চলনবিলে মধু সংগ্রহে ব্যস্ত মৌ চাষিরা, বেড়েছে উৎপাদন

বৃহত্তর চলনবিল অঞ্চলের মাঠে মাঠে চোখ জুড়ানো হলুদ ফুলের সমারোহ। মাঠগুলো যেন হলুদ চাদরে মোড়ানো। ঋতু পরিবর্তনের সাথে সাথে বদলে গেছে প্রকৃতির রূপ। শীতের সোনাঝরা রোদে ঝকমক করছে হলুদে-সবুজে মিশেল দিগন্ত বিস্তৃত সরিষা ক্ষেত। যেন প্রকৃতি সেজেছে হলুদবরণ সাজে।

বর্ষাকালে চলনবিলের চারপাশ পানিতে টইটুম্বুর থাকলেও প্রতিবছর শুষ্ক মৌসুমে চলনবিল হয়ে ওঠে যেন এক হলুদের স্বর্গরাজ্য। যে দিকেই তাকানো যায় সে দিকেই চোখে পড়ে সরিষার হলুদ রঙের দিগন্ত জোড়া মাঠ। চলনবিল ছাড়াও এবার পাবনা-সিরাজগঞ্জের অন্যান্য উপজেলাতেও সরিষার আবাদ বেড়েছে।

দিগন্ত জোড়া এই হলুদ রাঙ্গা সরিষার মাঠে মৌমাছি দিয়ে মধু আহরণে এখন ব্যস্ত সময় পাড় করছে মৌ চাষিরা। সরিষা ক্ষেতের মাঝে মাঝে মৌবাক্স স্থাপন করে মধু সংগ্রহ করছে তারা। বিশেষভাবে তৈরি এসব মৌবাক্সে ৭ থেকে ৮টি করে মৌচাক বা কলোনী রয়েছে। সারাদিন মৌমাছিগুলো সরিষা ফুল থেকে একটু একটু করে মধু সংগ্রহ করে এসব মৌচাকে জমা করে। আর মৌয়ালরা সাতদিন পর পর বিশেষ কৌশলে ধোঁয়ার মাধ্যমে চাক থেকে মৌমাছি সরিয়ে মৌচাকগুলো একটি মেশিনে দেয়। তারপর সেই মৌচাকগুলো ঘুরিয়ে ঘুরিয়ে মধু বের করে। পরে উৎপাদিত মধু বিভিন্ন পাত্রে ভরে পাঠানো হয় দেশের বিভিন্ন জেলায়।

চলতি মৌসুমে আবহাওয়া ভালো হওয়ায় সরিষার আবাদ বাড়ার পাশাপাশি মধুও উৎপাদনও বেড়েছে বলে জানায় মৌয়ালরা।

আদর্শ মৌ খামারের স্বত্ত্বাধিকারী শহিদুল ইসলাম বলেন, এবারের মধুর উৎপাদন ও গ্রেড অনেক ভালো। প্রতিটি খামারেই ভালো উৎপাদন হচ্ছে। তবে মধু সঠিক বাজার ব্যবস্থা না থাকায় কয়েকটি সিন্ডিকেটের কারণে মধুর সঠিক দাম পাচ্ছি না আমরা। লোকসান কাটাতে সরকারি পৃষ্ঠপোষকতার দাবী ব্যবসায়ীদের।

মৌয়াল আকিজ রহমান বলেন, প্রতি সপ্তাহে এক একটি বক্স থেকে ৫ থেকে ৮ কেজি মধু পাওয়া যায়। এভাবে সকল বক্স থেকে সপ্তাহে ১০ থেকে ১২ মণ মধু সংগ্রহ করে থাকেন তারা। তবে বাজারে প্রতিটি নিত্যপণ্যের দাম অস্বাভাবিকভাবে বেড়ে যাওয়ায় কিছুটা বেশি দামে মধু বিক্রি করতে হচ্ছে তাদের। বর্তমানে বাজারে ৪-৫ হাজার টাকা মণ হিসেবে মধু বিক্রি হচ্ছে। প্রতি কেজি সরিষা ফুলের সব থেকে ভালো মানের মধু পাইকারী প্রতি কেজি ২৫০-৩০০ টাকা ও মধ্যম মানের ২০০ টাকা দরে বর্তমানে বিক্রি হচ্ছে।

