জমির নামজারি কীভাবে করবেন
মিউটেশন বা নামজারি হচ্ছে জমিসংক্রান্ত বিষয়ে মালিকানা পরিবর্তন করা। জমি হস্তান্তর হলে খতিয়ানে পুরোনো মালিকের নাম বাদ দিয়ে নতুন মালিকের নাম প্রতিস্থাপন করানোই হচ্ছে মিউটেশন বা নামজারি। নানা কারণে মালিকানা বদল হতে পারে। উত্তরাধিকার, বিক্রয়, দান, খাসজমি বন্দোবস্তসহ বিভিন্ন ধরনের হস্তান্তরের কারণে মালিকানা বদল হয়। কিন্তু মিউটেশন না করানো হলে মালিকানা পূর্ণ দাবি করার ক্ষেত্রে অনেক জটিলতা তৈরি হয়। নামজারির গুরুত্ব অনেক। যেমন, খতিয়ান সংশোধননের ক্ষেত্রে কাজে লাগে। রেকর্ড সংশোধনের নামজারির আবেদন মঞ্জুর করার যে আদেশ তা মালিকানার হালনাগাদ রেকর্ড। নামজারির মাধ্যমে জমির আগের জোতজমা থেকে খারিজ (কর্তন) হয়ে আবেদনকারীর নামে নতুন হোল্ডিং বা জোতের সৃষ্টি করে। না হলে আগের মালিকের নামেই থেকে যায়। এতে করে আগের মালিক বিভিন্ন সুবিধা ও জালিয়াতির সুযোগ পান। মূলত মিউটেশন বা নামজারির প্রক্রিয়া ভূমি উন্নয়ন কর বা খাজনা আদায়ের লক্ষ্যেই প্রবর্তন করা হয়েছিল। ভূমি অফিসে ভূমি করের জন্য নতুন হিসাব নম্বর খোলা হয়। নামজারি বা মিউটেশন সাধারনত দুই ধরনের হয়ে থাকে। যথাÑ ০১. মূল খতিয়ানে নাম কর্তন বা যোগ করে নামজারি করে এবং ০২. কোনো খতিয়ানের কোনো অংশীদার বা নতুন মালিক খতিয়ান থেকে বের হয়ে বা খারিজ হয়ে স্বতন্ত্র খতিয়ান খুলতে চাইলে স্বতন্ত্রভাবে নামজারি করতে পারে।
কোথায় করা হয় মিউটেশন বা নামজারি
সহকারী কমিশনার (ভূমি) অফিসে নামজারির জন্য আবেদন করতে হয়। সহকারী কমিশনা (ভূমি) অফিসে মিউটেশন বা নামজারি সহকারী পদের একজন দায়িত্বে থাকে। নাজির পদের একজন ফি জমা নেন। তহশীলদাররা (সহকারী সেটেলমেন্ট অফিসার) তদন্তের দায়িত্বে থাকে। কোনো আবেদন করা হলে এ নামজারি করা জমির ওপর তদন্ত করার নিয়ম আছে। অনেকে বিভ্রান্ত হয়ে তহশীলদারের অফিসে নামজারির আবেদন করে থাকে। এটা ঠিক নয়। সব সময় মিউটেশন বা নামজারির জন্য আবেদন করতে হবে সহকারী কমিশনার(ভূমি) অফিসে।
কীভাবে আবেদন করতে হয়
বর্তমানে সরকারি ভূমি ওয়েবসাইট www.land.gov.bd তে প্রবেশ করে ই-নামজারির মাধ্যমে প্রদর্শিত আবেদন ফরমটি পূরন করে সেন্ট করার পর ডাউনলোড করে প্রিন্ট আউট করার পর ২০ (বিশ) টাকা কোর্ট ফি ও পাসপোর্ট সাইজের ১ কপি ছবি আঠা দিয়ে লাগিয়ে সেই মূল আবেদন পত্রটি উপজেলা কমিশনার(ভূমি) বরাবরে জমা দিতে হবে। এতে আবেদনের নিচে তফসিল দিতে হবে। এতে দিতে হবে জমির বিস্তারিত পরিচয়। খতিয়ান নম্বর, দাগ নম্বর, জমির পরিমাণ, মৌজা ও জেলা উল্লেখ করতে হবে। আবেদনে নাম, ঠিকানা, রেজিষ্ট্রি ক্রয় দলিলের নম্বর ও সাল স্পষ্ট থাকতে হবে। একই সঙ্গে কবলা দলিলের অনুলিপি, বায়া দলিল, পর্চা বা খতিয়ানের অনুলিপি ওয়ারিশান সব (ইউপি চেয়ারম্যান, ওয়ার্ড কমিশনারের প্রদত্ত প্রযোজ্য ক্ষেত্রে) ভূ-উন্নয়ন কর পরিশোধের দলিল, বন্টননামা দলিল(প্রযোজ্য ক্ষেত্রে) দিতে হবে। এ ছাড়া খাসজমি বন্দোবস্তের ক্ষেত্রে কবুলিয়ত, নিলামের ক্ষেত্রে বায়নানামা, কোনো অফিস কর্তৃপক্ষের অনুমতি জমা দিতে হবে(প্রযোজ্য ক্ষেত্রে)। কোনো রায় বা ডিক্রির কারণে মিউটেশন করতে হলে ডিক্রি বা রায়ের অনুলিপি জমা দিতে হবে। খেয়াল রাখতে হবে মিউটেশন করাতে গিয়ে কোনো দালালের খপ্পরে যেন না পড়েন।
