গাড়ি দেখলেই খাবারের জন্য ছুটে আসছে রোহিঙ্গারা
কক্সবাজারের উখিয়া-টেকনাফ সীমান্ত এলাকার সড়ক ও পাহাড়ে আশ্রয় নেয়া রোহিঙ্গারা খাবারের তীব্র সঙ্কটে পড়েছেন। খাবারের জন্য রাস্তায় এসে বসে আছেন তারা।
কোনও গাড়ি দেখলেই ছুটে আসছে রোহিঙ্গারা। কোনও গাড়ি থেকে শুকনা খাবার দিতে দেখলে ওই খাবার সংগ্রহ করতে শুরু হয় তীব্র প্রতিযোগিতা। এই প্রযোগিতায় বৃদ্ধ ও শিশুদের প্রাণহানির শঙ্কা করছেন স্থানীয়রা।
বৃহস্পতিবার কক্সবাজারের উখিয়া উপজেলার কুতুলং, ঘুমধুম, কলাবাগান, পালংখালী ও বালুখালীতে সরেজমিনে ঘুরে এই চিত্র দেখা গেছে।
দুপুরে উখিয়া উপজেলার কুতুপালং রোহিঙ্গা ক্যাম্পের বাইরে হাজার হাজার রোহিঙ্গা রাস্তার দুই পাশে দাঁড়িয়ে আছে। ওই সড়ক দিয়ে কোনও গাড়ি গেলেই পাশে এসে দাঁড়ায় তারা।
একই চিত্র ঘুমধুম, কলাবাগান, পালংখালী ও বালুখালীতে। রোহিঙ্গারা এসব এলাকার রাস্তা ও পাহাড়ের গাছের নিচে সারিবদ্ধ ও গোল হয়ে বসে আছে।
এদিকে, পালংখালী বাজারে দোকানে দোকানে রোহিঙ্গা নারী ও শিশুদের খাবার চাইতে দেখা গেছে। আয়েশা বেগম নামে এক রোহিঙ্গা নারী কোলে দুই সন্তান নিয়ে এই বাজারের হোটেল আল মদিনায় ভাত চান। সঙ্গে তার বৃদ্ধ শ্বশুর আব্দুর রাজ্জাকও ছিলেন। অনেক্ষণ দাঁড়িয়ে থাকেন।
এ সময় হোটেলের মালিক সিরাজুল ইসলামের ছেলে মো. হোসেন ওই নারীকে একটি পলিপ্যাকে ভাত ও মাংস দিয়ে দেন। তা নিয়ে চলে যান তারা।
জানতে চাইলে আয়েশা বেগম বলেন, আমরা একই পরিবারের ১২ জন পালিয়ে বাংলাদেশে আসি। রাস্তায় আছি এখনও। বৃষ্টি হলে গাছের নিচে বসে থাকি।
বালুখালীর ঢালে একটি পাহাড়ে নতুন বসতি গড়েছে রোহিঙ্গারা। সেখানে কথা হয় ফরিদা বেগম (৪৫) নামে একজন নারীর সঙ্গে। তার স্বামীর নাম মৃত গোরামিয়া। তারা মিয়ানমারের মংডুর বলিবাজার এলাকায় থাকতেন।
গত ২৪ আগস্ট হঠাৎ তাদের বাড়িঘরে প্রথমে আগুন দেয়া হয়। এরপর সেনাবাহিনী ও পুলিশ তাদের ওপর গুলি চালায়। প্রাণ রক্ষার জন্য তারা বাড়িঘর রেখে পালাতে থাকেন। সবার সঙ্গে তিনিও বাংলাদেশের দিকে আসেন।
ফরিদা বেগম বলেন, আমার সাত ছেলে মেয়ে। চার ছেলে ও তিন মেয়ে। তাদের সবাইকে নিয়ে আমি অন্যাদের সঙ্গে বাংলাদেশে আসি। এর আগে ১৪ দিন আমরা নোম্যান্স ল্যান্ডে ছিলাম।
কান্নজড়িত কণ্ঠে তিনি বলেন, তারা মেয়েদের রেপ করে। ছেলেদের হত্যা করে। মেয়েদের নিয়ে ভয়ে ছিলাম। তাই সবাইকে নিয়ে চলে এসেছি।
বালুখালীর পাহাড়ে ফরিদা বেগম পলিথিন ও পাশ দিয়ে একটি ছোট্ট টংঘর বানিয়েছেন। সোমবার তিনি ভাত খেয়েছেন এরপর আর কিছু খাননি।
ওই পাহাড়েই আশ্রয় নিয়েছেন শাহানূর বেগম নামে একজন নারী। তিনি বলেন, আমার স্বামী ইউনুছ আলীকে মিয়ানমারের সেনাবাহিনী গুলি করে হত্যা করেছে।
উখিয়ার কলাবাগানে আশ্রয় নেয়া মাছুমা বেগম রাস্তায় দাঁড়িয়ে আছেন। তার ছেলেমেয়ে নয়জন। স্বামী সৈয়দ আমিন ঘর তোলার জন্য চেষ্টা করছেন। কিন্তু বাঁশ ও পলিথিন এখনও জোগাড় করতে পারেননি। খাবার নেয়ার জন্য রাস্তার ভিন্ন ভিন্ন জায়গায় দাঁড়িয়ে আছেন তারা।
