ছেলের জন্য সেহরির ভাত সাজিয়ে রেখেছিলেন মা!
রংপুরের পীরগঞ্জে সিমেন্ট বোঝাই ট্রাক উল্টে নিহত হয়েছে ১৭ জন। এর মধ্যে ১০ জনের বাড়ি লালমনিরহাটের কালীগঞ্জ উপজেলার চন্দ্রপুর ইউনিয়নের লতাবর, উত্তর বালাপাড়া, উত্তর বত্রিশহাজারি ও গোড়ল ইউনিয়নের ঘোঙ্গাগাছ গ্রামে। এ ঘটনায় আহত হয়েছেন আরো অন্তত ১৮ জন।
শনিবার ভোরে পীরগঞ্জের কলাবাড়ি এলাকায় এ দুর্ঘটনা ঘটে। নিহতদের লাশ গতকাল বিকালে কালীগঞ্জ উপজেলা নির্বাহী অফিসার মো. শাহীনুর আলমের মাধ্যমে স্বজনদের কাছে হস্তান্তর করা হয়। সরজমিন জানা যায়, উত্তর বালাপাড়া গ্রামের দুই সহোদর আনোয়ার ও মহসিন আলীর মা মঞ্জুয়ারার আহাজারিতে নির্বাক সবাই।
আমার বাবারা আসতেছে। বিছানা সাজিয়ে রাইখাছি… সেহরির ভাত রান্না করেছি। বাবারা তো অহনও আইতেছে না। আমার বাবা মহসিন…আনোয়ার তোমরা কতদূর আইছো। তাড়াতাড়ি বাড়ি আইসো। ভাত যে বাসি হয়ে যায়! ভাত খাইয়া বিছানায় ঘুমাবা।’ সময় সময় মা সংজ্ঞা হারায়।
স্বজনরা মাথায় পানি ঢালছে। বাবা শাহ জামাল ফ্যাল ফ্যাল করে তাকিয়ে আছে। কোনো কথা নেই। আনোয়ার ও মহসিন স্থানীয় চন্দ্রপুর উচ্চ বিদ্যালয় ও কলেজের এইচএসসি দ্বিতীয় বর্ষের ছাত্র। সংসারে অনটন, তাই তারা পরীক্ষা শেষে ঢাকায় কাজ করতে যায়। ঈদের ছুটিতে তারা বাড়ি আসছিল। ছোট ভাইবোনদের জন্য জামা কাপড় কিনেছে। মোবাইলে বলেছিল মাকে।
চন্দ্রপুর ইউনিয়নের লতাবর গ্রামে গিয়ে দেখা যায়, নিহতদের পরিবারে কান্নার রোল। ‘আব্বু আমার জন্য লাল পিরান (জামা) আর হিল (স্যান্ডেল) আনবে। আমাদের সবার জন্য কাপড় কিনেছে। কিন্তু আসার পথে গাড়ি উল্টে পড়ছে।’ শনিবার দুপুরে এভাবে কথাগুলো কান্নাজড়িত কণ্ঠে বলেছিল নিহত সাদ্দাম হোসেনের (৩২) শিশুকন্যা শারমিন আক্তার সাথী (৭)।
সেখানে একই পরিবারের সাদ্দাম হোসেন ও তার ছোট ভাই আলমগীর নিহত হয়েছেন। তারা অই গ্রামের আয়ুব আলীর ছেলে। দুর্ঘটনায় আহত হয়েছেন সাদ্দামের স্ত্রী শরিফা খাতুন ও আলমগীরের স্ত্রী খাদিজা বেগম। তারা সবাই গাজীপুরে ইন্টারম্যাক্স গার্মেন্টে চাকরি করতেন। ঈদে সিমেন্টবাহী একটি ট্রাকে করে লালমনিরহাটের কালীগঞ্জ উপজেলার গ্রামের বাড়িতে ফিরছিলেন তারা।
