চাপা কান্না‘গোলাপ গ্রামে’
‘নামে কিছু যায় আসে না, গোলাপকে যে নামেই ডাকা হোক না কেন, সুবাস ছড়াবেই।’ শেক্সপিয়ারের এমন উক্তিতেই বোঝা যায়- ভালোবাসার ‘প্রতীক’ গোলাপের জনপ্রিয়তা। তবে করোনা পরিস্থিতিতে সেই গোলাপ ব্যবসায়ীদের কপালে উঠেছে হাত। করোনার কারণে সৃষ্ট টানাপড়েনের এ সময়ে মানুষ যেখানে দৈনন্দিন চাহিদা মেটাতে সংগ্রাম করছেন, এমন পরিস্থিতিতে কমেছে ফুলের চাহিদা ও বিক্রি। এতে বাগানের ফুল বাগানেই ঝরে পড়ছে।
গত কয়েক মাসে সাভার বিরুলিয়া সাদুল্লাপুর গ্রামের ফুল চাষিরা প্রায় ২৫ কোটি টাকা সমপরিমাণ ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছেন। বর্তমান বাজারে ফুলের দাম বেশি হওয়ায় চাষিরা আবারও নতুন করে আশায় বুক বেঁধে জমির পরিচর্যা শুরু করেছেন। প্রতিদিন ফুলপ্রেমীরাও এর ঘ্রাণ নিতে ছুটে আসছেন বাগানে।
রাজধানীর সন্নিকটে সাভার বিরুলিয়ায় সাদুল্লাপুর গ্রামে সরেজমিনে গিয়ে দেখা গেছে, এ এলাকায় বসবাসকারী বেশিরভাগ মানুষই যুক্ত আছেন গোলাপ ফুল চাষ ও এ ব্যবসার সঙ্গে। এখানকার মানুষের আয়ের প্রধান উৎসই এটি। করোনা পরিস্থিতিতে ফুলের কদর কমে যাওয়ায় চাষিরা আর্থিকভাবে ব্যাপক ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছেন। গত ৫-৬ মাস গোলাপের চাহিদা না থাকায় বাগানে ফুল ফুটে সেখানেই ঝরে গেলেও মুখ তুলে তাকাননি পাইকারি ও খুচরা ক্রেতারা।
এলাকাবাসী জানান, ডিসেম্বর থেকে ফেব্রুয়ারি পর্যন্ত গোলাপের মৌসুম শুরু হওয়ায় চাষিরা ধার-দেনা করে নতুনভাবে ফুল বাগানের পরিচর্যা শুরু করেছেন। প্রতিদিন চার থেকে পাঁচশ টাকা চুক্তিতে একাধিক দিনমজুর নিয়ে ফুলের বাগানের পরিচর্যা করছেন। আগাছা পরিষ্কার, সার-কীটনাশক ছিটানো, মাটি তৈরিসহ নানা ধরনের কাজ করছেন তারা। চাষিদের মধ্যে অনেকের বাগানে ফুল ফুটতেও শুরু করেছে। তাদের মধ্যে কেউ কেউ ফুল বিক্রিও শুরু করেছেন। গ্রামের পাশে দুটি বাজারে প্রতিদিন ফুল কেনাবেচা হয়ে থাকে। কৃষকরা তাদের বাগানের ফুল নিয়ে সেখানে বিক্রি করে থাকেন। প্রতিটি গোলাপ ১০ থেকে ১২ টাকা পাইকারি দরে বিক্রি হচ্ছে।
২০ বছর ধরে ফুল চাষ করছেন বিরুলিয়া এলাকার চাষি মো. আব্দুল খালেক। নিজের ৪ বিঘা জমিতে ফুল বাগান তৈরি করেছেন। সেটি দিয়ে তার ৫ সদস্যের পরিবার চলে। করোনা পরিস্থিতির কারণে গত ৭ মাস ফুল বিক্রি করা সম্ভব হয়নি। বাগানের ফুল বাগানেই ঝরে গেছে। ফুলের চাহিদা না থাকায় এ সময় ধার-দেনা করে পরিবার চালাতে হয়েছে তার। এ জন্য জমির পরিচর্যাও করেননি তিনি। ডিসেম্বর থেকে ফেব্রুয়ারি মৌসুম শুরু হওয়ায় এক আত্মীয়ের কাছ থেকে টাকা ধার নিয়ে নতুন করে বাগান পরিচর্যা করেছেন। ইতোমধ্যে গাছে ফুল আসতে শুরু করেছে। ডিসেম্বর থেকে পুরো বাগানে ফুল ভরে গেলে তা বিক্রি করে ঋণ শোধ করবেন।
