবি উদযাপন উপলক্ষে আনন্দ শোভা যাত্রায় অংশ নেয় তারা।
অন্যদিকে বৈসাবিকে ঘিরে এরইমধ্যে পাহাড়ের পাড়া-মহল্লাতে উৎসবের আমেজ ছড়িয়ে পড়েছে। ঐহিত্যবাহী খেলাধুলায় মেতেছে পাহাড়িরা। বিগত দু’বছর করোনার ধকল কাটিয়ে এবার বর্নিলভাবে বৈসাবি পালন করছেন পাহাড়ের নারী-পুরুষ,শিশু-কিশোররা। ঐতিহ্যবাহী বৈসাবিকে ঘিরে ঘিলাখেলা,পানিখেলাসহ নানা খেলাধুলার উৎসবে মেতেছে জেলার প্রত্যেকটি পাহাড়ি পল্লীগ্রাম। বুধবার(১৩ই এপ্রিল) ত্রিপুরারা ‘বৈসু’ ও পহেলা বৈশাখ মারমারা ‘সাংগ্রাই’ উৎসব শুরু করলেন। ত্রিপুরাদের ‘গরয়া নৃত্য’ আর মারমাদের ‘পানি উৎসব’ পাহাড়ে বর্ষবরণের অন্যতম আকর্ষণ। বৈসাবিকে ঘিরে এরইমধ্যে পাহাড়ের পাড়া-পল্লীতে উৎসবের আমেজ ছড়িয়ে পড়েছে। ঐহিত্যবাহী খেলাধুলায় মেতেছে পাহাড়িরা। বিগত দু’বছর করোনার ধকল কাটিয়ে এবার বর্ণিলভাবে বৈসাবি পালন করছেন পাহাড়িরা।
খাগড়াছড়ি: নদীতে গঙ্গাদেবীর উদ্দেশ্যে ফুল ভাসানোর মধ্য দিয়ে মঙ্গলবার ১২ই এপ্রিল শুরু হয়েছে ঐতিহ্যবাহী বৈসাবি উৎসব। ধর্মীয়, সামাজিক রীতিনীতিতে সপ্তাহব্যাপী চলবে এই উৎসব। বাংলা নববর্ষের আগে এবং পরে পাহাড়ের বিভিন্ন জাতিগোষ্ঠী ভিন্ন ভিন্ন নামে এই উৎসব পালন করে। তবে দেশ বিদেশের বিভিন্ন প্রান্তে বসবাসরত পাহাড়ি জাতিগোষ্ঠী এই উৎসব পালন করায় তা আর পার্বত্য চট্টগ্র্মর মধ্যে সীমাবদ্ধ নেই।
গত দুই বছর করোনার কারণে এই উৎসব শুধুমাত্র ঘরোয়াভাবে পালন করা হয়। ছিল না বাড়তি কোনো সামাজিক ও সাংস্কৃতিক আয়োজন। রুদ্ধশ্বাস পরিবেশ থেকে মুক্ত হয়ে তাই এবার উৎসব আয়োজনে বাড়তি আগ্রহ সবার মাঝে।
পাহাড়ে বহু ক্ষুদ্র জাতিগোষ্ঠীর বসবাস করলেও মূলত তিন জাতিগোষ্ঠীর সামাজিক আয়োজন নিয়ে উৎসবের পরিমন্ডল। পাহাড়ের ঐতিহ্যবাহী উৎসব ‘বৈসাবি’ নামে বেশি পরিচিত। মূলত তিন জাতিগোষ্ঠীর উৎসবের প্রথম অদ্যাক্ষর দিয়ে উৎসবের নামকরণ। ত্রিপুরা জাতিগোষ্ঠীর বৈসু উৎসবের ‘বৈ’, মারমা জাতিগোষ্ঠীর সাংগ্রাই উৎসবের ‘সা’ এবং চাকমা সসম্প্রদায়ের বিজু উৎসবের ‘বি’ দিয়ে নামকরণ করা হয় ‘বৈসাবি’ উৎসবের।
উৎসবের প্রথম দিন বিশ্ব শান্তির মঙ্গল ও পরিবার-পরিজনের সুখ শান্তি কামনায় নদীতে ফুল ভাসিয়ে প্রার্থনা করা হয়।
এই রকম সংবাদ আরো পেতে হলে এই লেখার উপরে ক্লিক করে আমাদের ফেসবুক ফ্যান পেইজে লাইক দিয়ে সংযুক্ত থাকুন। সংবাদটি সম্পর্কে মন্তব্য করতে হলে এই পেইজের নীচে মন্তব্য করার জন্য ঘর পাবেন