মিউটেশন যেভাবে সম্পন্ন হয়
মিউটেশনের আবেদনের পরিপ্রেক্ষিতে এর তদন্ত হয়। সহকারী কমিশনার (ভূমি) প্রথমেই মিউটেশন রেজিস্টারে লিপিবদ্ধ করে তহশীলদারের কাছে পাঠান। এর পরিপ্রেক্ষিতে তদন্ত হয়। তদন্তে সাধারণত যাচাই করা হয় প্রস্তাবিত জমি দখলে আছে কি নেই। এটি খাসজমি কি না, সার্টিফিকেট মোকদ্দমা আছে কি না, অধিগ্রহন করা হয়েছে কি না, সম্পত্তির মূল পরিমাণ ঠিক আছে কি না, আদালতের রায় বা ডিক্রিমূলে কি না, মামলা-মোকদ্দমা চলছে কি না প্রভুতি। এ তদন্ত প্রতিবেদন পাওয়ার পর সহকারী কমিশনার (ভূমি) তা যাছাই-বাছাই করে দেখেন। প্রয়োজনে তিনি আবারও তদন্তে প্রেরণ করতে পারেন কিংবা নিজের তদন্ত করতে পারেন। পরে যাবতীয় কাগজপত্র, দলিল মিলিয়ে দেখে মিউটেশনের জন্য অনুমোদন দেওয়া হয়। অনুমোদন হলে খতিয়ান খোলা হয়। পক্ষগণ হাজির হতে হয় এবং শুনানিকালে যাবতীয় দলিল পরীক্ষা করা হয়। এর ভিত্তিতে আবেদন মঞ্জুর বা নামঞ্জুর হয়। খতিয়ান খোলার পর নতুন নম্বও পড়ে। খতিয়ান তহশীল অফিসে পাঠায়। তহশীলদার রেজিষ্টারে নতুন জোত খুলে ছক অনুযায়ী তথ্য লিপিবদ্ধ করেন। মালিকের নামে আগে থেকে জমি থাকলে জোত নম্বরও থাকে। তাই নতুন জোত খোলার দরকার হয় না। পুরোনো জোতে জমির দাগ ও খতিয়ান লিখে জমির পরিমাণ যোগ করে ভূমি উন্নয়ন কর হিসাব করা হয়। মোট পাঁচ কপি খতিয়ান করে এক কপি আবেদনকারীকে দেওয়া হয়। অন্যান্য কপি তহশীল অফিস, সহকারী কমিশনার (ভূমি), জেলা প্রশাসকের রেকর্ডরুম ও জেলা জজের রেকর্ডরুমে প্রেরণ করা হয়। বর্তমান নিয়ম অনুযায়ী মহানগরে ৬০ কার্যদিবসের অন্যান্য ক্ষেত্রে ৪৫ কার্যদিবসের মধ্যে নামজারি জমাভাগ নিষ্পত্তি করার নিয়ম করা হয়েছে।
আবেদন নামঞ্জুর হলে কী করবেন
যে কোনো করণেই নামজারি আবেদন নামঞ্জুর হতে পারে। কোনো দলিল দস্তাবেজে ত্রæটির কারণে হতে পারে, আবার অন্য কোনো উদ্দেশ্যেও নামঞ্জুর হতে পারে। কিন্তু আবেদন নামঞ্জুর হলে প্রতিকারের সুয়োগ রয়েছে। মিউটেশন নামঞ্জুর হলে সহকারী কমিশনারের (ভূমি) আদেশের বিরুদ্ধে অতিরিক্ত জেলা প্রশাসকের (রাজস্ব) কাছে আদেশের ৩০ দিনের মধ্যে আপিল করতে হবে। অতিরিক্ত জেলা প্রশাসকের (রাজস্ব) আদেশের বিরুদ্ধে আপিল করার সুযোগ আছে অতিরিক্ত বিভাগীয় কমিশনারের (রাজস্ব) কাছে এবং তা করতে হয় আদেশের ৩০ দিনের মধ্যে। অতিরিক্ত বিভাগীয় কমিশনারের (রাজস্ব) আদেশের বিরুদ্ধে ভূমি আপিল বোর্ডে আদেশের ৯০ দিনের মধ্যে আপিল করা যায়। তবে ক্ষেত্র বিশেষে দেওয়ানী আদালতেও মামলা করা