তিনি বলেন, ‘গত ৭ মাস ফুল বিক্রি বন্ধ থাকায় আর্থিক সহায়তা পেতে জনপ্রতিনিধিদের দ্বারে দ্বারে ঘুরেও কোনো সাহায্য পাইনি। এ কারণে সহজশর্তে ঋণ নিতে ব্যাংক কর্মকর্তাদের কাছে গেলেও কোনো গতি হয়নি।’ তবে জমির মালিকানার দলিলপত্র জমা দিয়ে ঋণ নেয়ার পরামর্শ দিলে আর সেদিকে পা বাড়াননি তিনি। আত্মীয়ের কাছ থেকে চড়া সুদে টাকা ধার নিয়েছেন তিনি।
এক যুগের বেশি সময় ধরে ফুল চাষ করে সংসার চলে মুক্তার। নিজের তিন বিঘা জমিতে ফুলের বাগান তৈরি করেছেন। এটি তার উপার্জনের প্রধান উৎস। করোনার কারণে গত ৫ মাস ব্যবসা বন্ধ ছিল। এতে প্রায় ৫০ হাজার টাকার মতো ক্ষতি হয়েছে তার। বর্তমানে নতুন করে আগাছা ও সার-কীটনাশক ছিটিয়ে বাগান প্রস্তুত করেছেন। ডিসেম্বর থেকে ফুল বিক্রি করবেন বলে আশায় বুক বেঁধেছেন তিনি।
সোলায়মান নামের আরেক ফুল চাষি বলেন, ‘একদিকে করোনার কারণে গত ৬-৭ মাস ব্যবসা বন্ধ ছিল, অন্যদিকে লো আইল্যান্ড-ঢাকা নামের কোম্পানি কৃষি জমিতে আবাসন প্রকল্প তৈরি করছে। চাষিদের থেকে জমি কিনে আবাসন ও রাস্তা তৈরি করা হচ্ছে।’ এ পরিস্থিতিতে আগামী কয়েক বছরের মধ্যে গোলাপ গ্রামের সৌন্দর্য বিলীন হওয়ার পথে বলে মনে করছেন তিনি।
এদিকে প্রতিদিন বিভিন্ন জায়গা থেকে পরিবার-পরিজন নিয়ে গোলাপ গ্রামের সৌন্দর্য দেখতে ছুটে আসছেন ফুলপ্রেমী মানুষ। ফুলের বাগানে এসে যেন চোখের ক্ষুধা মিটিয়ে বুকভরা আনন্দ নিয়ে বাড়ি ফিরছেন তারা।
ঘুরতে আসা রাজধানীর একটি বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ের কয়েকজন শিক্ষার্থী বলেন, ‘এই গ্রামের অনেক গল্প শুনেছি, আজ বন্ধুরা মিলে বেড়াতে এসেছি। এখানে এলে প্রকৃতি আর ফুলের সুবাসে মন ভালো হয়ে যায়।’ সুযোগ পেলে তারা বারবার ছুটে আসবেন বলেও জানান।
সাভার কুরামখোদা ফুল চাষি বহুমুখী সমবায় সমিতির সাধারণ সম্পাদক আমদাজ হোসেন বলেন, ‘বিরুলিয়ায় ফুল চাষ করে প্রায় সাড়ে ৫০০ পরিবার চলে। গোলাপের চাহিদা না থাকায় গত কয়েকমাস চাষিরা ফুল বিক্রি করতে পারেননি। করোনার কারণে ফুল চাষিদের প্রায় ২৫ কোটি টাকার মতো ক্ষতি হয়েছে। ৯০ শতাংশ চাষি নানাভাবে ঋণ করে ফুল বাগান তৈরি করেছেন। ফুল বিক্রি না হওয়ায় তারা মানবেতর জীবনযাপন করছেন। অনেকে আত্মীয়-স্বজনের কাছ থেকে ধার নিয়ে পরিবারের মুখে খাদ্য তুলে দিয়েছেন।’
তিনি বলেন, ‘দেশজুড়ে বিরুলিয়ার গোলাপ গ্রামের পরিচিতি থাকলেও চাষিদের এমন দুর্দশায় কেউ পাশে এসে দাঁড়ায়নি। এমন কী ব্যাংকে ঋণ নিতে গেলেও তা দেয়া হয়নি। ব্যাংকে এক বিঘা জমির দলিল জমা দিলে ৪০ হাজার দেয়ার সিদ্ধান্ত হলেও ৬০ শতাংশ চাষিরা কয়েক বছরের চুক্তিতে ভাড়ায় বাগান তৈরি করেছেন। তাদের কোনো ধরনের ঋণ সুবিধার আওতায় আনা হচ্ছে না। এতে করে তারা সংকট থেকে ঘুরে দাঁড়াতে পারছেন না।’
গোলাপ গ্রামের অস্তিত্ব ধরে রাখতে চাষিদের দ্রুত সহজশর্তে ঋণ দেয়ার দাবি জানান তিনি।
এই রকম সংবাদ আরো পেতে হলে এই লেখার উপরে ক্লিক করে আমাদের ফেসবুক ফ্যান পেইজে লাইক দিয়ে সংযুক্ত থাকুন। সংবাদটি সম্পর্কে মন্তব্য করতে হলে এই পেইজের নীচে মন্তব্য করার জন্য ঘর পাবেন