বাজারে বাড়তি দামে সরকারি চিনি বিক্রির বিষয়ে বিএসএফআইসির সচিব চৌধুরী রুহুল আমিন কায়সার বলেন, ‘এ বিষয়ে আমরা ভোক্তা অধিদপ্তরকে চিঠি দিয়েছি। বাড়তি দামে আমাদের চিনি বিক্রি ঠেকাতে যা যা করা দরকার, আমরা করছি। কিছুদিন আগে ভোক্তা অধিদপ্তর অভিযানও চালিয়েছে।’
চড়া দামে কালোবাজারে বিক্রি হচ্ছে প্যাকেটজাত লাল চিনি
সরকার উৎপাদিত লাল চিনি নির্ধারিত দামে পাওয়া যাচ্ছে না। প্রতি কেজিতে ৩০ থেকে ৩৫ টাকা বেশি দামে বাজারে বিক্রি করা হচ্ছে। ভোক্তা পর্যায়ে বিএসএফআইসির উৎপাদিত প্যাকেটজাত চিনির প্রতি কেজির সর্বোচ্চ দাম ১৪০ টাকা। কিন্তু বাজারে পাওয়া যাচ্ছে ১৭০ থেকে ১৮০ টাকা কেজি দরে।
সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিরা মনে করছেন, ডিলারদের কারসাজি ও কালোবাজারির কারণে বাড়তি দামে লাল চিনি কিনতে বাধ্য হচ্ছে ক্রেতারা।
শিল্প মন্ত্রণালয়ের অধীন প্রতিষ্ঠান বাংলাদেশ চিনি ও খাদ্য শিল্প করপোরেশন (বিএসএফআইসি) সূত্রে জানা যায়, সারা দেশে সরকারিভাবে ৯টি কলের মাধ্যমে আখ থেকে চিনি উত্পাদন করা হয়। কিন্তু তা দেশের চাহিদার মাত্র ১ শতাংশ। বাকি সব চিনি আমদানি করে বেসরকারি কয়েকটি প্রতিষ্ঠান।
সরকারিভাবে যতটুকু চিনি উত্পাদন হয়, তার বেশ কিছু চিনি রেশনে দেওয়া হয়। বাকি চিনি প্রায় ৮০০ ডিলারের মাধ্যমে সাধারণ ভোক্তাদের মধ্যে বিক্রি করার নিয়ম। এসব ডিলার নিয়োগ দেয় বিএসএফআইসি। কিন্তু অভিযোগ রয়েছে, এই ডিলাররা কারখানা থেকে চিনি বরাদ্দ নিয়ে তাঁরা অন্য ব্যবসায়ীদের কাছে বিক্রি করে দেন।
সেই ব্যবসায়ীরা চিনি কিনে নিয়ে প্যাকেটজাত করে বাড়তি দামে বিক্রি করেন। ডিলাররা সরাসরি ভোক্তাদের কাছে বিক্রি করলে নির্ধারিত মূল্যে চিনি পেত সাধারণ মানুষ।
রাজধানীর মোহাম্মদপুর এলাকার বাসিন্দা মাসুদ আহমেদ বলেন, ‘মোহাম্মদপুর কৃষি মার্কেটের একটি দোকানে প্যাকেটজাত লাল চিনি আমার কাছে ১৭৫ টাকা চেয়েছে। প্যাকেটের গায়ে লেখা ছিল সোনালি দেশি চিনি। প্যাকেটে দাম ১৮০ টাকা।
বিক্রেতা পাঁচ টাকা কমে বিক্রি করতে চেয়েছেন। তিন-চার মাস ধরে এই দামেই প্যাকেটজাত লাল চিনি কিনছি। সরকার নির্ধারিত দামে কখনোই কিনতে পারিনি।’
সম্প্রতি বিএসএফআইসির একজন কর্মকর্তার অভিযোগের পরিপ্রেক্ষিতে জাতীয় ভোক্তা অধিকার সংরক্ষণ অধিদপ্তর অভিযান পরিচালনা করে। নেতৃত্বে ছিলেন ভোক্তা অধিদপ্তরের ঢাকা বিভাগীয় কার্যালয়ের সহকারী পরিচালক (মেট্রোপলিটন) মো. আবদুস সালাম। রাজধানী ঢাকার ধানমণ্ডির জিগাতলায় মাশিরা বিডি লিমিটেডের কার্যালয়ে গিয়ে তিনি দেখতে পান, সরকার উত্পাদিত বস্তার চিনি প্যাকেটজাত করা হচ্ছে। একই সঙ্গে বাজারে বেশি দামে সরবরাহ করা হচ্ছে। যা আইনসম্মতভাবে ওই প্রতিষ্ঠান বা অন্য কেউ করতে পারে না।