যায়। এছাড়া রিভিশনের পথও খোলা রয়েছে। ক্ষমতা প্রাপ্ত কোনো কর্মকর্তা তার নিজের ইচ্ছাই নথি তলব করে সংশোধনের আদেশ দিতে পারেন। অতিরিক্ত জেলা প্রশাসক (রাজস্ব) ৩০ দিনের মধ্যে তার অধিন কর্মকর্তাদেও আদেশ সংশোধন করতে পারবেন। অতিরিক্ত বিভাগীয় কমিশনার (রাজস্ব) তিন মাসের মধ্যে অতিরিক্ত জেলা প্রশাসকের (রাজস্ব) আবেদন সংশোধন করতে পারেন। ভূমি আপিল বোর্ড ছয় মসের মধ্যে তার অধীন কর্মকর্তার আদেশ সংশোধন করতে পারেন। এছাড়া রিভিউ পথও খোলা আছে। রিভিউ মানে হচ্ছে পূর্ণ বিবেচনা করা। দলিল পত্রে কোনো ভুল পর্যবেক্ষণ হয়েছে বলে মনে করলে কিংবা আবেদন বাতিল করলে রিভিউ আবেদন করতে হয়। যে কর্মকর্তা আদেশ দিয়েছেন তার বরাবরই রিভিউ করতে হবে। রিভিউ করতে ৩০ দিনের মধ্যে। তবে রিভিউ আবেদন করা হলে আর আপিল করা যায় না।
সতর্কতা
১. নামজারি করানোর সময় নির্ধারিত জমি পরিমাপ করে নেওয়া উচিত। অনেক সময় মালিক তার জমির নিদির্ষ্ট পরিমান দলিলে থাকলেও অবস্থানের কিছুটা হেরফের থাকতেই পারে নানা কারণে। জমি পরিমাপ করে স্কেচম্যাপ করে তার সব সংরক্ষণ করা উচিত।
২. জমির দখল থাকা জমির মালিকানার একটি শর্তই বলা চলে। তবে বন্ধক দিলেও মালিকানা বজায়ের বিষয় থাকে। তাই মালিকানা করার জন্য দখল নেওয়াটা জরুরী।
৩. কোনো বিক্রেতা কি পরিমান জমি বিক্রি করলেন তা খতিয়ে দেখতে হবে। নামজারি করা জমিটি মূল দলিলের চেয়ে বেশি দেখানো হতে পারে। অর্পিত সম্পত্তির ক্ষেত্রে পুরোনো জাল দলিল সৃষ্টি করে নামজারি দাবি করতে পারে। কোনো জাল দলিলের ভিত্তিতে নামজারি করানো হচ্ছে কি না, সতর্ক থাকতে হবে।
৪. আবেদন করার পর জমির সহশরীক এবং ক্রেতা-বিক্রেতাকে নোটিশ দেওয়া হয়। কোনো অভিযোগ থাকলে তখন আপত্তি দিতে হবে। কিন্তু অনেক সময় নোটিশ যথাযথভাবে পৌছায়না কিংবা গায়েব করে ফেলা হয়। এ বিষয়ে সতর্ক থাকতে হবে।
৫. নামজারির ক্ষেত্রে ভোগান্তি আর হয়রানির শেষ নেই। একটু সতর্ক থেকে নিজের অধিকারের প্রতি সচেতন থাকলে তা ঠেকানো সম্ভব। নামজারি করাতে নিদির্ষ্ট ফি আছে। কিন্তু বাস্তবে খুশি করানোর বকশিশ তার চেয়ে বহুগুন দিতে হবে। না হলে নথি উঠে না ঠিকমতো। আবার দালালদের উৎপাতও কম নয়।
৬. নামজারিতে অনেক সময় দাগ নম্বর ভূল হতে পারে। এটি ইচ্ছাকৃত হতে পারে আবার অনিচ্ছাকৃত হতে পারে। অনেক সময় সঠিক তদন্তের অভাবে দাগ নম্বর ভুল হয়। এ ক্ষেত্রে মনে হয় যে কর্মকর্তা ইচ্ছে করে ভুল করেছে কিংবা কোনো প্রকার দূর্নীতির আশ্রয় নিয়েছে, তাহলে তাদের বিরুদ্ধে উর্ধ্বতন কর্মকর্তার অভিযোগ উত্থাপন করতে হবে। দ্বিতীয়ত, এ নামজরিটি বাতিল চাইতে হবে এবং নতুন করে নামজারিটির জন্য আবেদন করতে হবে।
লেখক: সাংবাদিক ও কলামিষ্ট
এই রকম সংবাদ আরো পেতে হলে এই লেখার উপরে ক্লিক করে আমাদের ফেসবুক ফ্যান পেইজে লাইক দিয়ে সংযুক্ত থাকুন। সংবাদটি সম্পর্কে মন্তব্য করতে হলে এই পেইজের নীচে মন্তব্য করার জন্য ঘর পাবেন