সিরাজগঞ্জ জেলা কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তরের উপ পরিচালক বাবলু কুমার সূত্রধর বলেন, সরিষা ক্ষেতে মৌবাক্স থাকলে মৌমাছির মাধ্যমে ফুলে পরাগায়ন হয়। এতে সরিষার ফলন বৃদ্ধি পায় সেইসঙ্গে মধু ব্যবসায়ীরাও আর্থিকভাবে লাভবান হচ্ছেন। মৌয়ালরা যাতে সঠিক পদ্ধতিতে মধু সংগ্রহ করতে পারে সেজন্য কৃষি বিভাগের পক্ষ থেকে পরামর্শ দেয়া হচ্ছে।

কৃষি অফিসের তথ্য মতে, চলতি বছর জেলায় সরিষার আবাদের লক্ষ্যমাত্রা প্রায় ৮৭ হাজার ২০০ হেক্টর জমিতে যা গত বছরের তুলনায় প্রায় ৩৫ শতাংশ বেশি।

এ অঞ্চলে সরিষার আবাদ বৃদ্ধির সাথে সাথে বেড়েছে মৌসুমি মৌ-চাষিদের তৎপরতা। সরিষা যেমন দিচ্ছে তেল, সাথে দিচ্ছে প্রাকৃতিক সৌন্দর্য। এ ছাড়া সরিষার ফুল ও পাতা ঝরে তৈরি হয় জৈবসার। ফলে কৃষকরা এখন ধান ও অন্য ফসলের পাশাপাশি সরিষে চাষের দিকে বেশি ঝুঁকে পড়েছেন।

চাটমোহর উপজেলার হান্ডিয়াল গ্রামে কৃষক জাকির হোসেন জানান, গত বছরের চেয়ে এবার প্রায় দেড়গুণ মৌবাক্স নিয়ে হাজির হয়েছেন বিভিন্ন জেলার মৌচাষিরা। প্রাকৃতিক উপায়ে মধু সংগ্রহের ফলে শুধু মৌচাষিরাই লাভবান হচ্ছেন না, মৌমাছির বিচরণে সঠিকভাবে সরিষার ফুলে পরাগায়ন ঘটছে। তাতে সরিষার উৎপাদন ক্ষমতা বেড়ে গেছে অনেক। এতে লাভবান হচ্ছেন কৃষকরা।

শুধু তাই নয় পরিবেশবিদরা বলছেন, ক্ষেতে কীটনাশক ব্যবহার কম হওয়ায় উপকৃত হচ্ছে পরিবেশ। মৌমাছি শুধু মধুই সংগ্রহ করে না, ফসলের জন্য ক্ষতিকারক কীটপতঙ্গ মেরে ফসল উৎপাদন বৃদ্ধিতে সহায়তা করে থাকে।

পুষ্টি বিশেষজ্ঞদের মতে, আমাদের দেশে অতীতকাল থেকে মধু বহু রোগের প্রতিষেধক হিসেবে ব্যবহার হয়ে আসছে। মধু পরিপাকে সহায়তা করে, ক্ষুধা বাড়ায়, স্মৃতিশক্তি বৃদ্ধি করে, সর্দি, কাশি, জ্বর, হাঁপানি, হৃদরোগ, পুরনো আমাশয়, দাঁত, ত্বক, পেটের পীড়াসহ নানা জটিল রোগ নিরাময় করে থাকে। মধুতে বিভিন্ন পুষ্টি উপাদান ও ভেষজ গুণ রয়েছে। মধুর উচ্চমাত্রার ফ্রুক্টোজ ও গ্লুকোজ যকৃতে গ্রাইকোজেনের মজুদ গড়ে তুলতে সাহায্য করে। এ ছাড়া মধু ভালো শক্তি প্রদায়ী খাদ্য।