মা জরিনা বেগম জানায়, শুক্রবার বেলা ২টার দিকে গাড়িতে ওঠার সময় ফোনে কথা হয়েছিল ছেলে সাদ্দাম ও আলমগীরের সঙ্গে। এরমধ্যে সাদ্দাম বাড়ির সবার জন্য আট হাজার টাকার ঈদের জামা-কাপড় কিনেছে বলে তার মাকে জানায়। কিন্তু সেই কাপড় নিয়ে আর ফেরা হলো না সাদ্দামের। এতে তার ভাই আলমগীর হোসেনও সড়ক দুর্ঘটনায় মারা যায়। একসঙ্গে দুই ছেলেকে হারিয়ে বুকফাটা কান্নায় ভেঙে পড়েছেন মা জরিনা বেগম।
সাদ্দামের ভাই জাহাঙ্গীর আলম মুঠোফোনে জানান, শনিবার দুপুরে তিনি তার দুই ভাইয়ের লাশ নিতে পীরগঞ্জ পৌঁছেন। সেখানে সাদ্দামের শ্যালক দেলোয়ার আর মনির হোসেনের লাশ আছে বলে জানান তিনি। নিহত দেলোয়ার ও মনির চাচাতো-জ্যাঠাতো ভাই। তাদের বাড়ি কালীগঞ্জের চন্দ্রপুর ইউনিয়নের ঘোঙ্গাগাছ গ্রামে।
কালীগঞ্জ উপজেলা নিবাহী কর্মকর্তা শাহীনুর আলম জানান, রংপুরের পীরগঞ্জ এলাকায় সড়ক দুর্ঘটনায় লালমনিরহাট জেলার কালীগঞ্জ উপজেলার ১০ জন ও পার্শ্ববর্তী আদিতমারী উপজেলার ২ জন নিহত হয়েছেন। বাকিরা বিভিন্ন এলাকার বলে জানান তিনি। শনিবার বিকালে তিনি নিহতদের লাশ নিয়ে কালীগঞ্জের উদ্দেশে রওনা দিয়েছেন বলে জানান।
এদিকে, নিহতদের মধ্যে লালমনিরহাট জেলার কালীগঞ্জ উপজেলার ১০ জন, আদিতমারী উপজেলার ২ জনসহ আরো কয়েকজনের পরিচয় পাওয়া গেছে।
তারা হলেন- আদিতমারী উপজেলার মহিষখোঁচা গ্রামের খালেক মিয়ার পুত্র রবিউল ইসলাম (২৮) ও বড়াইবাড়ি গ্রামের আইয়ুব আলীর পুত্র আজিজুল ইসলাম (২২), কালীগঞ্জ উপজেলার উত্তর বত্রিশহাজারী গ্রামের ঝন্টু মিয়ার মেয়ে সুবর্ণা (১২), একই গ্রামের আহম্মেদ আলীর পুত্র কোহিনুর ইসলাম (৪০), জাহাঙ্গীর আলমের ছেলে মজনু মিয়া (৪৮), উত্তর বালাপাড়া গ্রামের শাহজামালের ছেলে আনোয়ার হোসেন (২১) ও মহসিন (২০)।
লতাবর গ্রামের মো. আইয়ুব আলীর পুত্র সাদ্দাম হোসেন (৩০) ও আলমগীর। আশরাফুল ইসলামের পুত্র শহিদুল ইসলাম (২৬)। একই উপজেলার গোড়ল ইউনিয়নের ঘোঙ্গাগাছ গ্রামের সৈয়দ আলীর পুত্র দোলোয়ার হোসেন (২৫), মনোয়ার হোসেনের ছেলে মনির হোসেন (২২) এবং ময়মনসিংহ জেলার ভালুকা উপজেলার বালুঝুড়ি গ্রামের সিরাজ উদ্দিনের পুত্র জসিমুদ্দিন (৪২), কুড়িগ্রাম জেলার ফুলবাড়ী উপজেলার সোনাকাজি গ্রামের নবাব সরকারের কন্যা নাশিদা আক্তার (২৮), ঝিনাইদহ জেলার শৈলকুপা উপজেলার মিম গ্রামের আনিছুজ্জামান (৪০) ও তার স্ত্রী সামছুন্নাহার (৩৫)। এমজমিন
এই রকম সংবাদ আরো পেতে হলে এই লেখার উপরে ক্লিক করে আমাদের ফেসবুক ফ্যান পেইজে লাইক দিয়ে সংযুক্ত থাকুন। সংবাদটি সম্পর্কে মন্তব্য করতে হলে এই পেইজের নীচে মন্তব্য করার জন্য ঘর পাবেন