এ বিষয়ে মো. আবদুস সালাম বলেন, বিএসএফআইসির চিনি প্যাকেটজাত করার এখতিয়ার উনাদের (মাশিরা বিডি) নেই। তারা অনুমোদিত ডিলারও না। ভোক্তা পর্যায়ে বিএসএফআইসির উত্পাদিত প্যাকেটজাত চিনির প্রতি কেজির সর্বোচ্চ দাম ১৪০ টাকা। এটা অতিক্রম করার সুযোগ নেই। কিন্তু উনারা বিক্রি করে ১৭৭ টাকা কেজি দরে। বিএসএফআইসি যেভাবে প্যাকেটজাত করে, ঠিক সেভাবেই মাশিরা বিডি করেছে। প্যাকেটের ডিজাইন হুবহু নকল করেছে। এগুলো আসলে মিথ্যা বিজ্ঞাপন দিয়ে ভোক্তাদের প্রতারিত করা।
মো. আবদুস সালাম বলেন, ‘মাশিরা বিডির কাছ থেকে আট হাজার কেজির বেশি চিনি পাওয়া গেছে। আমরা ধারণা করছি, চিনির একটি ব্ল্যাক মার্কেট (কালোবাজার) আছে, সেখান থেকে এরা সংগ্রহ করেছে। এভাবে বেশি দামে বিক্রি প্রতারণাই বলা যায়। কাদের মাধ্যমে কালোবাজারি হচ্ছে, এই বিষয়টা বলতে পারব না।
আমরা যাকে ধরেছি, এর মধ্যে সীমাবদ্ধ আছি। প্রতিষ্ঠান সাময়িকভাবে বন্ধ করে সিলগালা করে দিয়েছি। সাত কার্যদিবসের মধ্যে ব্যবস্থা নেওয়া হবে। কারা জড়িত, তা বিশ্লেষণ করে বের করতে সময় লাগবে। ডিলারদের জড়িত থাকার তথ্যও আমরা পেতে পারি। এখনই আমরা সিদ্ধান্ত দিচ্ছি না, পর্যালোচনা করছি। আর বিভিন্ন জায়গা থেকে তথ্য সংগ্রহ করছি।’
তাঁর এমন বক্তব্যের পরিপ্রেক্ষিতে ভোক্তা অধিদপ্তরের কর্মকর্তা আবদুস সালাম বলেন, ‘বাধ্যতামূলক পণ্যগুলো প্যাকেজিংয়ের জন্য বিএসটিআই সনদ দেয়। তার মানে এই নয় যে প্যাকেটের ভেতর কালোবাজারি করে বা অবৈধ প্রক্রিয়ায় পণ্য নিয়ে এসে প্যাকেট করে বিক্রি করতে পারবেন। উনি কোত্থেকে চিনি নিয়ে এসেছেন? মৌলভীবাজারের কার কাছ থেকে নিয়ে এসেছেন? এমন কোনো কাগজ দেখাতে পারেননি। বিএসএফআইসির বিপণন বিভাগের কর্মকর্তা আনোয়ার হোসেনের অভিযোগের পরিপ্রেক্ষিতে আমরা মাশিরা বিডির বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নিয়েছি। অধিকতর তদন্ত-পর্যালোচনা করে সিদ্ধান্ত নেওয়া হবে। উনাদের আর্থিক জরিমানা হতে পারে। ব্যবসার লাইসেন্স বাতিল হতে পারে। উনার কাছে আট হাজার ৭৫০ কেজি চিনি আছে। সেই চিনিগুলো ভোক্তা পর্যায়ে ন্যায্য মূল্যে বিক্রির ব্যবস্থা করা হবে।
কনজিউমারস অ্যাসোসিয়েশন অব বাংলাদেশের (ক্যাব) ভাইস প্রেসিডেন্ট এস এম নাজের হোসাইন বলেন, ‘সরকারি চিনি নির্ধারিত দামে না পাওয়ার ক্ষেত্রে বিএসএফআইসির অব্যবস্থাপনাই দায়ী। একটা সময় তাদের অফিসের সামনে সেল সেন্টার থেকে চিনি বিক্রি করত। তখন বাজারে চিনি পাওয়া যেত। এরপর সেটা বন্ধ করে দিয়ে ডিস্ট্রিবিউটর নিয়োগ করল। আর যখনই এটা করল, তখন থেকে বাজারে যা পাওয়া যেত, তা-ও বন্ধ হয়ে গেল। তার মানে সমস্যাটা বিএসএফআইসিতে। তারা যে পরিমাণ চিনি উত্পাদন করে, সেটা যদি সঠিক সরবরাহ ব্যবস্থার মাধ্যমে বাজারে দেওয়া যেত, তাহলে বাজার থেকে চিনি উধাও হয়ে যেত না। এতে বেশি দাম দিয়ে চিনি কিনতে হচ্ছে।’
এই রকম সংবাদ আরো পেতে হলে এই লেখার উপরে ক্লিক করে আমাদের ফেসবুক ফ্যান পেইজে লাইক দিয়ে সংযুক্ত থাকুন। সংবাদটি সম্পর্কে মন্তব্য করতে হলে এই পেইজের নীচে মন্তব্য করার জন্য ঘর পাবেন