খাইরুন নেসা নামে এক নারী জানান, তার স্বামীর নাম হোসেন জোহুর। গাছের ব্যবসা করতেন মিয়ানমারে। দালালকে ২০ হাজার টাকা দিয়ে নৌকায় করে নাফ নদী পার হয়ে এসেছি। এখন আর কিছুই নেই। এক কাপড়ে চলে আসি। প্রায় ১৫ দিন ধরে একই কাপড়ে আছি।
মিয়ানমার সেনাবাহিনীর অত্যাচারের কথা উল্লেখ করে সেনোয়ারা বেগম নামে আরেকজন বলেন, আমাদের বাড়ির ওপরে প্লেন উড়ছে। এরপর আগুন দিছে। তারপর গুলি করছে সবাইকে। তার বাবা-মা ও পাঁচ ভাই-বোনের কেউ বেঁচে নেই। সবাই মারা গেছে।
ঘুমধুমের পাথরকাটার কোনাপাড়া নোম্যান্সল্যান্ডে এখনও ১২ হাজার রোহিঙ্গা বাংলাদেশে প্রবেশের অপেক্ষায় রয়েছে। সেখানে থাকা রোহিঙ্গাদের স্থানীয়রা খাবার দিচ্ছেন। কয়েক বেলা পরপর এক বেলা খেতে পারছেন তারা।
মিয়ানমারের তুমব্রু থেকে আসা আমানুল্লাহ (৩৫) বলেন, আমি মাছের ব্যবসা করতাম। আমার ঘের ছিল। বাড়িতে আগুন দেয়ার পর সবাইকে নিয়ে পালিয়ে আসি।
তিনি বলেন, এখানে আমারা ১২ হাজার রোহিঙ্গা আছি। এখানে একটা কমিটি করা হয়েছে। আমরা তালিকা করছি। আমরা বিজিবির কাছ থেকে অনুমতি নিয়ে খাবার ও পানি নিচ্ছি। আমাদের ওখানে কেউ খাবার নিয়ে যায় না। স্থানীয়রা আমাদের খাবার দিচ্ছেন।
সরেজমিনে পালংখালী ইউনিয়নের থাইনখালী এলাকায় গিয়ে দেখা যায়, পাহাড়ের উঁচুতে ও পাদদেশে পলিথিন ও বাঁশ দিয়ে ঝুপড়ি ঘর তুলেছে রোহিঙ্গা পরিবারগুলো। তবে আশপাশে নেই কোনো বিশুদ্ধ পানির উৎস। যদিও অনেককে হেঁটে ৩-৪ কিলোমিটার দূরে গিয়ে স্থানীয়দের বাড়ি থেকে নলকূপের পানি আনতে হচ্ছে। কিন্তু সেটাও অনেক সীমিত।
৭ দিন আগে মিয়ানমার সীমান্ত অতিক্রম করে বাংলাদেশে এসেছেন ৮৫ বছর বয়সী শরীফ হোসেন। বর্তমানে থাইনখালীর পাহাড়ের ঝুপড়িতে দিন কাটাচ্ছেন এ বৃদ্ধ।
খাবার পানির সংকটের কথা উল্লেখ করে তিনি বলেন, ৭ দিন ধরে পানি ছাড়া কিছুই খাইনি। যে পানি খেয়েছি তাও বিশুদ্ধ নয়। এ পানি খেয়ে ডায়রিয়ায় আক্রান্ত হয়েছি। তবুও বাধ্য হয়ে খাচ্ছি।
পাহড়ের উঁচু থেকে সমতলে পানি আনতে যাওয়ার সময় এ প্রতিবেদকের সঙ্গে কথা হয় ইকবাল নামে এক কিশোরের সঙ্গে।
সে জানায়, এখানে খাদ্যের সংকটের চেয়ে খাবার পানির সংকট বেশি। ৩-৪ কিলোমিটার দূরে গিয়ে পানি আনতে হয় আমাদের।
প্রসঙ্গত, মিয়ানমারের রাখাইনে দেশটির বাহিনী দমনপীড়ন ও সাম্প্রদায়িক সহিংসতা চালাচ্ছে। এ অবস্থায় গত দুই সপ্তাহে রাখাইন থেকে প্রায় দেড় লাখ রোহিঙ্গা বাংলাদেশে এসেছে। তাদের মাঝে ৫ শতাধিক হিন্দু থাকলেও বাকি সবাই মুসলিম। জাতিসংঘের শরণার্থী বিষয়ক সংস্থা ইউএনএইচসিআরের মতে এ সংখ্যা ৯০ হাজার। তবে, স্থানীয়দের মতে দেড় লাখ ছাড়িয়ে যাবে নতুন আসা রোহিঙ্গার সংখ্যা।
এই রকম সংবাদ আরো পেতে হলে এই লেখার উপরে ক্লিক করে আমাদের ফেসবুক ফ্যান পেইজে লাইক দিয়ে সংযুক্ত থাকুন। সংবাদটি সম্পর্কে মন্তব্য করতে হলে এই পেইজের নীচে মন্তব্য করার জন্য ঘর পাবেন